মানসিক রোগ থেকে খুন

0
111
মানসিক রোগ থেকে খুন

খুন বা হত্যা আমাদের সমাজের একটি নেতিবাচক বা অগ্রহণযোগ্য বাস্তবতা। অপরাধ বিজ্ঞানে, কোনো ব্যক্তির দ্বারা অন্য এক বা একাধিক ব্যক্তিকে হত্যা করাই হচ্ছে খুন বা হোমিসাইড এবং কোনো ব্যক্তি যদি কাউকে এমনভাবে আঘাত বা আক্রমণ করে, যেখানে জীবনহানি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাহলে তাকে হোমিসাইডাল বিহেভিয়ার কিংবা প্রাণঘাতী আচরণ বলা হয়। হোমিসাইডের ক্ষেত্রে সামাজিক, পারিবারিক এবং মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা বিশেষভাবে সম্পর্কিত। ক্ষেত্র বিশেষে মানসিক রোগীরাও অনেক সময় আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে, করে ফেলতে পারে খুন বা হোমিসাইডের মতো গর্হিত কাজ। কিছু গবেষণায় দেখা যায়, সাধারণ মানুষের থেকে মানসিক রোগীদের খুন করার প্রবণতা ২ থেকে ৬ গুণ পর্যন্ত বেশি হতে পারে। খুনের ওপরে ডেনমার্কের ২৪ বছরের এক ধারাবাহিক গবেষণায় ২২ ভাগ পুরুষ আর ৪৪ ভাগ নারী মানসিক রোগে আক্রান্ত পাওয়া গেছে। এসব নিয়ে আমাদের দেশে খুব একটা গবেষণা নেই। কিন্তু আমাদের দেশে গত কয়েক বছরে বেশ কিছু খুনের ঘটনা ঘটেছে, যেখানে খুনিকে দেখে আমরা খুবই আশ্চর্য হয়েছি কারণ খুনি ছিল নিহতদের খুবই আপনজন। কিছু ঘটনায় পিতা তার স্ত্রী-সন্তানকে, মাতা তার সন্তানদের, সন্তান তার মা-বাবা-ভাই-বোনদেরকে হত্যা করেছে। ভালোভাবে তদন্ত এবং যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে হয়ত এদের মধ্যেও অনেকে মানসিক রোগী হিসেবে নির্ণয় হবে।

মাদকাসক্তি, সিজোফ্রেনিয়া, ডিলিউশনাল ডিজঅর্ডার, পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার, শিশুদের ক্ষেত্রে কন্ডাক্ট ডিজঅর্ডার, এমনকি বিষণ্ণতা বা উদ্বিগ্নতা থেকেও কেউ কেউ খুন করে বসতে পারেন। এসব ক্ষেত্রে রোগীর চিন্তা, আবেগ এবং মনের অবস্থা স্বাভাবিকের থেকে এলোমেলো থাকে, যার ফলে তার মধ্যে কিছু ভ্রান্ত বিশ্বাস, অলীক প্রত্যক্ষণ, অনিয়ন্ত্রিত আবেগ ইত্যাদি মানসিক উপসর্গ তৈরি হয়। গুরুতর মানসিক রোগে আক্রান্ত রোগীদের এসব উপসর্গের সমন্বয়ে একটা আলাদা জগৎ তৈরি হয়ে, সেখানে তাকে হয়ত কেউ নিয়ন্ত্রণ করে, কেউ তাকে নির্দেশ দেয়, কাউকে সে নিজের ও সমাজের জন্য হুমকি মনে করে, ফলে সে আক্রমণাত্নক আচরণ এমনকি খুনও করে ফেলতে পারে।

নিচে কিছু মানসিক রোগ ও খুনের সম্পর্ক নির্ণয়ের চেষ্টা করা হলো:

মাদকাসক্তি ও খুন: যারা নিয়মিত মাদক গ্রহণ করে, তাদের মস্তিষ্কের ওপর মাদক মারাত্মক প্রভাব ফেলে। ফলে মস্তিষ্কের যেসকল অংশ মানুষের আবেগ, অনুভূতি, আচরণ, বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ নিয়ন্ত্রণ করে তা ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অতিমাত্রায় মাদক গ্রহণের ফলে গুরুতর মানসিক রোগীদের মতো ভ্রান্ত বিশ্বাস, অলীক প্রত্যক্ষণসহ নানাপ্রকার সাইকোটিক লক্ষণ প্রকাশ পায়। মাদকের তীব্র চাহিদা মেটাতে তারা আক্রমণাত্নক হয়ে উঠতে পারে এবং খুনের মতো ঘটনাও ঘটিয়ে ফেলে। যেকোনো মাদকের ক্ষেত্রেই এরকম হতে পারে। তবে অতিমাত্রায় অ্যালকোহল, কোকেইন, ইয়াবা আসক্তিদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি থাকে।

সিজোফ্রেনিয়া ও খুন: অনেকেই মনে করেন, সিজোফ্রেনিয়ার সঙ্গে খুনের সরাসরি কোনো সম্পর্ক নাই। কিন্তু বৈজ্ঞানিক গবেষণায়, সিজোফ্রেনিয়া রোগীদের মধ্যে খুন করার প্রবণতা সাধারণ মানুষের থেকে বেশি পাওয়া গেছে। আমেরিকাতে ১২ বছরের খুনের এক জরিপে সিজোফ্রেনিয়া রোগীদের মধ্যে হোমিসাইড সাধারণ মানুষের থেকে ১০ গুণ বেশি পাওয়া গেছে। ১৯৬৪ থেকে ১৯৮৪ সালের ডাটা বিশ্লেষণ করে, লন্ডনের এক গবেষণায় পুরুষ সিজোফ্রেনিয়া রোগীদের মধ্যে নারীদের থেকে ৩.৮ গুণ বেশি আক্রমণাত্নক আচরণ পাওয়া গেছে। সিজোফ্রেনিয়ার রোগীদের অনেকগুলো উপসর্গের মধ্যে গুরুতর দুটো হচ্ছে, ডিলিউসন (ভ্রান্ত বিশ্বাস) এবং হ্যালুসিনেসন (অলীক প্রত্যক্ষণ) । ডিলিউসন যখন এরকম হয় যে, কেউ তাকে অথবা তার আপনজনদেরকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করছে, তখন সে তার নিজের অথবা তার আপনজনদের নিরাপত্তার স্বার্থে ষড়যন্ত্রকারীকে (তার ভ্রান্ত বিশ্বাস অনুযায়ী) মেরে ফেলতে পারে। হ্যালুসিনেসন যখন কমান্ডিং বা নির্দেশমূলক হয়, তখন বাইরে থেকে কেউ থাকে বিভিনড়ব কাজের নির্দেশ দিয়ে থাকে, যেটা তার পক্ষে অমান্য করা অনেক ক্ষেত্রেই অসম্ভব হয়ে যায়। সেই নির্দেশ যদি কাউকে খুন করার কথা বলে, তাহলে খুনের মতো ঘটনা ঘটতে পারে। এছাড়া সিজোফ্রেনিয়ার রোগীরা যখন মারাত্মকভাবে এলোমেলো হয়ে যায়, অতিমাত্রায় আক্রমণাত্মক হয়ে যায়, তখন যেকোনো খারাপ ঘটনাই ঘটতে পারে। সিজোফ্রেনিয়া রোগীদের মধ্যে যাদের পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার এবং মাদকে আসক্তি রয়েছে তারা অতিমাত্রায় আক্রমণাত্মক হয় এবং হোমিসাইডের মতো ঘটনা অন্য সিজোফ্রেনিয়া রোগীদের থেকে বেশি ঘটে।

জেলাস টাইপ ডিলিউশনাল: ডিজঅর্ডারে সঙ্গীকে খুন ডিলিউশনাল ডিজঅর্ডারর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হয় জেলাস টাইপ ডিলিউশনাল ডিজঅর্ডার, যাকে মরবিড জেলাসি বা প্যাথোলজিক্যাল জেলাসি বা ওথেলো সিনড্রোমও বলা হয়। এতে আক্রান্ত ব্যক্তি তার সঙ্গীকে সম্পূর্ণভাবে অবিশ্বাস করে, সে মনে করে তার সঙ্গীর সঙ্গে অন্য কারো সম্পর্ক রয়েছে, তাকে ফাঁকি দিয়ে তারা নিয়মিত দেখা করে, এমনকি শারীরিক সম্পর্কও তৈরি করে। সঙ্গীর যে কারো সঙ্গে বিশেষ কোনো সম্পর্ক নেই, এরকম অনেক প্রমাণ দেয়ার পরও, আক্রান্ত ব্যক্তি তার সঙ্গীকে বিশ্বাস করে না। সাময়িক সময়ের জন্য যুক্তিতে হেরে হয়ত কিছুটা নমনীয় হয়, কিন্তু পরক্ষণেই আবার সে তার ভ্রান্ত বিশ্বাসে ফিরে যায় এবং তথ্য প্রমাণ খুঁজতে থাকে। কখনো কখনো ব্যক্তিগত গোয়েন্দাও নিয়োগ করে। আক্রান্ত ব্যক্তি তার সঙ্গীর জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। রোগের ইতিহাস ভালোভাবে নিলে দেখা যায়, আক্রান্ত ব্যক্তি তার সঙ্গীর ওপর দীর্ঘদিন ধরে মৌখিক, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের করে আসছে। অনেকক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তি নিজের যৌন সমস্যার জন্য তার সঙ্গীর বিশ্বাসঘাতকতাকে দায়ী করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সঙ্গীর যৌন ক্ষমতা কমানোর জন্য নির্যাতন করে, যৌনবাহিত রোগের জীবাণু দিয়ে আক্রান্ত করার চেষ্টা করে, বিষ প্রয়োগ করে বা অন্যকোনোভাবে সরাসরি হত্যা করার চেষ্টা করে। কেউ কেউ তার সঙ্গীকে হত্যা করার পর, নিজেও আত্মহত্যা করে থাকে। সাধারণত পুরুষরা নারীদের থেকে দ্বিগুণ হারে এই রোগে আক্রান্ত হয়। গবেষণায় দেখা যায়, যাদের ব্যক্তিত্বের সমস্যা থাকে, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি থাকে, বিষণ্ণতা এবং মাদকের প্রতি আসক্ত থাকে তাদের ক্ষেত্রে এই রোগের খারাপ পরিণতি বেশি হয়।

গর্ভপরবর্তী গুরুতর মানসিক রোগ ও নিজের শিশুকে খুন: গর্ভের সন্তান প্রসবের অনেক মায়েরা বিভিন্ন মানসিক সমস্যায় ভুগে থাকেন। সেটা সামান্য বিষণ্ণতা/উদ্বিগ্নতা থেকে মারাত্মক মানসিক সমস্যা যেকোনো কিছুই হতে পারে। গর্ভপরবর্তী গুরুতর মানসিক রোগকে আমরা Postpartum বা Puerperal Psychosis বলে থাকি। প্রতি ১০০০ সন্তান প্রসবের মধ্যে মাত্র ১-২ জন এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে। সংখ্যায় খুব কম হলেও তা মায়ের এবং বাচ্চার জন্য মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে। এক্ষেত্রে গুরুতর মানসিক উপসর্গ ডিলিউশন বা হ্যালুসিনেশন ছাড়াও শুধুমাত্র বাচ্চাকে নিয়ে তার এক ধরনের ডিলিউশন বা ভ্রান্ত বিশ্বাস তৈরি হতে পারে। মা মনে করে, এই বাচ্চার শারীরিক এবং মস্তিষ্কের গঠন ঠিক নেই, বা কোনো না কোনোভাবে বাচ্চার কিছু সমস্যা আছে, যা ভবিষ্যতের জন্য খারাপ বা এই বাচ্চা তার না, খারাপ কোনো কিছুর বাচ্চা(যেমন-শয়তানের বাচ্চা)। ভ্রান্ত বিশ্বাস এমন পর্যায়ে চলে যেতে পারে, তখন সে তার বাচ্চাকে নিজের, পরিবারের, এমনকি পৃথিবীর জন্য হুমকি মনে করে এবং সেই বিশ্বাস থেকে মা তার নিজের বাচ্চাকে খুনও করে ফেলতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের পূর্বে বাইপোলার ডিজঅর্ডারের ইতিহাস থাকে, তাদের এই রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এছাড়া হরমোনের সমস্যা, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, অপর্যাপ্ত ঘুমের ফলে এই রোগ প্রকাশ পেতে পারে।

পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার ও খুন: মানসিক রোগের মধ্যে খুন বা হোমিসাইডের সঙ্গে বেশি সম্পর্ক হচ্ছে পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারের। ফ্রান্সের ১০ বছরের এক ধারাবাহিক গবেষণায় হোমিসাইডের শতকরা ২০ ভাগের মধ্যে পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার পাওয়া গেছে। প্রায় ১০ প্রকারের পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার রয়েছে তার মধ্যে অ্যান্টিসোশ্যাল, নার্সিসিস্টিক এবং বর্ডারলাইন পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারের মধ্যে আক্রমণাত্মক বা প্রাণঘাতী আচরণ বেশি পাওয়া যায়। অ্যান্টিসোশ্যাল পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারের রোগীরা সরাসরি অপরাধমলূ ক কাজের সঙ্গে জড়িত থাকে যেমন: চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, ধর্ষণ এবং খুন সহ সকল প্রকার অপরাধমূলক কাজ তাদের নিত্যদিনের ব্যাপার। এসব ঘৃণ্য কাজের জন্য তাদের কোনো প্রকার অনুশোচনা কাজ করে না।

বিষণ্ণতা ও খুন: বিষণ্ণতায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা বিষণ্ণ থাকার পাশাপাশি নানাপ্রকার নেতিবাচক চিন্তা মাথার মধ্যে কাজ করে; যেমন-নিজেকে অক্ষম মনে করা, মূল্যহীন ভাবা, ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখা ইত্যাদি। ফলে, সে মারাত্মকভাবে হতাশায় পড়ে যেতে পারে এবং সেই হতাশা থেকে হঠাৎ আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে। যদিও বিষণড়বতায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা আত্মহত্যাপ্রবণ এবং আত্মহত্যা বেশি করে থাকে, তারপরও কোনো কোনো ক্ষেত্রে আক্রমণাত্মক হয়ে কাউকে খুনও করে ফেলতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার কথা ভেবে নিজের পরিবারের সদস্যদের খুন করে, নিজেও আত্মহত্যা করে ফেলে। বিষণ্ণতার পাশাপাশি যাদের ব্যক্তিত্বের সমস্যা, মাদকে আসক্তি রয়েছে তাদের মধ্যে আক্রমণাত্মক আচরণ বেশি পাওয়া যায়। ওপরের রোগগুলো ছাড়াও যেকোন মানসিক রোগী হঠাৎ আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে, যেসব রোগে নিজেদের আবেগ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় এবং যেখানে গুরুতর মানসিক রোগের উপসর্গ (ডিলিউশন ও হ্যালুসিনেশন) থাকে।

ডা. মেজবাউল খাঁন ফরহাদ
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ফরিদপুর।

সূত্রঃ মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ৪র্থ বর্ষ, ৮ম সংখ্যায় প্রকাশিত। 

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

“মনের খবর” ম্যাগাজিন পেতে কল করুন ০১৮ ৬৫ ৪৬ ৬৫ ৯৪
Previous articleরুখে দেই মাদকের ভয়াল থাবা
Next articleমানসিক স্বাস্থ্য নজরে রাখার ফিচার আনছে অ্যাপল

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here