প্রশ্ন: আমার নাম রুনা। আমার সমস্যা প্রথম হালকা টেনশন থেকেই শুরু হয়েছিল ঘুম কম হওয়া। বাচ্চা হওয়ার পর মেয়েদের এমনিতেই ঘুম কম হয়, আমারও তাই হয়েছিল। সেই কম ঘুম আজও কমই রয়ে গেল। বর্তমানে এটা অনিদ্রার পর্যায়ে চলে গেছে। ওষধ না খেলে ঘুম হয় না। হলেও খুব কম, শেষ রাতের দিকে। এটা প্রায় ৭-৮বছর হয়ে গেছে। অনিদ্রার আদৌ কোন চিকিৎসা আছে? সঠিক উত্তর জানালে উপকৃত হতাম।
ডা. সৃজনী আহেমদ: ধন্যবাদ আপনার প্রশ্নের জন্য। আপনি বেশ কষ্টের মধ্যে আছেন দেখা যাচ্ছে। আমাদের শরীরের একটা ছন্দ আছে। দৈনন্দিন কার্যক্রমগুলোর মধ্যে ঘুম অন্যতম। অনেক সময়ই এই ছন্দের অনিয়ম হলে সেটাই নিয়মিত হয়ে যায়। আপনার ক্ষেত্রে এরকম একটা কিছু হয়েছে। আপনি জানিয়েছেন যে, বাচ্চা হওয়ার পর থেকে এই সমস্যাটা শুরু হয়েছে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে মনের উদ্বিগ্নতা, বিষন্নতা ঘুমের উপর প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে ঘুমানোর শুরুতে সমস্যা হওয়াটা উদ্বিগ্নতাজনিত মানসিক সমস্যার জন্য হয়।
আপনার সমস্যার ক্ষেত্রে কয়েকটা বিষয় আরো জানার আছে।
১.আপনি কি ওষুধ খাচ্ছেন? কবে থেকে খাচ্ছেন? যেই মাত্রায় আগে খাচ্ছিলেন সেটা বাড়াতে হচ্ছে কিনা?
২.আপনার দৈনন্দিন রুটিন কেমন? সকালে কয়টায় উঠেন ঘুম থেকে? দুপুরে ঘুমান কিনা?
৩.আপনার আগে ঘুমের সমস্যা ছিলো কিনা?
৪.আপনার বাবা-মা ও ভাই-বোনের কারো ঘুমের সমস্যা আছে কিনা?
৫. চা কফি খাওয়ার অভ্যাস আছে কিনা? খেলে কখন খান?
এই প্রশ্নগুলো জানতে চাওয়ার কারন হচ্ছে, ঘুমের ছন্দটা দৈনন্দিন রুটিনের কারনে পরিবর্তন হয়। যদি আপনি শেষ রাতে ঘুমিয়ে সকালে দশটা এগারোটার দিকে উঠেন অথবা দুপুরে এক ঘন্টার বেশি ঘুমান তাহলে আপনার শরীরের ঘুমের ঘড়ি সেভাবেই কাজ করতে থাকবে। অর্থাৎ তার সময় ঠিক করবে রাত তিনটা থেকে সকাল নয়টা-দশটা এভাবে। তাই রুটিনের একটা বড় ভূমিকা আছে ঘুমের ক্ষেত্রে। আপনাকে ঘুমের স্বাস্থ্যকর কিছু নিয়মাবলী আছে, সেগুলো ধাপে ধাপে পালন করলে ঘুমের সমস্যা সমাধান হবে।
এগুলোকে একসাথে Sleep Hygiene বা ঘুমের স্বাস্থ্যকর নিয়মনীতি’ বলে। এটার নিয়মগুলো তিনভাগে ভাগ করা যায়: ঘুমানোর পরিবেশ, করনীয়, যা করবেন না।
ঘুমানোর পরিবেশ:
ঘুমানোর জন্য নির্দিষ্ট বিছানা, অন্ধকার ঘর, নীরব পরিবেশ রাখবেন।
করনীয়:
১. প্রতিদিনের ঘুমাতে যাওয়ার এবং ঘুম থেকে উঠের নির্দিষ্ট সময় রাখবেন।
২. রাতে ঘুম আসতে দেরী হলেও সকালের নির্দিষ্ট সময় ঠিক রাখবেন।
৩. ঘুমানোর আগে এক গ্লাস হালকা গরম দুধ খেতে পারেন।
৪. রাতের খাবার ঘুমাতে যাওয়ার ২ ঘন্টা আগে খেয়ে নিবেন।
৫. বিছানা শুধুমাত্র ঘুম আর দাম্পত্য সম্পর্কের জন্য ব্যবহার করবেন।
৬. ঘুমাতে যাওয়ার আগে হাত মুখ হালকা গরম পানিতে ধুয়ে নেবেন অথবা একবার গোসল করে নেবেন।
৭. সারাদিনের চিন্তাগুলো বিছানায় যাওয়ার আগেই একটা চেয়ারে বসে করে নেবেন অথবা একটা ডায়রীতে লিখে নেবেন। পরের দিনের কর্ম পরিকল্পনাও লিখে রাখতে পারেন। এতে মস্তিষ্কের ভারটা হালকা করে ফেলতে পারবেন।
৮. প্রতিদিন সকালে অথবা বিকালের দিকে এক ঘন্টা হাঁটবেন অথবা ফ্রি হ্যান্ড ব্যায়াম করবেন।
৯. একেবারে ঘুম আসলে বিছানায় যাবেন
১০. শারীরীক কোন ব্যথাজনিত সমস্যার জন্য প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নেবেন।
যা করবেন না:
১. ঘুমাতে যাওয়ার ছয় ঘন্টা আগে চা/কফি/কোল্ড ড্রিংকস খাবেন না। এগুলো খেতে হলে ছয় ঘন্টার আগেই খেয়ে নেবেন।
২. রাতের ভারী খাবারের পরই শুতে যাবেন না।
৩. বিছানায় যাওয়ার বিশ মিনিটের মধ্যে ঘুম না এলে, বিছানায় সময় না গুনে উঠে হালকা পায়চারী করবেন/হাল্কা মেজাজে গান শুনবেন/বই পড়বেন।
৪. বিছানায় গল্প করা/টিভি দেখা/মোবাইল, কম্পিউটার ব্যবহার/পড়ালেখা করবেন না। এই কাজগুলো বিছানার বাইরে করবেন।
৫. ঘুমাতে যাওয়ার এক ঘন্টার মধ্যে ব্যায়াম/টিভি দেখা এগুলো করবেন না।
৬. দিনের বেলা ১ ঘন্টার বেশি ঘুমাবেন না।
এই নিয়মগুলো আপনি একটা একটা করে লক্ষ্য হিসেবে নিয়ে ক্যালেন্ডারে দাগ দিয়ে/ডায়রীতে লিখে চার-পাঁচদিন করে করে রুটিনে আনতে পারেন। এরপরেও কোন উপকার না হলে আপনার সরাসরি মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেখাতে হবে। ঘুমের ওষুধের মধ্যে বেশ কয়েকটি দীর্ঘদিন খেলে তাতে নির্ভরশীলতা হয়ে যায়। সেটা হঠাত বন্ধ করলেও আপনি সমস্যাবোধ করবেন। তাই, সেটা চালু অবস্থায় এবং সেটার নাম, মাত্রাসহ চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন।
আরেকটা বিষয়, আপনি যতটুকু লিখেছেন তাতে বুঝা গেল আপনি একজন আট বছরের বড় বাচ্চার মা। অভিভাবকত্বের সাথে সংসারের দায়িত্বও পালন করতে হয় এমন মায়েদের। দৈনন্দিন অনেক চাপের মধ্যে থাকেন। প্রতিদিন দশ মিনিট অন্তত আপনি গভীর ভাবে শ্বাসের মাধ্যমে শিথিলায়ন ব্যায়াম করতে পারেন। চাপ মোকাবেলার কৌশলগুলো এই ওয়েবসাইটের বিভিন্ন লেখায় বার বার আলোচনা হয়েছে, সেগুলো দেখতে পারেন।