অলসতা দূর করতে ক্রীড়াবিদদের মানসিক কৌশল

0
17
অলসতা দূর করতে ক্রীড়াবিদদের মানসিক কৌশল

ডা. আসাদুল বারী চৌধুরী অমি
এমডি ফেইজ—বি রেসিডেন্ট, সাইকিয়াট্রি
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।

অলসতা মানে কর্মবিমুখতা, নিষ্ক্রিয়তা।  নিষ্ক্রিয় অথবা কর্মবিমুখ কিংবা উদ্যমহীন ব্যক্তিকে অলস বলা হয়। আলসেমি নিজের, পরিবারের ও সমাজের অবক্ষয় ডেকে আনে। অলসতা একটি জাতির উন্নতির পথে হুমকিস্বরূপ।

অলসতা বা কর্মপ্রেরণার অভাব ক্রীড়াবিদদের জন্য খুব সাধারণ একটা  চ্যালেঞ্জ, বিশেষ করে যখন তারা বড় কোনো প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুতি নেন অথবা কেবল শারীরিক ফিটনেস বজায় রাখার চেষ্টা করেন। তবে ইতিবাচক ব্যাপার হচ্ছে – অলসতা কাটানোর জন্য শুধুমাত্র ইচ্ছাশক্তির প্রয়োজন হয় না; ক্রীড়াবিদরা বেশ কিছু মানসিক কৌশল ও মনোবিজ্ঞানী প্রযুক্তি ব্যবহার করেন, যা তাদের প্রেরণাহীনতা বা আলস্য দূর করতে সাহায্য করে।

মূলত ক্রীড়ায় অলসতার কী কী কারণ থাকতে পারে ?

ক্রীড়ায় অলসতার অনেক সম্ভাব্য কারণ রয়েছে। যেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে –

–       পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবঃ যতটা প্রয়োজন ততটা ঘুম না পাওয়া বা খুব রাত পর্যন্ত জেগে থাকা শরীরকে অবসন্ন করে তোলে ও অলসতার অনুভূতি সৃষ্টি করে।

  • মানসিক চাপ বা স্ট্রেস: উচ্চ চাপযুক্ত পরিবেশ একজন ব্যক্তিকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নিঃশেষ এবং অবসাগ্রস্ত করতে পারে।

–       দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ বা অ্যানজাইটি: উদ্বেগ ব্যক্তি বা ক্রীড়াবিদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, মনোযোগের মাত্রা কমিয়ে দিতে পারে।

–       অপুষ্টি বা পর্যাপ্ত পুষ্টির অভাব : চিনির ও পরিশোধিত কার্বোহাইড্রেটের বেশি পরিমাণে খাবার খেলে শক্তির হ্রাস হতে পারে, আর প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাবে অলসতা সৃষ্টি হতে পারে। পানি শূণ্যতাও আপনাকে অলস অনুভব করতে পারে।

–       মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা: মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, যেমন বিষণ্নতা বা মন খারাপ জনিত সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি সৃষ্টি করতে পারে।

–       শারীরিক সমস্যাঃ স্লিপ অ্যাপনিয়া, হাইপোথাইরয়েডিজম, ক্যান্সার, মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস, কিডনি রোগ, ডায়াবেটিস, এবং ফাইব্রোমায়ালজিয়া, অলসতা বা ক্লান্তির সঙ্গে সম্পর্কিত।

–       পিছিয়ে রাখা বা প্রোক্রাস্টিনেশন: পিছিয়ে রাখার প্রবণতা একটি অস্বাস্থ্যকর কৌশল যা নেতিবাচক অনুভূতিকে ঠেকাতে ব্যবহৃত হয় এবং প্রায়ই উদ্বেগ সৃষ্টি করে।

–       ইতিবাচক দৃষ্টি অভাব

Magazine site ads

অলসতা দূর করতে ক্রীড়াবিদদের মানসিক কৌশল

ক্রীড়াবিদদের সফলতা শুধু শারীরিক প্রশিক্ষণ ও দক্ষতার ওপর নির্ভর করে না, বরং এক্ষেত্রে তাদের মানসিক শক্তি, মনোবল এবং মানসিক কৌশলও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে অলসতা বা একঘেঁয়েমি অনুভূতির সমস্যাও কম নয়। অনেক সময় ক্রীড়াবিদরা ফর্মে থাকার জন্য সঠিক মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারেন না, যার ফলে অলসতা ও মনোযোগের অভাব দেখা দেয়। এই অলসতা দূর করার জন্য ক্রীড়াবিদদের কিছু বিশেষ মানসিক কৌশল অবলম্বন করা প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্র তারা বেশ কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ ও কৌশল গ্রহণ করেন, যা খেলার ফলাফলে ভালো কাজ দেয়।

  • নির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করাঃ ক্রীড়াবিদদের একটি স্পষ্ট লক্ষ্য থাকা অপরিহার্য। লক্ষ্য নির্ধারণ শুধু তাদের শারীরিক প্রস্তুতিতে সহায়ক হয় না, বরং তাদের মনোবলও বাড়ায়। ছোট ও বাস্তবসম্মত লক্ষ্য নির্ধারণ করার মাধ্যমে তাদের অর্জনের প্রণোদনা বাড়ে এবং অলসতার বিরুদ্ধে লঢ়াই করতে তারা আরও উৎসাহিত হয়। যেমন “আজ ৫ কিলোমিটার দৌড়ানো হবে” বা “এই সপ্তাহে ৩টি নতুন শট প্র্যাকটিস করা হবে” – এমন ছোট ছোট লক্ষ্য একজন ক্রীড়াবিদকে প্রেরণা দিতে পারে।
  • আত্মবিশ্বাস গঠনঃ ক্রীড়াবিদদের মধ্যে অলসতার অন্যতম কারণ হচ্ছে আত্মবিশ্বাসের অভাব। যখন তারা নিজের সক্ষমতা নিয়ে সন্দিহান হন, তখন অলসতা ও পরিশ্রম থেকে দূরে চলে যান। এজন্য আত্মবিশ্বাস গঠন করা জরুরি। সফলতা, ছোট ছোট বিজয় ও নিজের কাজের গতি ক্রীড়াবিদদের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
  • সময়ের যথাযথ ব্যবস্থাপনাঃ অলসতা দূর করার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হল সময়ের সঠিক ব্যবস্থাপনা। ক্রীড়াবিদদের প্রতিদিনের শিডিউল বা কর্মপদ্ধতি যথাযথভাবে তৈরি করা উচিত, যাতে তারা জানেন কখন এবং কীভাবে তাদের প্রশিক্ষণ, বিশ্রাম, এবং অন্যান্য কার্যকলাপ সম্পন্ন করতে হবে। কঠোর সময়সূচী ক্রীড়াবিদদের মানসিকভাবে প্রস্তুত রাখে এবং অলসতা বা সময় নষ্টের সুযোগ কমিয়ে দেয়।

–       ধ্যান ও মেডিটেশনঃ প্রশান্ত বা সজাগ মনের জন্য ধ্যান ও মেডিটেশন অত্যন্ত কার্যকরী। ক্রীড়াবিদরা ধ্যান ও শ্বাস-প্রশ্বাসের রিল্যাক্সেশন ব্যায়াম করে তাদের মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য পান। ধ্যান বা মেডিটেশন করলে তারা তাদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু স্থির রাখতে পারেন, যা মানসিক প্রশান্তি আনে এবং দুশ্চিন্তা কমায়। অনেক ক্রীড়াবিদ প্রতিদিন এক নির্দিষ্ট সময় ধ্যান করেন, যাতে তাদের মস্তিষ্ক শিথিল হয় এবং তারা মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে পারেন।

  • মনের শক্তি বৃদ্ধির কৌশল প্রয়োগ করাঃ ক্রীড়াবিদরা মানসিকভাবে শক্তিশালী হতে হলে ধ্যান, visualization (দৃষ্টিভঙ্গি কল্পনা) ও মেডিটেশন করতে পারেন। এসব কৌশল তাদের মস্তিষ্ককে শিথিল করে এবং কঠিন পরিস্থিতিতেও মনোযোগ ধরে রাখতে সাহায্য করে। যখন কোনো ক্রীড়াবিদ অলস বোধ করেন, তখন তাদের মস্তিষ্কে ইতিবাচক চিন্তা ও আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলার চেষ্টা করা উচিত। যেমনঃ একটি সফল ম্যাচের কল্পনা বা একটি কঠিন ট্রেনিং সেশনের পরে শান্তি অনুভব করার চিত্র মনে করা তাদের আরো উৎসাহিত করতে পারে।
  • সহায়ক পরিবেশ তৈরি করাঃ ক্রীড়াবিদদের জন্য একটি উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা গুরুত্বপূর্ণ। একটি ইতিবাচক, শক্তিশালী এবং সমর্থনমূলক পরিবেশ তাদের মনোযোগ এবং অনুপ্রেরণা বাড়াতে সহায়ক হতে পারে। তাদের সতীর্থদের সহায়তা, কোচের উৎসাহ, এবং পরিবারের সমর্থন একটি ক্রীড়াবিদকে অলসতা থেকে বের করে এনে আরও ভালো পারফরম্যান্স দিতে সাহায্য করতে পারে।

মনের খবর ম্যগাজিনে

  • প্রয়োজনীয় বিরতি নেওয়া ও বিশ্রামঃ কখনও কখনও ক্রীড়াবিদরা অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েন, যা অলসতার অনুভূতির জন্ম দেয়। তবে সঠিক সময়ে বিশ্রাম নিলে শরীর-মন পুনরায় তরতাজা করা সম্ভব। একান্তে সময় কাটানো বা কিছুটা বিশ্রাম নেওয়া ক্রীড়াবিদকে মানসিকভাবে প্রফুল্ল রাখে এবং পরবর্তীতে আরও ভালোভাবে প্রস্তুতি নিতে সাহায্য করে। সপ্তাহে একদিনের জন্য অবসর গ্রহণ বা হালকা ছুটি তাদের মানসিক চাপ কমাতে এবং নতুন উদ্যমে ফিরে আসতে সাহায্য করে।
  • মানসিকভাবে সতর্কতা থাকা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করাঃ ক্রীড়াবিদদের মানসিকভাবে সতর্ক থাকতে হবে। অলসতা অনেক সময় আসে যখন তারা তাদের কাজের প্রতি মনোযোগ হারিয়ে ফেলে। বিভিন্ন মনোযোগের কৌশল এবং মনোযোগ নিবদ্ধ করার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে ক্রীড়াবিদরা নিজেদের আরও সুসংহত রাখতে পারেন।
  • ইতিবাচক চিন্তা ও ভিজ্যুয়ালাইজেশনঃ ক্রীড়াবিদরা তাদের সাফল্যের কল্পনা বা দৃশ্যায়ন (visualization) করে মানসিকভাবে শক্তিশালী হতে চেষ্টা করেন। এটি একটি প্রমাণিত কৌশল যেখানে তারা সফল পারফরম্যান্স বা ফলাফল কল্পনা করেন। এভাবে, তারা নিজের সাফল্য দেখতে এবং অনুভব করতে পারেন, যা তাদের আত্মবিশ্বাস ও মানসিক স্থিরতা বাড়ায়। যেমন- কোনো বড় টুর্নামেন্টের আগ মুহূর্তে ক্রীড়াবিদরা কল্পনা করতে পারেন যে তারা প্রতিযোগিতায় সফলভাবে জয়ী হয়ে মাঠ ছাড়ছেন, যা তাদের উদ্বেগ কমায় এবং আত্মবিশ্বাসী করে তোলে।
  • ইতিবাচক কথা বলাঃ ক্রীড়াবিদদের জন্য আত্মবিশ্বাসের অভাব বা নেতিবাচক চিন্তা তাদের মানসিক অবস্থাকে আরও খারাপ করতে পারে। এজন্য তারা আত্মবিশ্বাসী এবং ইতিবাচক সেলফ-টক (self-talk) ব্যবহার করে মানসিক চাপ মোকাবিলা করেন। তাদের মনকে শক্তিশালী রাখতে তারা প্রায়ই নিজেদের শিথিল করে এবং জানিয়ে দেন যে তারা সক্ষম। ‘আমি এটা পারব’ বা ‘আমি যথেষ্ট শক্তিশালী’ এমন চিন্তা ক্রীড়াবিদদের উদ্বেগ কমায় এবং ফোকাস বজায় রাখতে সাহায্য করে।
  • কোচ ও ম্যানেজারদের সাথে আলোচনাঃ ক্রীড়াবিদদের জন্য মানসিক সমর্থন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোচ, ম্যানেজার বা একজন মনোবিজ্ঞানীর সাথে নিয়মিত আলোচনা তাদের মানসিক সমস্যা সমাধানে সহায়ক হতে পারে। একজন পেশাদার পরামর্শদাতা বা সাইকোলজিস্ট ক্রীড়াবিদদের উদ্বেগ, আত্মবিশ্বাসের অভাব, এবং বিষণ্ণতা ইত্যাদি সমস্যা নিয়ে কাজ করতে পারেন। যেমন – অনেক ক্রীড়াবিদ প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে বা প্রতিযোগিতার চাপ মোকাবিলার জন্য মনোচিকিৎসক বা স্পোর্টস সাইকোলজিস্টের সাথে নিয়মিত সেশন করে থাকেন।
  • শারীরিক প্রশিক্ষণ ও ফিটনেস বজায় রাখাঃ শারীরিক ব্যায়াম কেবল শারীরিকভাবে নয়, মানসিকভাবে অনেক উপকারে আসে। শারীরিক প্রশিক্ষণ – যেমন ভারী ব্যায়াম বা দৌড় ক্রীড়াবিদদের স্ট্রেস কমায় এবং এন্ডোরফিন  ‘সুখ’ হরমোন ) নিঃসৃত করে, যা তাদের মেজাজকে উন্নত করে। যেমন – যখন কোনো ক্রীড়াবিদ মানসিক চাপ অনুভব করেন, তখন তিনি কঠিন একটা ট্রেনিং সেশন বা কাজের পর কিছুক্ষণের জন্য শারীরিকভাবে শিথিল হতে পারেন।
  • স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট বা চাপ মোকাবেলার কৌশলঃ ক্রীড়াবিদরা তাদের মানসিক চাপ মোকাবিলা করার জন্য কিছু কৌশল ব্যবহার করেন। এগুলো সাধারণত শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম, যোগ-ব্যায়াম, ইয়োগা বা অন্যান্য শিথিলায়নের মাধ্যমে করা হয়। স্ট্রেস কমানোর জন্য কাজের পর নিয়মিত বিশ্রাম, হাঁটাহাঁটি এবং প্রকৃতির মাঝে সময় কাটানোও গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণ হসেবে বলা যায় – ক্রীড়াবিদরা সাধারণত শ্বাস-প্রশ্বাসের কৌশল ব্যবহার করে তাদের মানসিক চাপ কমানোর চেষ্টা করেন।
  • সামাজিক সমর্থন ও তাতে পরিবারের ভূমিকাঃ ক্রীড়াবিদরা যখন মানসিকভাবে চাপ অনুভব করেন, ঐ সময়ে তাদের পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সমর্থন অপরিহার্য। ক্রীড়াবিদদের জন্য সামাজিক সমর্থন তাদের মানসিক অবস্থা উন্নত করতে এবং তাদের মনোবল বাড়াতে সাহায্য করে। তাদের প্রিয়জনদের সহানুভূতি এবং উৎসাহ ক্রীড়াবিদদের চাপ কমায় এবং তাদের মনে শান্তি এনে দেয়। অনেক ক্রীড়াবিদ প্রতিযোগিতার আগে বা পরে তাদের পরিবারের সদস্যদের সাথে সময় কাটাতে পছন্দ করেন, যা তাদের মানসিক শান্তি দেয়।

উপসংহার

অলসতা ক্রীড়াবিদদের ক্যারিয়ার তথা পারফরমেন্সের জন্য প্রতিকূলতা স্বরূপ। তবে সঠিক মানসিক কৌশল ব্যবহার করে একে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। নির্দিষ্ট লক্ষ্য, সময়ের যথাযথ ব্যবস্থাপনা, আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি, ইতিবাচক চিন্তা এবং পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অলসতা দূর করা সম্ভব। ক্রীড়াবিদদের জন্য মানসিক শক্তি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি তাদের শারীরিক দক্ষতা অর্জনও অনুশীলনের পাশাপাশি একটি মনের প্রস্তুতির বিষয়।

আরও পড়ুন-

Previous articleএঙ্গার ম্যানেজমেন্ট ও আমাদের প্রত্যাহিতক জীবনে তার রূপান্তর
Next articleমনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনের নতুন মূল্য নির্ধারণ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here