মানসিক স্বাস্থ্য স্বাক্ষরতা

আমাদের দেশে স্বাক্ষরতা বলতে নিজের নাম লিখতে পারা বোঝানো হলেও বস্তুত স্বাক্ষরতার সংজ্ঞায় রয়েছে নানান হেরফের। রয়েছে নানান যুক্তি পালটা যুক্তি। অনেক সমাজবিজ্ঞানী আবার স্বাক্ষরতা বিষয়টিকে সামাজিক বৈষম্যের একটি ছদ্মবেশী হাতিয়ার বলেছেন। UNESCO এর সংজ্ঞানুযায়ী, ব্যক্তি কোনো বিষয়বস্তু সম্পর্কে লিখিত মাধ্যমে/মাধ্যম হতে (Document) জানানো বা নিজে  জানা, বোঝা, ধারণা পাওয়াকে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে আরো বলা হয়েছে, স্বাক্ষরতা একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে ব্যক্তি তার অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারেন এবং জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে তিনি সমাজে স্বক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারেন। UNICEF এর সংজ্ঞানুযায়ী, পড়তে ও লিখতে পারাকেই স্বাক্ষরতা বলা হয়েছে। অন্যান্য সংজ্ঞা গুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, গড়পড়তায় কোনো বিষয় সম্পর্কে পড়ে তা বুঝতে পারা এবং সাথে সাথে নিজের বক্তব্য লিখিত মাধ্যমে প্রকাশের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ সাধন তথা সমাজে অংশগ্রহণ করাকেই স্বাক্ষরতা বলে। স্বাক্ষরতার নানা ধরন রয়েছে। তবে চিকিসাবিজ্ঞানে মূলত স্বাক্ষরতা বলতে শারীরিক স্বাস্থ্য স্বাক্ষরতা ও মানসিক স্বাস্থ্য স্বাক্ষরতাকেই বোঝানো হয়। এক্ষেত্রে Literacy বা স্বাক্ষরতার সাথে কিছুটা পার্থক্যও রয়েছে। এ লেখায় মূলতঃ মানসিক স্বাস্থ্য স্বাক্ষরতা সম্পর্কিত প্রাথমিক ধারণা দেয়াই মূল লক্ষ্য। মানসিক স্বাস্থ্য স্বাক্ষরতা সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে, আমরা সামগ্রিক স্বাস্থ্য বিষয়ক স্বাক্ষরতার বিরাজমান একটি অতি ক্ষুদ্র কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ দিক বিশ্লেষণ করব।
বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ে স্বাস্থ্য সম্পর্কে ছাত্র ছাত্রীদের কি কি পাঠদান বা তথ্য দেয়া হয়, সে বিষয়ে আমি বিষদভাবে পর্যবেক্ষণ করার অভিপ্রায়ে প্রাথমিক বিজ্ঞান বইটিকে প্রাথমিক তথ্য (Primary Data) হিসেবে নির্ধারণ করি।  এতে দেখা যায়, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত প্রাথমিক বিজ্ঞান বইটি মূলত প্রণীত হয়েছে তৃতীয় শ্রেণী হতে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত। অর্থাৎ ০৭ বছর থেকে ০৯ বছরের শিশুদের জন্য।  আর স্বাস্থ্য সম্পর্কে স্বাস্থ্যবিধি অধ্যায়টিতে নানান দিক তুলে ধরা হয়েছে। তৃতীয় শ্রেণীর প্রাথমিক বিজ্ঞান বইয়ের স্বাস্থ্যবিধি অধ্যায়ে, স্বাস্থ্য ও রোগের ধারণা দেয়া হয়ছে। সাথে সাথে দেহ সুস্থ রাখার নানান দিক যেমনঃ পরিচ্ছন্ন থাকা, হাত ধোয়া, পানি ব্যবহার করা ও পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার বিষয় উল্লেখ করা হয়ছে। রয়েছে কিছু ছবি যার মাধ্যমে শিক্ষার্থী বিষয়বস্তু সম্পর্কে ধারণাটা আর ভালো ভাবে পেতে পারে। তবে ০৫ পৃষ্ঠার এ অধ্যায়টিতে দু অক্ষরের মন শব্দটি খুজে পাওয়া যাইনি। চতুর্থ  শ্রেণীর স্বাস্থ্যবিধি অধ্যায়ে সুস্থ জীবন যাপন ও পানি বাহিত রোগ ও রোগের প্রতিকার সম্পর্কে বলা হয়ছে। আর পঞ্চম শ্রেণীর স্বাস্থ্যবিধি অধ্যায়ে সংক্রামক রোগ বলতে কি বোঝায়, কিভাবে বিস্তার লাভ করে, প্রকারভেদ, প্রতিকার ও প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়ছে। আর এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয় অর্থাৎ মন বা মন বিষয়ক কোনো শব্দ বা বাক্য নেই কোনো পৃষ্ঠায়। সুতরাং বলা চলে বাংলাদেশের প্রাথমিক স্তরের বিজ্ঞান পাঠ্য পুস্তকের স্বাস্থ্যবিধি অধ্যায়ের আলোচ্য বিষয়বস্তু শারীরিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রিক।
উপরোক্ত প্রেক্ষাপটে তাই মানসিক স্বাস্থ্য স্বাক্ষরতা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।  মানসিক স্বাস্থ্য স্বাক্ষরতা র  মাধ্যমে একজন ব্যক্তি , মানসিক রোগের প্রাথমিক লক্ষণ সনাক্ত করতে পারেন, রোগের জন্য কোথায় কার কাছে যেতে হবে সে ধারণা রাখেন, রোগ প্রতিরোধ বিষয়ক সম্যক ধারণা রাখেন ”। অনেক গবেষক আবার মানসিক স্বাস্থ্য স্বাক্ষরতার সংজ্ঞার ক্ষেত্রে উপরোক্ত বিষয়াবলীর সাথে সাথে  সামাজিক নেতিবাচক ধারণা (Stigma) নির্মূলের দক্ষতাও অন্তর্ভুক্ত করেছেন। মানসিক স্বাস্থ্য স্বাক্ষরতায় অন্তর্ভুক্ত বিষয়াবলীর মধ্যেঃ মন কি, মানসিক স্বাস্থ্য কি, মানসিক সমস্যা বা রোগ কি, কিভাবে মানসিক সমস্যা বা রোগের উদ্ভব হয়, মানসিক সমস্যা বা রোগের লক্ষণ গুলো কি কি,  কিভাবে মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখা যায়,  কোন বিষয়গুলো মানসিক স্বাস্থ্যকে ঝুকির মধ্যে ফেলে, কোন বিষয়টি মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, সমস্যা বা রোগ হলে জরুরি ভিত্তিতে কি মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা নেয়া যায় এবং কোথায় কোন সংশ্লিষ্ট পেশাজীবির কাছে পরামর্শের জন্য যেতে হবে ইত্যাদি বিষয় উল্লেখযোগ্য। উন্নত দেশগুলোর সংশ্লিষ্ট পেশাজীবিগণ গবেষনার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য স্বাক্ষরতা নির্ণয় করেন। আর গবেষণা কর্মে তারা প্রচলিত অনেক ধরনের প্রশ্নমালা ব্যবহার করে থাকেন। এ প্রশ্নমালা গুলোর মাধ্যমে মানসিক রোগ যেমনঃ সিজোফ্রেনিয়া, বিষণ্নতা, ম্যানিয়া, উদ্বেগজনিত রোগ, এ ডি এইচ ডি (ADHD) ইত্যাদি সম্পর্কে মানুষের ধারণা আছে কিনা তা জানা যায়।
এ বছরের মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে সবার জন্য প্রাথমিক মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা (Psychological and Mental Health First Aid For All)। এ লক্ষ্যে পৌঁছানোর একমাত্র ভিত্তি হলো, মানসিক স্বাস্থ্য স্বাক্ষরতার (MENTAL HEALTH LITERACY) হার বাড়ানো। আর এক্ষেত্রে অন্যান্য নানা জনসচেতনামূলক কর্মকান্ডের পাশাপাশি প্রাথমিক স্তরের বিজ্ঞান পাঠ্যপুস্তকে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক উপরোক্ত বিষয়গুলো (মন, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, মনোরোগ, প্রতিরোধ ও প্রতিকার) অন্তর্ভুক্তি করণ একটি মৌলিক এবং জরুরি বিষয়। সংশ্লিষ্ট নীতি নির্ধারক মহল অর্থাৎ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের একটি ছোট্ট সিদ্ধান্ত হয়তো বাংলাদেশের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতায় আমূল পরিবর্তন করে দিতে পারে। প্রয়োজন এখন দ্রুত উদ্যোগ গ্রহণ। আশা করি অদূর ভবিষ্যতে মনোরোগবিদ, মনস্তত্ত্ববিদ ও অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্য কর্মীদের সমন্বিত প্রচেষ্টা এ উদ্যোগকে সাফল্যমন্ডিত করবে। তখন হয়তো শিশু, কিশোর, যুবা কিংবা বৃদ্ধ সকল বয়সের মানুষ বুঝতে শিখবেন, স্বাস্থ্য বলতে শরীর ও মনের একসাথে হাতে হাত ধরে হাঁটাকেই বোঝায়।  


প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।

Previous articleবাস্তবতা মেনে নিয়ে চলতে পারাটাই ভালো থাকা: ফুটবলার কায়সার হামিদ
Next articleরঙের ছোঁয়ায় মন আঁকি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here