যৌন সমস্যা কেন মানসিক স্বাস্থ্যের অংশ?

0
20

ডা. এসএম আতিকুর রহমান
সহযোগী অধ্যাপক, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ
মনোরোগবিদ্যা বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

মৌমিতার বিয়েতে আপত্তি ছিল। সবেমাত্র অনার্সে ভর্তি হয়েছে। বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরবে, আড্ডা দেবে, ক্যারিয়ার গড়বে। সেসব রেখে তড়িঘড়ি করে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে সে চায়নি। কিন্তু পাত্রপক্ষ অনড়। তারা বিয়ে করাবেই। যদিও সবাইকে সবার চেনা। হাসিবও মৌমিতাকে চাপ দিল বিয়ে করার জন্য। বাধ্য হয়ে মৌমিতাকে রাজি হতে হলো। দুই পরিবারের দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ধরে রাখতেই বিয়েটা হয়ে গেল।

হাসিবের মধ্যে কিছুটা অপরিপক্বতা ছিল। সেটা মৌমিতাকে জানত। বয়সে যদিও দুই বছরের বড় সে। তবুও মৌমিতা লক্ষ্য করেছে হাসিব অল্পতেই নার্ভাস হয়ে পড়ে, নিজের বিষয়গুলো ঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারে না। আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তাই বলে বুদ্ধি যে তার কম তা নয়। পড়াশোনায় সে বরাবরই ভালো।

ছোটবেলা থেকে ওরা একসঙ্গে মিশেছে। পরস্পরকে দেখার সুযোগ যথেষ্টই ছিল। হাসিবের ছেলেমানুষি আর গো ধরার বিষয়টা সে ক্ষমার চোখেই দেখে এসেছে। পড়াশোনা শেষ করার আগে বিয়ে করাতে হাসিবের একগুঁয়েমিও অনেকটা কাজ করেছে।

সেদিন কি সে একবারও ভেবেছিল তাদের জীবনে এমন একটা রাত্রি আসবে, যেদিন সে ছুরি হাতে হাসিবের বুকের ওপর চেপে বসবে তার বিশেষ অঙ্গটা কেটে ফেলার জন্য? সেদিন হুশ ফিরে এলে সে বুঝেছে কী ভয়ঙ্কর ঘটনাই না ঘটতে যাচ্ছিল। বিয়ের এক বছরের মাথায় এমন একটা ঘটনার হিসাব সে কিছুতেই মেলাতে পারেনি। তার বার বার মনে হয় সেদিন হাসিব তাকে ধর্ষণ না করলে সে তাকে আক্রমণ করে বসত না।

ধর্ষণের শিকার হওয়া নয়, গত ছয় মাসের মধ্যে সে দুই-দুইবার আত্মহত্যারও চেষ্টা করেছিল হাসিবের কারণে।
একটা সামান্য অজ্ঞতা কীভাবে জীবনকে জটিল করে তুলতে তুলতে এক সময় ভয়ঙ্কর অবস্থানে দাঁড় করায় তার উদাহরণ দিতে গিয়ে সম্প্রতি দেখা এক রোগীর কেস হিস্ট্রির আংশিক বর্ণনা দিলাম। নীতিগত কারণে এখানে রোগীর সত্যিকারের নাম-পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে।

সমস্যাটার সূচনা হয়েছিল বাসর রাতেই। দু’জনের মধ্যে আগে থেকেই পরিচয় থাকার কারণে ওই রাতেই তাদের মধ্যে দৈহিক সম্পর্ক হয়েছিল। হাসিবের পারফরম্যান্স ভালো ছিল না। শুধু সে রাতে নয়, পরবর্তীতে কোনো সময়ই হাসিবের পারফরম্যান্স আর সন্তোষজনক হয়নি। ডিফেন্স নিতে গিয়ে উল্টো সে মৌমিতাকেই দোষারোপ করতে থাকল।

বলতে শুরু করল মৌমিতারই শারীরিক চাহিদা বেশি যে কারণে সে তাকে সুখী করতে পারছে না। সম্পর্কটা সেদিন থেকেই ক্রমেই খারাপ হতে শুরু করল। তারপর একটা সময় এলো যখন সে মৌমিতাকে সন্দেহ করতে শুরু করল। মৌমিতার জীবন তাতে আরো বিষিয়ে উঠতে থাকল।

বিশ্ববিদ্যালয়ে সে অনিয়মিত ছাত্রী হয়ে গেল। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন সবার কাছ থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। আত্মহত্যার চেষ্টা করল, হলো না। ডিভোর্স নেবে কি নেবে না সিদ্ধান্তহীনতায় কাটছিল সময়টা। ঠিক তেমন একদিনে হাসিব মৌমিতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মৌমিতাকে দৈহিক প্রয়োজনে ব্যবহার করল।

সেসবের খুঁটিনাটি কিছুই মনে নেই তার। শুধু ছুরি নিয়ে সে যে হাসিবের বুকের ওপর বসেছিল, এতটুকুই মনে আছে তার। হাসিবের ধারণা মৌমিতা সাইকোপ্যাথ।

মৌমিতা আর নিতে পারছে না। সে কারণেই তার মানসিক বিশেষজ্ঞের কাছে আসা। অথচ এই আসাটা আরো অনেক আগেই সে আসতে পারত। দ্রুত বীর্যপাত যে পুরোপুরিই একটা মানসিক সমস্যা, সেটা অনেকের মতো তাদেরও জানা ছিল না। সমাজের বেশিরভাগ মানুষের মত্যে তাদেরও ধারণা, একমাত্র আচার-আচরণের অস্বাভাবিকতাই মানসিক রোগ।

অস্বাভাবিকতার প্রশ্ন যখন এলো তখন স্বাভাবিকতার কথাও বলতে হয়। মানুষের স্বাভাবিক যৌন আচরণ কী, সেই যৌন আচরণে তার আবেগ, চিন্তা, চেতনা, দৃষ্টিভঙ্গি কীভাবে ভূমিকা রাখে তা জানা না থাকলে যৌন সমস্যার সমাধান করা যায় না। আর সেসব জেনেই একজন চিকিৎসক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হন।

যদি শরীরকে একটি কম্পিউটারের হার্ডওয়্যার আর মনকে সফটওয়‍্যারের সঙ্গে তুলনা করেন, তাহলে বিষয়টা সহজেই বোধগম্য হবে। হার্ডওয়্যারের সবকিছু ঠিক থাকার পরও যেমন সফটওয়্যার ছাড়া একটি কম্পিউটার অচল তেমনি মন ছাড়া একটি সুস্থ- স্বাভাবিক দেহ অচল।

তাই বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যখন দেখা যায় রিপোর্টগুলো নরমাল বা স্বাভাবিক এসেছে তখন ঘাবড়ে না গিয়ে, রোগ ধরা পড়ে না, এমন না ভেবে বরং মানসিক কারণে হতে পারে চিন্তা করুন এবং মানসিক বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হোন।

এবার যে কেস হিস্ট্রি দিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম সেটার ব্যাখ্যা দেই। যৌন উত্তেজনা বেশি থাকলে সাধারণত পুরুষের ক্ষেত্রে বীর্যপাত দ্রুত হয়ে যায়। যাদের আবেগের ওপর ভালো নিয়ন্ত্রণ নেই তাদের ক্ষেত্রে উত্তেজনা বেশি থাকাটাই স্বাভাবিক।

হাসিবের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। যৌন বিষয়ে অজ্ঞতা এবং ব্যক্তিত্বের অপরিপক্বতার কারণে সে এটাকে সহজভাবে না নিয়ে বরং চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিল। ফলে পরবর্তী সময়েও সে পারফরম্যান্স অ্যাংজাইটিতে ভুগেছে। যা তার উত্তেজনাকে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করেছে।

মৌমিতার যৌন আকাঙ্ক্ষা বেশি বলে সে নিজের ব্যর্থতাকে র‍্যাশনালাইজ বা যৌক্তিক করার চেষ্টা করেছে। সে যদি জানত যে এ রকম হতে পারে এবং চ্যালেঞ্জ হিসেবে নেওয়াটাই তাকে আরো ক্ষতিগ্রস্ত করছে তাহলে তাদের জীবনটা এত জটিল হয়ে উঠত না।

মানসিক বিশেষজ্ঞের চিকিৎসা এবং পরামর্শে তাদের জীবনটা আরো অর্থময় ভালোবাসাপূর্ণ হয়ে উঠতে পারত। তাহলে যে কথাটা মনে রাখতে হবে তা হলো যৌন উদ্দীপনাতে প্রত্যাশা অনুরূপ সাড়া দিতে না পারাটাই সেক্সুয়াল ডিসফাংশন। আর সেই না পারার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে মন।

কারণ যৌন প্রতিক্রিয়া বা সেক্সুয়াল রেসপন্স শুধু শারীরিক প্রতিক্রিয়া নয়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, শতকরা ৪৩ ভাগ নারী এবং শতকরা ৩১ ভাগ পুরুষ সেক্সুয়াল ডিসফাংশন বা যৌন সমস্যায় ভোগে। মানুষের যৌন প্রতিক্রিয়ার চারটি পর্ব বা ধাপ আছে। ধাপগুলো হলো এক্সাইটমেন্ট, প্লাটো, অর্গাজম এবং রিসল্যুশন। এই ধাপগুলোর ওপর নির্ভর করে যৌন সমস্যাও চার ধরনের দেখা যায়।

এক্সাইটমেন্ট পর্বে ডিজায়ার ডিসওয়ার্ডার বা যৌন অনীহা, প্লেটো পর্বে অ্যারাউজ্যাল ডিসওয়ার্ডার বা উত্তেজনায় ব্যর্থতাজনিত সমস্যা, অর্গাজম পর্বে অর্গাজমিক ডিসওয়ার্ডার বা চরম পুলকে ব্যর্থতা এবং রেসল্যুশন পর্বে ব্যথাজনিত সমস্যা। যৌন অনীহা শব্দটা বলা মাত্রই এটা যে মনের সমস্যা তা আলাদা করে বলার দরকার হয় না। কোনো বিষয়ে ইচ্ছা বা আগ্রহ যে মনের ব্যাপার সেটা আমরা সবাই বুঝি।

উত্তেজনায় ব্যর্থতাজনিত সমস্যার সঙ্গে মনের সম্পর্কটা খেয়াল করুন। কোথায়, কোন অবস্থায়, কার সঙ্গে আমরা কতটুকু যৌন উদ্দীপনায় সাড়া দেব সেটা নির্ধারণ করে কিন্তু আমাদের মন।

আমি আমার এই লেখার এক জায়গায় মনকে সফটওয়‍্যারের সঙ্গে আর দেহকে হার্ডওয়‍্যারের সঙ্গে তুলনা করতে বলেছিলাম। সফটওয়‍্যার সাপোর্ট না করলে হার্ডওয়‍্যার ভালো থাকলেও প্রোগ্রামটা চলবে না। ঠিক তেমনিভাবে আমাদের সেক্সুয়াল প্রোগ্রামিংটাও তৈরি করা।

উপযুক্ত সঙ্গী, স্থান, সময় না মিললে আপনার মন আপনাকে যৌন উত্তেজনায় সমর্থন করবে না। ফলে আপনি যথাযথ উত্তেজিত হতে ব্যর্থ হবেন। আপনি সাময়িক সময়ের জন্য উত্তেজনামূলক ওষুধ খেতে পারেন। কিন্তু তাতে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হবে না। এবার আসি অর্গাজমিক ডিসওয়ার্ডারের ক্ষেত্রে। এখানে মনের ভূমিকাটা আরেকটু জটিল। আমাদের মধ্যে দুই ধরনের নার্ভাস সিস্টেম কাজ করে।

সিমপ্যাথেটিক এবং প্যারাসিমপ্যাথেটিক। বলা যায় এটা মনের শারীরবৃত্তীয় স্নায়ু রূপ। যৌন উত্তেজনার সঙ্গে এই সিমপ্যাথেটিক সিস্টেম জড়িত। গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের এই উত্তেজনা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি থাকে, তাদের দ্রুত বীর্যপাত হয়ে যায়।

আবার কারো কারো ক্ষেত্রে চরম পুলক বা অর্গাজম বাধাগ্রস্ত হয়। সম্পর্ক আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নারী-পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্কটি কেমন সেটাও কিন্তু সেজুয়াল ডিসফাংশন রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়। দু’জনের মধ্যে বিবদমান সম্পর্ক ভালো না থাকলে তাদের দৈহিক সম্পর্ক যে ভালো যাবে না সেটা বোঝার জন্য কোনো মেডিক্যাল নলেজের প্রয়োজন হয় না।

সাধারণ জ্ঞানেই সেটা বোঝা যায়। আর তাই সম্পর্কের অবস্থা বিবেচনা করে এই রোগ নির্ণয় করা হয়। একজন মানসিক বিশেষজ্ঞ ছাড়া আর কারো পক্ষে জটিল এই কাজটি করা সম্ভব নয়। আর তাই যৌন সমস্যা মানসিক স্বাস্থ্যের অংশ। এ সমস্যা দেখা দিলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।

Previous articleআমি ইন্ট্রোভার্ট- এজন্য কেউ কেউ বলে বলদ
Next articleযে কোনো কাজ করার আগেই অনেক ভয় এবং চাপ অনুভব করি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here