কোভিড পরবর্তী মানসিক সমস্যা: করণীয়

কোভিড পরবর্তী মানসিক সমস্যা: করণীয়

মহামারি কিংবা অতিমারি যে নামেই আখ্যায়িত করুন না কেন বিশ্বব্যাপী করোনা এখন এক ভয়াল আতঙ্ক। দ্বিতীয় দফা করোনার ঢেউ ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বের এপ্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে। করোনার কারণে সবাই আতঙ্কিত শারীরিক স্বাস্থ্য আর অর্থনৈতিক বিপর্যয় নিয়ে। কিন্তু এ মহামারি মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও খুব নীরবে প্রভাব ফেলে চলছে।

এ বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে এখন থেকেই। কারণ আমরা যদি অতীতের দিকে দৃষ্টি দেই তাহলে দেখতে পাব যেকোনো মহামারি পরবর্তী সময়ে মানসিক স্বাস্থ্যেরও ব্যাপক বিপর্যয় ঘটে। স্প্যানিশ ফ্লু (১৯১৮-১৯২০) মহামারি শেষে মানসিক রোগীদের অ্যাসাইলামে ভর্তি ও আত্মহত্যার হার বেড়ে গিয়েছিল অনেক বেশি। বর্তমানে কোভিড-১৯ বিপর্যয় এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঝুঁকিগুলো মানুষের প্রতিদিনের জীবনের স্বাভাবিক ছন্দকে ব্যাহত করছে, ভঙ্গুর করে দিচ্ছে তাদের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে।

ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের স্কুল অব মেডিসিনের সাইকিয়াট্রির অধ্যাপক Teodor Postolache এ
বিষয়ে বলেছেন, কোভিড আক্রান্ত ৩০-৫০% লোক কোভিড থেকে সেরে ওঠার পর কোনো না কোনো মানসিক সমস্যার ঝুঁকিতে পড়ছেন। পড়াশোনা কিংবা কর্মক্ষেত্রে অমনোযোগিতা, ঘুমের সমস্যা থেকে শুরু করে উদ্বেগ, বিষণ্ণতা, সাইকোসিস, কোগনিটিভ বৈকল্য-যেকোনো কিছু হতে পারে।

শুধু মানসিক নয় নিউরোলজিক্যাল সমস্যাও প্রকট হয়ে উঠছে। জিনগত প্রভাবের পাশাপাশি মানসিক চাপের মাত্রা বা ধরন যা কিনা ব্যক্তি বিশেষের ব্রেইনের নিউরাল সিগনালের গঠনকে পরিবর্তন করে দিতে পারে। পর্যালোচনায় দেখা যায় মহামারির পরবর্তী মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যয় বিভিন্নভাবে আসতে পারে। যেমন:

  • যারা আগে থেকেই গুরুতর মানসিক রোগের জন্য ঝুঁকিপর্ণূ অথবা আগে থেকেই মানসিক রোগে ভুগছেন তাদের ক্ষেত্রে তীব্রতা বেড়ে যাওয়া।
  • মানসিক চাপ বা আঘাতজনিত কারণে সমস্যা তৈরি হওয়া-অ্যাকিউট স্ট্রেস ডিজঅর্ডার, পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার অথবা অ্যাডজাস্টমেন্ট ডিজঅর্ডার।
  • স্ট্রেস ডিজঅর্ডারের মতো রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়া। কোভিড পরবর্তী মানসিক সমস্যা তাৎক্ষণিক অথবা দীর্ঘমেয়াদি এবং বিলম্বে শুরু হতে পারে।

কী কী লক্ষণ দেখা যায়?
যাদের চিকিৎসা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র পর্যন্ত গড়িয়েছে তারা তো বটেই আবার খুব অল্প লক্ষণ, অর্থাৎ হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়নি এমন মানুষরাও করোনা পরবর্তী মানসিক সমস্যায় অল্প-বিস্তর ভুগছেন। করোনা থেকে সেরে ওঠা প্রতি তিনজনে একজন কোনো না কোনো মানসিক কিংবা স্নায়বিক সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন। মাংসপেশির অতিরিক্ত দুর্বলতার কারণে স্বাভাবিকভাবে হাঁটা সম্ভব নাও হতে পারে। কথা শুরু করে খেই হারিয়ে ফেলা, প্রয়োজনীয় শব্দ গুছিয়ে আনতে না পারা, স্মৃতির সমস্যা ইত্যাদি।

করোনা পরবর্তী সাধারণ দুর্বলতাটি সময়ের সাথে ধরন পাল্টে মাথা ব্যথা, মাথা ঘুরানো, খবারের স্বাদ-গন্ধ হারিয়ে ফেলা থেকে শুরু করে গুরুতর মানসিক রোগে রূপান্তরিত হতে পারে। এছাড়াও দেখা যায় কোভিড ফগ কিংবা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অসাড় লাগা। রোগীর ভাষায় শুনি-“যখন করোনা হয়েছিল তখন আমার শ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হতো। আর এখন করোনার জীবাণুুমুক্ত হওয়ার পর আমি ঠিকমতো চিন্তা করতে পারি না, মনোযোগ দিতে পারি না, অল্পতেই ধৈর্যচ্যুতি ঘটে।”

মানসিক সমস্যায় আক্রান্তদের মধ্যে প্রায় পঞ্চাশ শতাংশর মধ্যে গুরুতর বিষণ্ণতার লক্ষণ এবং পয়ঁত্রিশ শতাংশের মধ্যে উদ্বেগের লক্ষণ আছে।

উদ্বেগ
অতিরিক্ত ভয়, বাইরে থেকে বিপদের আশঙ্কা, প্যানিক অ্যাটাক, নির্দিষ্ট জায়গা অথবা পরিস্থিতি এড়িয়ে চলার প্রবণতা, অস্থিরতা, বুক ধড়ফড়, অতিরিক্ত ঘামানো, খিটখিটে মেজাজ ইত্যাদি। শুচিবাই-সংক্রামক রোগ থেকে বাঁচার জন্য বারবার হাত ধোয়া, অতিরিক্ত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার চর্চা মহামারি শেষে শুচিবাই রোগে পরিণত হতে পারে। আর যাদের আগে থেকে আছে তাদেরও মাত্রা বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে।

বিষণ্ণতা
মন খারাপ, খাবারের রুচির পরিবর্তন, ঘুমের সমস্যা, যৌন চাহিদা কমে যাওয়া, নিরাশা, সহায়হীন বোধ করা, অসন্তুষ্টি, আত্মহত্যার চিন্তা ইত্যাদি দেখা গিয়েছে।

ম্যানিয়া
যাদের আগে থেকে বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার আছে তারা এ সময় অতি আত্মবিশ্বাসে বেপরোয়া হয়ে উঠতে পারেন যা তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে এবং সামাজিক  ‍দূরত্বের নিয়মকানুন না মানার কারণে অন্যদেরও করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

স্কিজোফ্রেনিয়া
এ রোগীদের ভেতর-বাহির দু-জগতেই করোনা চলাকালীন এবং পরে বিভিন্ন লক্ষণ যেমন-সন্দেহ প্রবণতা, হ্যালুসিনেশন এমনকি অন্যদের থেকে বিছিন্ন হয়ে যাওয়ার লক্ষণ বেড়ে গিয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ হয়ে বেড়ে যাচ্ছে মাদকের অতিরিক্ত ব্যবহার।

স্বাস্থ্যকর্মীরা আছেন বাড়তি ঝুঁকিতে
সাধারণ মানুষ তো বটেই বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যকর্মীরা কম নয় বরং আরো বেশি চাপে আছেন। রোগীদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, অপ্রতুল চিকিৎসা সরঞ্জাম দিয়ে অধিক সংখ্যক রোগীর মধ্যে সুষম বণ্টন করতে গিয়ে হিমশিম খাওয়া, সিদ্ধান্ত গ্রহণের জটিলতা, অতিরিক্ত চাপ নিয়ে কাজ করা, কাজের জায়গা পরিবর্তন, পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে সম্পর্ক সঠিকভাবে বজায় রাখা, পাশাপাশি নিজের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের মধ্যে সমন্বয় করা-এতসব বিষয়ে ভারসাম্য রাখতে গিয়ে একজন স্বাস্থ্যকর্মী মানসিক এবং নৈতিকভাবেও বিপর্যস্ত হতে পারেন। এছাড়াও আমাদের দেশে চিকিৎসকরা সামাজিক স্টিগমার শিকারও হয়েছেন। চীনের চৌত্রিশটি হাসপাতালের ১২৫৭ জন চিকিৎসা কর্মীর, বিশেষ করে ফ্রন্টলাইনে কর্মরত নারী ও সেবিকাদের ওপর গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্য তাই সমর্থন করে।

কী করণীয়?
কে কতদিনে সেরে উঠবেন এ বিষয়টি এখনো অজানা। তবে অন্যান্য ভাইরাসজনিত মহামারি পরবর্তী স্নায়বিক জটিলতার ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে এসব সমস্যা আঠারো মাসের অধিক সময় থাকতে পারে। তাই কালক্ষেপণ না করে মানসিক সমস্যায় আক্রান্তদের সঠিকভাবে চিহ্নিতকরণ ও তাদের যথাযথ মানসিক চিকিৎসা সেবার আওতায় আনা প্রয়োজন। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার পর তাদের মানসিক স্বাস্থ্য পর্যবেক্ষণে রাখা যেতে পারে। যাদের করোনা হচ্ছে তাদের সম্ভাব্য মানসিক এবং স্নায়বিক জটিলতা সম্পর্কে আক্রান্ত এবং পরিবারের সদস্যদের প্রাথমিক ধারণা ও করণীয় দিয়ে রাখা যেতে পারে।

নিজের এবং অন্যদের যত্ন
এ সময়ে কিছু পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আমরা চাইলেও তার সমাধান করতে পারব না। কিন্তু কিছু বিষয় চাইলেই আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। অন্তত করোনা পরবর্তী মানসিক জটিলতা প্রতিরোধের চেষ্টা করা যায়। যেমন:

  • পত্রিকা, টিভিতে খবর প্রথমে কম করে দেখবেন এবং সময়ের সঙ্গে ধীরে ধীরে তা বাড়াবেন। যেমন ফেসবুকসহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতিদিনের ব্যবহার সীমিত করা, দুঃখজনক ঘটনা নিয়ে বারবার বিভিন্ন জনের সাথে আলোচনা না করা। মোট কথা তথ্যের ভারে ভারাক্রান্ত না হয়ে শুধু প্রয়োজনীয় তথ্যটকু মাথায় রাখুন।
  • তাদের সঙ্গে আমরা থাকব তবে আস্তে আস্তে করোনা পূর্ববর্তী সময়ের মতো নিজেদের কাজ নিজেরা করার চর্চা বাড়াবেন।
  • মানসিক সহায়তাদানকারী সাহায্য সংস্থাগুলোর সঙ্গে তাদের যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারি।
  • শারীরিক যত্ন ও মানসিক সমস্যার কথা মাথায় রেখে তাদের প্রাত্যহিক কাজের রুটিন নতুন করে করা যেতে পারে।
  • তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা বিষয়ে সহায়তা এবং আশ্বাস প্রদান।
  • পূর্বের কোনো মানসিক রোগের লক্ষণ বেড়ে যাচ্ছে কিনা কিংবা নতুন করে কোনো ধরনের মানসিক সমস্যার উদ্ভব হচ্ছে কিনা তা খেয়াল রাখা। আত্মহত্যার ঝুঁকিও মাথায় রাখা জরুরি। এরকম কোনো সমস্যা দেখা দিলে সাইকিয়াট্রিস্টের শরণাপন্ন হতে হবে। প্রয়োজনীয় ওষুধ এবং সাইকোথেরাপির সহায়তা নিতে হবে।
  • প্রয়োজনে অর্থনৈতিক সাহায্য, পারিবারিক কাজ, পড়াশোনা বা কাজের জায়গায় সাহায্য দেয়া।
  • নতুন কোনো শখের কাজে করতে চাইলে উৎসাহ প্রদান।
  • জরুরিভিত্তিতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া যায় এমন প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা অথবা হটলাইনের সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে পারেন।
  • নিজের ভেতরের উদ্বেগ, বিষণ্ণতা বা চাপ নিজে মোকাবিলা করতে না পারলে প্রফেশনালদের সাহায্য নিতে হবে। বাইরে যাওয়া সম্ভব না হলে বিকল্প হিসেবে টেলি সাইকিয়াট্রির সাহায্যও নেয়া যায়।

এছাড়াও নিজের শরীরের যত্ন নেয়া জরুরি। আগে থেকে কোনো অসুখ থাকলে তার চিকিৎসা চালিয়ে নিন। প্রতিদিন কিছু শারীরিক ব্যায়াম করুন। খাবার, ঘুম ও দৈনন্দিন কাজের রুটিন মেনে চলুন। পরস্পরের সঙ্গে ফোন, ভিডিও কলের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করুন।

হতাশা, উদ্বেগ বা মানসিক চাপ কমাতে অ্যালকোহল বা অন্য কোনো মাদক দ্রব্যের সাহায্য নেয়া থেকে বিরত থাকনু। প্রয়োজনে উদ্বেগ কমাতে শিথিলায়নের (রিলাক্সেশন থেরাপি) চর্চা করতে পারি। ডায়েরি লেখা, যে যার ধর্মমতে প্রার্থনা করতে পারেন।

মনে রাখবেন করোনা পরবর্তী মানসিক চাপে আপনি একাই ভুগছেন না, আপনার সাথে সারা বিশ্বে অসংখ্য মানুষও ঠিক এ মুহূর্তে উদ্বেগ, বিষণ্ণতা অথবা পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারের সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছেন। তবে আশার কথা হচ্ছে একসময় এ সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠে জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে পাচ্ছে বেশিরভাগ আক্রান্ত। প্রয়োজন দ্রুততম সময়ে সঠিক পদক্ষেপ/চিকিৎসা। করোনা মহামারি কবে পৃথিবী থেকে বিদায় নেবে তা যেমন অনিশ্চিত তেমনি করোনাত্তোর পৃথিবীতে মানসিক বিপর্যয়ের সঠিক চিত্র পেতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে আরো অনেক দিন।

সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

Previous articleকরোনা মহামারীর এই দুঃসময়ে আধ্যাত্মিকতা আনতে পারে মানসিক শান্তি
Next articleআমি কি মানসিক ভাবে বিকারগ্রস্থ?
ডা. শাহানা পারভীন
সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here