মাদক এবং অযৌক্তিক দাবীকে “না” বলার কৌশল

1
91

মাদকাসক্তি সমস্যা বর্তমানে বৈশ্বিক সমস্যা বলে চিহ্নিত হয়েছে। সারা পৃথিবী জুড়ে এই রোগের ব্যাপকতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। যদিও এই রোগের বিজ্ঞান সম্মত চিকিৎসা আছে। তথাপি নানা ধরণের ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির কারণে একজন মাদকমুক্ত বা বিরত থাকলেও এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার নিয়ে ফেলে। কেননা সে “না” বলতে পারেনা। যেমন: একজন সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর মাদক ব্যবহার করবেনা কিন্তু পথিমধ্যে বন্ধু বা যাদের সাথে নেশা নিতো তাদের সাথে দেখা হয়ে গেল। সেই সময় তারা তাকে অনুরোধ করে বসল একসাথে একটু মজা করে নেশা নেয়ার জন্য।
দেখা যায় এই ধরণের পরিস্থিতিতে একজন আরোগ্য ব্যক্তি তার বন্ধুর অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারেনা। যেহেতু তার নেশায় জড়িয়ে যাওয়ার ইচ্ছে নেই তাই তার বন্ধুকে “না” বলার কৌশল হিসেবে কিছু খোঁড়া যুক্তি দিতে শুরু করে। যেমন: আমি যদি তোমার সথে যাই তবে ভাইয়া বকা দিবে। আমি না হয় আর একদিন নিব ইত্যাদি। মৃদু কন্ঠের এই ধরণের খোঁড়া যুক্তি দেয়ার কারণে বন্ধু দ্বন্দ্ব এবং সন্দেহের মধ্যে পরে যায়। ফলে সে যুক্তি খন্ডন করার জন্য পাল্টা যুক্তি দিয়ে রাজি করানোর চেষ্টা করে।ভাবে আর একটু অনুরোধ করলইে সাথে যাবো। মাদককে এড়িয়ে চলার জন্য তাই ব্যাখ্যা না দিয়ে সরাসরি এড়িয়ে চলাই উত্তম। এজন্য অপরাধবোধ আসতে পারে। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে “না” বলার অধিকার আপনার থাকতেই পারে। মাদক নেয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে আপনি কোন অন্যায় করেননি। নিজের জীবনটার প্রতি তো আপনার শ্রদ্ধাশীল থাকা উচিত। বন্ধু বিচ্ছেদ থেকে সৃষ্ট বেদনা সহ্য করার মত মানসিক শক্তি থাকা প্রয়োজন। আসলে জীবনের বাস্তবতায় কাছের মানুষ গুলোকেও কখন কখন “না” বলতে হয়।
পরোক্ষভাবে (Passively) যারা সামাজিক যোগাযোগ রক্ষা করে তারা সাধারণত “না” বলতে পারে না। সংকোচ, লজ্জা, ভয়, দ্বন্দ্ব বা দু:শ্চিন্তায় ভোগে। “না” বললে যদি সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যায়। অন্যকে খুশী করতে গিয়ে মনের সত্যিকার অনুভূতি গুলোকে বোতলে বন্দী করে রাখে। নিজের স্বপক্ষে দাঁড়াতে পারেনা, নিজের অধিকার রক্ষা করতে পারেনা। সমস্যাকে এড়িয়ে চলতে অন্যের কথাই ঠিক বলে স্বীকার করে নেয়। নিজেকে সঠিক মনে করেনা যদিও বাস্তবে তা নয়। নিজে কষ্ট পায় ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করার কারণে। অন্যের কাছে এরা জনপ্রিয় হতে পারে। অন্যরা এদের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করে নেয়। আর “না” বলতে না পারার দক্ষতার অভাবে আমরা মাঝে মাঝে ছোট ছোট মিথ্যা বলি অন্যকে এড়িয়ে চলার জন্য। এর ফলে হয়ত আমাদের কোন বড় ধরণরে কনো ক্ষতি হয়না কিন্তু মনের মধ্যে অনেক সময় খারাপ লাগা তৈরী হয়। আর “না” উচ্চারণের কারণে যদি সুবিধা বি ত হতে হয় সে ক্ষেত্রে নিজের ব্যক্তিত্ব, বিশ্বাস এবং আদর্শের সাথে আপোষ করবেন কিনা, করলে শান্তি পাবেন কিনা, ইত্যাদি বিষয় গুলো বিবেচনায় আনতে হবে। মনে রাখতে হবে, মুখ বুঝে “হ্যাঁ” বলার প্রবণতা আপনাকে মানসিক রোগীতে পরিণত করতে পারে। আর গবেষণায় দেখা গেছে সঠিক পন্থায় (অংংবৎঃরাবষু)“না” বললে সম্পর্ক নষ্ট হয়না।
প্রসঙ্গক্রমে একদা হাসপাতালে ভর্তি থাকা সেই মেয়েটির কথা মনে পড়ে গেল। সে কনভার্সন ডিসঅর্ডার এ ভোগার ফলে হাটতে পারছিলনা। তার এই পরিণতির জন্য অনেক কারণের একটি “না” বলতে না পারার দ্বন্দ্ব। দিনে দিনে পুঞ্জীভূত মানসিক চাপ তার পায়ের উপর পরেছলি। মনের চাপ যে শরীরে পরে এটা একটু ভাল করে খেয়াল করলেই বোঝা যায়।
যাইহোক, মানসিক বা মাদকাসক্ত সমস্যার ক্ষেত্রে যারা “না” বলতে পারেনা কাউন্সিলিং সেশনে তাদের অভিনয়ের মাধ্যমে না বলা শেখানো হয়। “না” শব্দটির সাথে সংশ্লিষ্ট বাক্য উচ্চারণের ক্ষেত্রে গলার স্বরের মধ্যে দৃঢ়তা থাকতে হবে। সেই সাথে উল্লেখ করতে চাই কর্কশ কন্ঠস্বর নয় দৃঢ় কিন্তু নম্র কন্ঠ স্বর হতে হবে। ভদ্রতার বিষয়টি থাকবে। অনুভূতি প্রকাশের ক্ষেত্রে দেহভঙ্গির বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। আপনার আত্মবিশ্বাসী দেহভঙ্গি বলে দিবে আপনি আপনার সিদ্ধান্তে অটল, আপনি নেশা নিবেন না। সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে না বলতে হবে। রাগান্বিত চোখে, মাথা নীচু করে বা অন্যদিকে তাকিয়ে “না” বললে কিন্তু হবেনা। আর রাগ দেখিয়ে সমস্যার সমাধান করতে চাইলে তর্ক বা ঝগড়া লেগে যেতে পারে। অন্যান্য অযৌক্তিক দাবীর ক্ষেত্রে কেন সম্ভব নয় সে প্রসঙ্গে সামান্য ব্যাখ্যা দেয়া যেতে পারে। মাদকের ক্ষেত্রে “না” হওয়া উচিত প্রথম শব্দ, আর এটা হতে হবে কোন রকম সংকোচবোধ ছাড়াই। এত কিছুর পরেও কিন্তু নাছড়বান্দা স্বভাবের মানুষ পাবেন যারা না শুনতে অভ্যস্থ নয়। অন্যের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। তাদের কথাই শেষ কথা। এদেরকেও মোকাবেলা করার দক্ষতা থাকতে হবে। এধরনের মানুষের ক্ষেত্রে আরো একটু দৃঢ় চিত্রে বলা, আমাকে আর কখনো নেশা নেয়ার জন্য বলবেন না।
আমাদের জীবন এবং অন্যের জন্য আমাদের স্বার্থত্যাগ করার বিষয় নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। “না” বলতে শিখে আমরা যেন যত্রতত্র এই না বলায় অভ্যস্থ হয়ে না যাই, স্বার্থপর হয়ে না পরি। সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে মোরা পরের তরে- বাঙ্গালী জাতির এই ধরনের মূল্যবোধ থেকে যেন সরে না আসি। অন্যের জন্য ত্যাগ স্বীকারের বিষয়টি কিন্তু রয়েই গেল। কিন্তু ভাবুন কার জন্য আপনি ত্যাগ স্বীকার করছেন? ব্যক্তিটি আপনার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আপনার জীবনে তার অবদান কতটুকু, তাকে সহযোগীতা করার তাগিত মনের ভেতর থেকেই অনুভব করছেন কিনা, ছাড় দিয়ে, ত্যাগ স্বীকার করে, সহযোগীতা করে যদি শান্তি পান তবে করতেই পারেন। আসলে বিকশিত মানুষ হওয়ার গুণাবলী অর্জনের জন্য এই পৃথিবীর মানুষের প্রতি, প্রিয় এবং কাছের মানুষ গুলোর জন্য ত্যাগ স্বীকারের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। না বলতে শিখে এ ধরণে দায়বদ্ধতা,কতব্য বোধ থেকে আমরা যেন সরে না আসি। আসুন, অন্যের বলা “না” কে সহজভাবে গ্রহণ করি এবং মাদক ব্যবহারের প্রস্তাবসহ অন্যান্য অন্যায্য, অযৌক্তিক দাবী বা আবদারকে দৃঢ় চিত্রে “না” বলি। অন্ধকার জীবন নয়, আলো ঝলমল রোদেলা ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাই।


প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।

Previous articleডিল্যুশনাল ডিজঅর্ডার
Next articleআত্মহত্যা

1 COMMENT

  1. সুন্দর লিখেছেন। আমি আপনার কাকাউন্সিলের মাধ্যমে নেশা মুক্ত সুস্থ আছি এখনো প্রায় সাড়ে ৩ বছর। না বলতে শিখেছি বিধায় হয়তো টিকে আছি তা নাহলে অনেক আগেই আবার আসক্তির সাথে জড়িয়ে যেতাম হয়তোবা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here