সমস্যা:
আমার নাম আবির। আমার বয়স ২০ বছর, থাকি ঢাকায়। বর্তমানে আমি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়াশুনা করছি। পরিবারে আমার বাবা মা ও দুই বোন আছে। আমার ছোটবেলা কেটেছে গ্রামের বাড়িতে। ছোটবেলা থেকেই আমি একটু চুপচাপ ও লাজুক প্রকৃতির। অন্যদের সাথে কথা কম বলি, ঘরেই বেশি সময় কাটাই। আমি অন্যদের মতো সাহসী নই। মোটকথা আমার আচরণ পুরোপুরি পুরুষালী নয়। যার কারণে আমি যখন হাইস্কুলের ছাত্র তখন বন্ধুরা আমাকে ডাকতো “হাফ লেডিস” বলে।
১১ বছর বয়সের সময় আমরা ঢাকা চলে আসি এবং ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই। সপ্তম শ্রেণিতে উঠে আতিক নামের একজনের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয়। ঢাকায় সেই ছিল আমার একমাত্র বন্ধু এবং আমার সব। ধীরে ধীরে তার প্রতি আমি নির্ভরশীল হয়ে পড়ি এবং তাকে না বলে কিছুই করিনা। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় যখন সবাই মেয়েদের দিকে আকৃষ্ট হয় তখন খেয়াল করি মেয়েদের প্রতি আমার কোনো আকর্ষণ নেই। আমার আকর্ষণ শুধু আতিকের প্রতি। এছাড়াও অন্যান্য স্মার্ট ছেলে দেখলেও আকর্ষণ বোধ করি। এটা শুধু মানসিক ভাবে নয় বরং সেক্সুয়ালিও আমি তার প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকি। আমার অন্যান্য বন্ধুদের গার্লফ্রেন্ডের প্রতি যেমন ফিলিংস থাকে আমারও আতিকের প্রতি তেমন ফিলিংস কাজ করতে থাকে।
স্বাভাবিক ভাবেই ব্যাপারটি আমি গোপন রাখি এবং আতিকের সাথে শুধু বন্ধুসূলভ আচরণ করতে থাকি। এবং বুঝতে পারি আমি আতিকের প্রতি যেমনটা ফিল করি আতিক তেমনটা করে না। যেহেতু আতিককে আমি বিশেষ কেউ ভাবি সেহেতু আশা করি আতিক আমার দিকে বেশি এটেনশন দিক। যেহেতু আতিক সমকামী নয় তাই তাকে আমি কখনও আমার মতো করে পাই না। এমনকি তার সাথে আমি যৌন সম্পর্কে আগ্রহী হলেও আতিক সে ব্যাপারে আগ্রহী হয় না।
প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ার কারণে ধীরে ধীরে আমার মধ্যে বিষণ্নতা আসে। এসএসসি পাশের পর আতিক আর আমি ভিন্ন কলেজে ভর্তি হওয়ার কারণে ধীরে ধীরে আতিকের সাথে আমার যোগাযোগ কমতে থাকে। আগে যেখানে দিনে ৪/৫ ঘন্টা কথা হতো সেটি মাসে ৪/৫ বারে নেমে আসে।
২০১৪ সালে আমাদের এইচএসসি চলাকালীন সময় সামান্য কথা নিয়ে আতিক রেগে যায় এবং আমার সাথে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এরপর আমি অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু আতিকের সাথে আর আগের সম্পর্কে ফিরে যেতে পারিনি। আতিকের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হওয়া থেকে আমার কাছে জীবনটা অন্ধকার হয়ে যায়, সবসময় শুধু আতিকের কথা চিন্তা করি। স্বাভাবিক জীবনযাপন করা এতটা কঠিন হয়ে পড়ে যে ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।
২০১৫ এর ফেব্রুয়ারি মাসে আমরা আমাদের বাসা পরিবর্তন করি। সেখানে তুষার নামের এক প্রতিবেশীর সাথে পরিচয় হয়। সে আমার থেকে দুই বছরের ছোট হলেও আমার সাথে তার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং সে দেখতেও অনেক সুদনর্শন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় আমরা ঘুরতে বের হতাম ক্যারাম খেলতাম। ধীরে ধীরে আমারা বেশ ভালো বন্ধু হয়ে উঠি এবং খেয়াল করি আমার বিষণ্নতা কমে যাচ্ছে।
কয়েক মাস পর বুঝতে পারি তুষারকে আমি ভালোবেসে ফেলেছি। কিন্তু তুষার সমকামী নয়, সুতরাং তার কাছে আমি একজন প্রতিবেশি বড়ভাই মাত্র। কিন্তু এদিকে আমার এমন অবস্থা হয় যে তুষারকে ছাড়া আমি এক মুহুর্তও থাকতে পারি না। এখন আর আতিকের জন্য কোনো ফিলিংস কাজ করেনা আমার, আমার চিন্তার দুনিয়ায় এখন শুধু তুষার। কিন্তু এটা জানি তুষার আমার জন্য ঠিক সেভাবে ফিল করে না। এবং এখন সে আমার সাথে মিশতে চায় না। যার কারণে আমার মধ্যে আগের মতো আবার বিষণ্নতা আসতে থাকে। জীবনটা এত অসুখী ও কষ্টের মনে হয় যে তা বলে প্রকাশ করতে পারছি না।
এই প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার দূরত্ব আমার জীনটা দূর্বিসহ করে তুলেছে। আমি সমকামী হয়ে থাকতে চাই না, আর সবার মতো সুখী সাধারণ জীবন চাই। মানসিক শান্তি চাই। এরজন্য আমি কি করতে পারি, অনুগ্রহ করে পরামর্শ দিবেন।
পরামর্শ:
তোমার দীর্ঘ লেখা পড়লাম। পুরো লেখাটা ভালো করে বিশ্লেষণ করলে, তোমার দুটো সমস্যা বের করা যায়। এক, ছোট কাল থেকে তুমি একা থাকতে পছন্দ কর। নিজেকে নিয়েই তোমার বেশিরভাগ সময় কাটে এবং সেটা তুমি পছন্দ কর। অন্য অনেকের মতো তুমি বাইরে আমোদ ফুর্তি না করে ঘরে সময় কাটাতেই পছন্দ কর। বিষয়টি বোঝাতে গিয়ে লিখেছ, তুমি কথনোই পুরুষালী না। অন্যদিকে দ্বিতীয় যে সমস্যাটির কথা তুমি উল্লেখ করেছো সেটিকে যৌন বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয়, প্রোব্লেম অব অরিয়েন্টেশন (orientation problem)। আরো স্পষ্ট করে বললে বলা হয়, যৌন আকর্ষণের সমস্যা। এটি একটি দীর্ঘ এবং বিতর্কিত সমস্যা।
তোমার দুটি সমস্যার সমাধান বা চিকিৎসা সম্পূর্ণ আলাদা। একটি, অর্থাৎ প্রথমটির জন্য তোমার ব্যক্তিত্বের গঠন এবং গড়ে ওঠা ব্যক্তিত্ব নিয়ে কাজ করতে হবে। অন্যদিকে যৌনাকর্ষণের বিষয়টি নিয়ে অন্য ভাবে কাজ করতে হবে। তবে, দুটো সমস্যার সঠিক কারণ নিরুপন এবং ধরন বের করার জন্য কিছু প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা করে নিতে হবে। বিশেষ করে, থাইরয়েড এবং সেক্স হরমোন দেখে নেয়া অত্যন্ত জরুরি।
ব্যক্তিত্বের গঠন নিয়ে কিছু বলতে গেলে বলতে হয় সব মানুষের ব্যক্তিত্বের গঠন এবং প্রকাশ এক রকম হবে এমন কোনো কথা নেই। বিভিন্ন মানুষের গঠন ও প্রকাশ বিভিন্ন রকম হয়। অন্যের সাথে তুলনা না করে নিজের ব্যক্তিত্বের দিকগুলো ভালো করে বুঝে নিয়ে সেই মতো কাজ করলেই ভালো হয়। দুঃশ্চিন্তা মুক্ত থাকা যায়। তারপরেও অস্থিরতা কমানোর জন্য আরো কিছু পদ্ধতি আছে, যেসব সামনা সামনি আলোচনা করে ঠিক করে নেয়া দরকার। অন্যদিকে স্বলিংগের প্রতি যৌনাকর্ষণের বিষয়টি সাধারনত দুটি কারণে হয়ে থাকে। প্রথমতো, কারণহীন বা সরাসরি কোনো কারণ এখনো্ আবিষ্কৃত নয়। দ্বিতীয়ত, এক ধরনের ভুল চর্চার ভিতর দিয়ে এ অভ্যাসটি গড়ে উঠে। ভুল চর্চার বিষয়টি সঠিক ভাবে নিরুপন করতে পারলে সেটি দূর করা সহজ। তবে যেখানে কারণ পাওয়া যায়না, সেক্ষেত্রে সতর্কতার সাথে আগানো উচিত।
আমি তোমাকে অনুরোধ করব বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগে যোগাযোগ করার জন্য। যেখানে তুমি দুটি বিষয়েই চিকিৎসা নিতে পারবে। ‘সাইকিয়াট্রিক সেক্স ক্লিনিক’ নামে বিশেষ একটি সেবা সেখানে চালু আছে। প্রতি সোমবার সেটি হয়ে থাকে। তুমি সেখানে যোগাযোগ কর, তোমার জন্য সেটাই ভালো হবে।
পরামর্শ দিচ্ছেন,