যে ইচ্ছা আমাদের সবার মনেই প্রবলভাবে থাকে এবং যে ইচ্ছা সহজে পূরণও হয় তা হলো সন্তান লাভের ইচ্ছা। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া আমরা সবাই প্রায় বাবা-মা হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করি। সন্তান পাবার ইচ্ছা পূরণ সহজ হওয়ায় অনেক সময়ই আমরা এই প্রাপ্তির গুরুত্বকে উপলব্ধি করি না। নিঃসন্তান দম্পতির দীর্ঘশ্বাস আমাদের এই প্রাপ্তির গুরুত্ব জানিয়ে দেয়। এত সাধের পাওয়া সন্তানের লালন পালন নিয়ে আমরা কতটা সচেতন তা অবশ্যই ভেবে দেখা দরকার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সন্তানের যত্ন নেয়া, সন্তানকে শেখানো, তাকে কোনো কিছু করতে গাইড করা এ সবই ব্যক্তির জ্ঞান ও অভিরুচি এবং পরিবারের নিজস্ব সংস্কৃতি বা কালচারের উপর নির্ভর করে। তাদের কেউ কেউ অতিরিক্ত কড়া শাসনে বিশ্বাসী। আবার কেউ কেউ অতিরিক্ত উপদেশ নির্দেশ দিয়ে ছেলে মেয়েকে আদর্শ সন্তান হিসেবে গড়ে তুলতে চান। কেউবা অতিরিক্ত ছেড়ে দেন। শিশু যা চায় তাই দেন, যা করতে চায় তাই করতে দেন। অর্থাৎ শিশু অতিরিক্ত স্বাধীনতা ভোগ করে। নিজস্ব ধ্যান ধারণা ও বিশ্বাস থেকে যারা সন্তান লালন পালন করেন তারা সাধারণত নিজের আচরণের যুক্তি খোঁজেন না। নিরপেক্ষ ভাবে নিজের আচরণের প্রভাবকে বিশ্লেষণ করেন না। ফলে শিশু যখন অগ্রহণযোগ্য বা অসামাজিক আচরণ করে তখন চরম বিষ্ময়ে প্রশ্ন করেন, “এসব তুমি কার কাছে শিখেছো?”
মনে পড়ছে এক ভদ্রলোকের কথা। বেশ শিক্ষিত আর ভালো চাকুরে। তিন ছেলে আর এক মেয়ের বাবা। বড় ছেলেটির হিস্টিরিয়া হয়েছিল। হিস্টিরিয়ার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানতে পারলাম ভদ্রলোকের শিশু পালনের ব্যাপারে নিজস্ব একটা বিশ্বাস ছিল। আর তা হলো প্রথম সন্তানকে যদি কড়া শাসন করে সোজা পথে রাখা যায় তবে বাকী তিনজন তাকে অনুকরণ করেই সোজা পথে থাকবে। তাই তিনি শুধু প্রথম সন্তানকে কঠোর শাসনে রাখতেন। নিজের সব ইচ্ছা তার উপর আরোপ করতেন। তার বিশ্বাস ছিল, “আগের হাল যেদিকে যায় পেছনের হালও সেদিকে যায়”। তিনি একটুও ভাবেননি যে মানুষ ‘হাল’ নয় আর ট্রেনের প্রথম বগি যদি লাইনচ্যুত হয় তবে পেছনেরগুলোও কমবেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এই পরিবারটির ক্ষেত্রেও হয়েছিল তাই।
অনেক মা-বাবাই মনে করেন যে সন্তান যখন খুব ছোট থাকে কেবল তখনই শুধু তাদের ভালমতো যত্ন নিতে হয়, শিশুরা বড় হওয়ার সাথে সাথে বাবা-মায়ের দায়িত্ব একদম কমে যায়। আবার অনেকে মনে করেন সন্তান বড় হয়ে গেলেও তাদের সব দায়িত্ব মা-বাবার, তাদের ব্যাপারে সব সিদ্ধান্ত মা-বাবাই নেবেন। প্রকৃতপক্ষে ছেলে-মেয়ে পুরোপুরি পরিপক্ক না হওয়া পর্যন্ত মা-বাবাকে তাদের যত্ন নিতে হয়। এমনকি সন্তান যুবক/যুবতী হওয়ার পরও মা-বাবার অনেক দায়িত্ব থাকে। কিন্তু বিভিন্ন বয়সে এই যত্ন নেয়ার ধরণে অনেক পার্থক্য আছে। এক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে মনে রাখতে হবে যে সন্তানের যত্ন নেওয়ার মূলনীতি হলো সন্তানকে নির্ভরশীল অবস্থা থেকে আত্মনির্ভরশীল করে তোলা, সন্তানকে মা-বাবার উপর নির্ভরশীল করে না রাখা।
সফল মা-বাবা হওয়ার জন্য মা-বাবাকে অনেক দক্ষতার অধিকারী হতে হয়। তাই যেসব দক্ষতা ও তার অনুশীলন মা-বাবাকে ভালো মা-বাবা হিসেবে গড়ে তোলে, সেইসব দক্ষতা জানা প্রয়োজন। বেশ কিছু বিশেষ দক্ষতা সফল মা-বাবার মধ্যে দেখা যায়। যেমন-
বিশ্বাসের সম্পর্ক স্থাপন করা
মা-বা ও সন্তানের মধ্যে বিশ্বাসের সম্পর্ক থাকা অত্যন্ত জরুরি। সন্তানদের যদি মা-বাবার উপর বিশ্বাস না থাকে তবে সে তার মনোভাব, ভালোলাগা, আগ্রহ, কৌতুহল ও পছন্দ-অপছন্দের বিষয়গুলো মা-বাবার সাথে আলোচনা করে না। ফলে মা-বাবা তার নিজের সন্তানকেই বুঝতে পারে না। মা-বাবার প্রতি সন্তানের বিশ্বাস থাকা খুবই প্রয়োজন, তা না হলে মা-বাবা সন্তানকে অহেতুক সন্দেহ করেন, যা মা-বাবা ও সন্তানের মধ্যে সম্পর্ক রক্ষার জন্য মোটেই ভালো নয়।
বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক
মা-বাবার সাথে সন্তানের সম্পর্ক হবে বন্ধুত্বপূর্ণ। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বিশ্বাসের জন্ম দেয়, সুখে-দুঃখে একসাথে থাকার শক্তি জোগায়, মনের কথা বলতে উৎসাহ দেয় এবং এই সম্পর্কের ফলে একজন আরেকজনের উপস্থিতিকে উপভোগ করে।
মা-বাবার পারষ্পরিক সম্পর্ক
মা-বাবার মধ্যে শ্রদ্ধাপূর্ণ ভালোবাসার সম্পর্ক থাকা একান্তভাবে কাম্য। মা-বাবার একে অপরের প্রতি বিশ্বাস, শ্রদ্ধা, যত্ন করার মনোভাব এবং শারীরিক আকর্ষণ থাকতে হবে। এই চারটি উপাদানই পারে একজনের প্রতি আরেকজনের ভালোবাসা তৈরি করতে ও তা ধরে রাখতে। স্বামী-স্ত্রীর পরষ্পরের প্রতি ভালোবাসার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো একজন আরেকজনের প্রতি যত্ন ও শ্রদ্ধার মনোভাবের অধিকারী হওয়া।
সময় দেয়া
সন্তানকে সফল করে গড়ে তোলার জন্য তাকে সময় দেয়ার কোনো বিকল্প নেই। ব্যস্ততা সন্তানকে নিজের থেকে দূরে রাখার কোনো অজুহাত হতে পারে না। অনেক মা-বাবাই নিজেদের অনুপস্থিতিকে পূরণ করার জন্য সন্তানকে প্রয়োজনের অতিরিক্ত উপহার কিনে দেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে উপহার কখনোই মা-বাবার উপস্থিতিকে পূরণ করতে পারে না। আবার সবসময় সন্তানের সাথে থাকার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো তাকে মানসম্মত সময় দেয়া। অর্থাৎ সময় দেয়া বলতে মূলতঃ বোঝায় মানসম্মত বা ঠিকমতো সময় দেয়া। যতক্ষণ সন্তানের কাছে থাকা যায় সেই সময়টাকেই এমনভাবে ব্যবহার করতে হবে যাতে সেই সময়টিতে সন্তানরা মা-বাবার সাথে মিশতে পারে, মা-বাবার উপস্থিতিকে উপভোগ করতে পারে, নিরাপদ ও স্বস্তিবোধ করে, মা-বাবার ভালোবাসাকে অনুভব করতে পারে এবং আমরা যা শেখাতে চাই তা শিখতে পারে।
শান্তিপূর্ণ গৃহ পরিবেশ
সন্তানকে সফল করে গড়ে তোলার জন্য চাই শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ গৃহ পরিবেশ। গৃহ পরিবেশ বলতে সামাজিক ও শারীরিক দুই রকম পরিবেশকেই বোঝায়। বাড়ির আকার-আয়তন, সাজানো-গোছানো অর্থাৎ শারীরিক পরিবেশ যেমন গুরুত্বপূর্ণ একই ভাবে কথাবার্তা, একজনের সাথে অপরের সম্পর্ক অর্থাৎ সামাজিক পরিবেশও গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারে একটি প্রশংসার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে, যেখানে সবাই পাবে তার কাজের স্বীকৃতি ও প্রশংসা। এ ধরনের পরিবেশে থাকে বিশ্বাস, পারষ্পরিক নির্ভরশীলতা, একজন আরেকজনকে সাহায্য করার ইচ্ছা, সুখে-দুঃখে একজন আরেকজনের পাশে থাকা যা সবাইকে নিরাপত্তা দেয়।
আগামী পর্বে সমাপ্ত…
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।