মানসিক রোগ নিয়ে ধারণা, ভুল ধারণা এবং বিবিধ  (পর্ব –৮)

একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে অনেক দিন পর দেখা একজন দূরসম্পর্কের কাকার সাথে। আগের মতই উচ্ছ্বল আর আন্তরিক তিনি। একথা সেকথার পরেই জানতে চাইলেন কি করছি, এখন কোথায় আছি এইসব।
–  আমি সাইকিয়াট্রিতে এম,ডি কোর্সে পড়ছি।
– ডাক্তারি ছেড়ে আর্টসের সাবজেক্টে চলে গেলে!
প্রথমে বুঝতে অসুবিধা হলেও পরে বুঝলাম এবং বললাম,
– না কাকা, সাইকোলজিটা আর্টসের সাবজেক্ট। আমিতো সাইকিয়াট্রি মানে মনোরোগ নিয়ে পড়ছি।
এরপর ছোটখাটো একটা আলোচনা হয়ে গেল সাইকিয়াট্রি সম্পর্কে। আলোচনা শেষে তাঁর মন্তব্য:
– তোমাদের তো আবার সরকারই ঠিক করে দেয়, কে কোন সাবজেক্ট পড়বে তাই না?
– না সেরকম কিছুই নেই। এখন ভর্তি পরীক্ষার আবেদনের সময়ে নিজেকেই ঠিক করে নিতে হয় কে কোনটা পড়বে।
– বলো কি! জেনেশুনে এটা নিতে গেলে কেন?
– কেন কাকা, কি সমস্যা?
– না তুমি তো ঠান্ডা স্বভাবের ছেলে, এই সব পাগলের চিকিৎসা করতে গেলে কি সামলাতে পারবে! বোঝই তো, পাগলের কি আর ঠিকআছে, কখন কি করে বসে।
– কিছুটা ঝুঁকি তো আছেই, তবে আপনি যেমন বলছেন সেরকম কিছুই নয়। আর মানসিক রোগী মানেই তো পাগল নয়। এসব আগেকার কথা।
– আরে বাবা, তোমরা আধুনিক যুগের ছেলেপিলে। তোমরা এই রোগী সেই রোগী যেই নামই দাওনা কেন বাপু, দিনশেষে পাগল তো পাগলই। ওদের কি কান্ডজ্ঞান আছে? কখন যে কার উপর চড়াও হয়।
– না কাকা। ওদের এত ভয় পাওয়ার কারণ নেই, প্রয়োজন হল সহানুভূতিশীল আচরণ।
– শোনো, আমাদের ওখানে ছিল চইতা পাগলা। চৈত্র মাস আসলেই সে পাগল হয়ে যেত। আর হাতে দা নিয়ে সবাইকে ধাওয়া করতো। এই মোটা শেকল দিয়ে বেঁধে রাখতে হতো। নিজের চোখে দেখেছি। আর আমরা আতঙ্কে থাকতাম কখন সে আবার পাগল হয়ে যায় এই ভয়ে।
– দেখুন কাকা, আপনি যা বলছেন সেটা অল্প কিছু ক্ষেত্রেই হয়। আর তার পিছনেও অনেক কারণ থাকে, যেমন  তাকে উত্যক্ত করা, তার কথার পাত্তা না দেয়া এমন অনেক কিছুই। কিন্তু, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মানসিক রোগীরা আক্রমণাত্মক হয় না যেমনটা সাধারণ মানুষ ভেবেথাকে, কিংবা পত্র-পত্রিকায়, গল্পে-উপন্যাসে-সিনেমায় যেভাবে রগরগে কাহিনি হিসেবে লেখা বা দেখানো হয়ে থাকে।
– বল কি!
– হ্যাঁ। সুইডেনে ওদের জাতীয় হাসপাতালগুলোতে দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে যাদেরকে বিভিন্ন অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে তাদের মধ্যে মাত্র ৫% এর মধ্যে জটিল মানসিক রোগ ছিল। আরেকটি গবেষণায় বলা হয়েছে, মানসিক রোগীদের মধ্যে খুন করার প্রবণতা সাধারণ জনগোষ্ঠীর চেয়ে বেশী বলে যে একটা ধারণা প্রচলিত তার স্বপক্ষে কোনো যুক্তিগ্রাহ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাই, বলা হয়ে থাকে, মানসিক রোগে আক্রান্ত মানুষরা অপরাধ করার ক্ষেত্রে অন্য আর দশজন সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশি ভয়ংকর নয়।
– এতো আজব কথা! সারা জীবন যা শুনে আসলাম তুমি তো তার সবই উল্টে দিচ্ছ। তার মানে কি মানসিক রোগীরা খুনটুন করেইনা!
– তা নয় কাকা। মানুষ যেভাবে ধারণা করে যে, মানসিক রোগী মাত্রেই পাগল, আর পাগল মানেই মারামারি, খুনোখুনি করে সেই কথাটা ঠিক নয়।
– তার মানে কিছু কিছু রোগী করতেও পারে।
– হ্যাঁ, কিছু কিছু মানসিক রোগ আছে, যাতে আক্রান্ত হলে রোগীর অপরাধ-সঙ্ঘাতের দিকে যাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। যেমন –সিজোফ্রেনিয়া, ডিলিউশনাল ডিজঅর্ডার, মাদকাসক্তি এসব মানসিক রোগে আক্রান্তরা বড় ধরনের অপরাধে জড়িত হতে পারে। এছাড়াও আরওকিছু রোগ আছে যেখানে রোগীরা ছোটখাট অপরাধেও সামিল হয়। তবে, সবকিছু মিলিয়েই বলা চলে, মানসিক রোগীদের মধ্যে অপরাধ করার হার, সাধারণ জনগোষ্ঠীর অপরাধ প্রবণতার হারের মতোই। এতে খুব বেশি পার্থক্য নেই।
– হুম বুঝলাম।
– আরেকটা কথা, বেশ কিছু শারীরিক রোগেও কিন্তু মানুষ হিংস্র আচরণ করতে পারে।
– যেমন!
– মাথায় আঘাত পেলে, মৃগী রোগে, স্মৃতিভ্রংশতা (Dementia) হলে, স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে নিলে, ডায়াবেটিসের একটা জটিলতা হিসেবে কিটো-এসিডোসিস হলে, এরকম আরও বেশ কিছু শারীরিক রোগের কারণে এমনটি হতেও পারে।
– বাপরে, এত কথা কি আর মনে থাকবে। সারাংশটা কি?
– সারাংশ হচ্ছে- কিছু কিছু মানসিক রোগে রোগীর অপরাধ প্রবণতা বাড়তে পারে, কিন্তু, মানসিক রোগী মাত্রেই খুন-জখম, মারামারি করে এই প্রচলিত ধারণাটা ঠিক নয় এবং মানসিক রোগে আক্রান্তদের মধ্যে অপরাধ করার হার সাধারণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে অপরাধ করার হারের কাছাকাছিই বলা চলে।
– হুম, কথাটা বুঝতে পারলেও মানতে কষ্টই হবে।
– কষ্ট হলেও এই সত্যি যত তাড়াতাড়ি মেনে নেওয়া যায় এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে মানসিক রোগীদের এড়িয়ে না চলে তাদের প্রতি সমানুভূতি (Empathy) আনা যায়, ততই মঙ্গল।


প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।

Previous articleগর্ভধারণের প্রস্তুতি
Next articleইন্টারনেট, মানসিক স্বাস্থ্য ও আমরা
ডা. পঞ্চানন আচার্য্য। স্থায়ী ঠিকানা চট্টগ্রাম। তবে, কলেজ শিক্ষক মায়ের চাকুরিসূত্রে দেশের বিভিন্ন জায়গায় কেটেছে শৈশব। মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবং উচ্চ-মাধ্যমিক চট্টগ্রাম কলেজ থেকে। সিলেট এম. এ. জি. ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ থেকে এম.বি.বি.এস পাসের পর সরকারি চাকুরিতে যোগদান করেন। মেডিক্যালে পড়ার সময় থেকেই মনোরোগ নিয়ে পড়ার প্রতি আগ্রহ। তাই, ইউনিয়ন পর্যায়ে নির্ধারিত সময়ের চাকুরি শেষে ভর্তি হন মনোরোগবিদ্যায় এম.ডি(রেসিডেন্সি) কোর্সে। বর্তমানে তিনি একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। বংশপরম্পরায় প্রাপ্ত শিক্ষকতার ধারা বজায় রেখে চিকিৎসক ও শিক্ষক হওয়াটাই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। বই, সঙ্গীত আর লেখালেখিতেই কাটে অবসর সময়ের বেশির ভাগ। স্বপ্ন দেখেন - মেধা ও মননশীলতার চর্চায় অগ্রগামী একটা বাংলাদেশের।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here