মাদকাসক্তি: নিরাময় পদ্ধতি বর্ণনা ১

0
98

 
মানুষের জীবনে যে কোনো ধরনের লক্ষ্য পূরণের জন্য প্রয়োজন প্রেষণা বা ইচ্ছা। এই ইচ্ছাশক্তি এবং অভাববোধ তৈরি করা সাবস্টেন্স (মাদক) ব্যবহারকারী রোগীদের জন্য খুবই প্রয়োজন। কেননা এইসব রোগীদের অনেকের মধ্যেই পরিবর্তনের ইচ্ছা থাকে না অথবা বিষয়টিকে সমস্যা বলে মনে তো করেনই না বরং ব্যবহারের বিষয়কে অস্বীকার বা প্রত্যাখ্যান করেন। তাদের এই মনোভাব নেশামুক্ত সুন্দর জীবন- যাপন, চিকিৎসা গ্রহণ এবং সমস্যাকে স্বীকার করে নেয়ার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। প্রেষণা মূলক সাক্ষাৎকার এর মাধ্যমে এই অন্তরায় দূর করা যায়। এক্ষেত্রে বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী কাল রোজার্স এর ক্লায়েন্ট- সেন্টার্ড থেরাপি বা অনির্দেশক পন্থা অনুযায়ী করা হয়। অর্থাৎ এক্ষেত্রে রোগীর নিজস্ব চিন্তা, পরিকল্পনা, আশা বা অভিমতের উপর গুরুত্ব আরোপ এবং শ্রদ্ধাশীল থাকতে হয়। সেই সাথে এটা ডাইরেক্টিভ অর্থাৎ চিকিৎসক তাকে দিক নির্দেশনা দিতে পারেন। এছাড়াও প্রেষণা মূলক পন্থায় প্রেষণা মনোবিজ্ঞানের নীতি এবং জেমস প্রচেশকা (James Prochaska) এবং কার্লস ডিক্লিমেন্ট (Carlos Diciliment) আবিস্কৃত পরিবর্তনের ট্রান্স থিওরীটিক্যাল মডেল বা পরিবর্তনের ধাপ মডেল (The stage of change model) এর মাধ্যমে মাদক বন্ধে রোগীকে উৎসাহিত করা যায়।
মিলার এবং সানচেজ (Miller and Sanchez; 1994) দেখিয়েছেন যে প্রেষণামূলক সাক্ষাৎকারে চিকিৎসক বিজ্ঞান সস্মতভাবে সাক্ষাৎকার পরিচালনা করতে পারলে সাধারণতঃ এক-চার সেশনের মধ্যেই রোগী মাদক বা সাবস্টেন্স ব্যবহার বন্ধ করার অঙ্গীকার করেন। প্রেষণা মূলক সাক্ষাতকারে কিছু মৌলিক উপাদান রয়েছে যাকে সংক্ষেপে ঋ. জ. অ. গ. ঊ. ঝ  বলে। রোগীকে অনুপ্রাণিত করতে এগুলো অনন্য ভূমিকা রাখে। নিম্নে এই উপাদানগুলো সম্পর্কে সংক্ষেপে বলা হলো
প্রতিক্রিয়া বা মন্তব্য (Feedback)
ব্যক্তিগত ঝুঁকি বা অক্ষমতা সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া করা।
দায়িত্ববোধ (Responsibility)
পরিবর্তনের জন্য তার নিজস্ব দায়িত্ববোধের উপর জোর দেয়া হয়। চিকিৎসক তাকে এভাবে বলতে পারেন-“সাবস্টেন্স (মাদক) ব্যবহারের ব্যাপারে আপনি কি করবেন এটা আপনার উপর নির্ভর করছে”। চিকিৎসক যদি তার সাবস্টেন্স (মাদক) ব্যবহার সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হয়ে এভাবে বলেন – “আমি মনে করি আপনার ব্যবহার বন্ধ করা উচিৎ, এসব খুবই ক্ষতিকর তাহলেই বরং প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয় এবং তারা ব্যবহারের পক্ষেই থাকে।
উপদেশ (Advice)
এক্ষেত্রেও বন্ধ করা উচিত এভাবে উপদেশ না দিয়ে পরিস্কার এবং স্বচ্ছভাবে বলা-যদি তিনি এগুলো ব্যবহার বন্ধ করেন তবে ভবিষ্যতে অনেক সমস্যা থেকে রক্ষা পাবে। তার বিষণ্নতা, উদ্বেগ কমে যাবে। ফলে তাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে এবং কি কারণে বন্ধ করতে হবে সে সম্পর্কে অর্ন্তদৃষ্টি বৃদ্ধি পাবে।
তালিকা (Menu)
কোন ধরনের কৌশল অবলম্বন করলে তার জন্য ভাল হয় সেটা তার পছন্দ অনুযায়ী করা হয়। যেমনঃ কোথায়, কখন, কিভাবে, কার সাথে, কি কারণে সাবস্টেন্স (মাদক) নিয়েছিল এগুলো ডাইরিতে লিখতে উৎসাহিত করা। ছাড়ার ব্যাপারে তার পছন্দ অনুযায়ী একটা গাইড লাইন তৈরি করতে চিকিৎসকের সহযোগিতা, ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি সনাক্তকরণ এবং এড়িয়ে চলা। কে কে তাকে সাহায্য করতে পারেন। নেশার বিকল্প হিসাবে শখের কাজ, খেলাধুলা, ব্যায়াম, পরিবারের সাথে সময় কাটানো।
সমানুভূতি (Empathy)
কাউন্সিলর এর সমানুভূতি প্রকাশ খুবই জরুরি বিষয়।
আত্ম-সক্ষমতা (Self- efficacy)
রোগীর দক্ষতা এবং আশাবাদীতাকে সমর্থন করা।
বিভিন্ন গবেষণায় উপরোক্ত উপাদান গুলোর কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে। প্রেষণামূলক সাক্ষাৎকার সম্পর্কে আলোচনার বিভিন্ন পর্যায়ে এই উপাদানগুলো সম্পর্কে আরো পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে। রোগীর নিজস্ব বা অর্ন্তনিহিত প্রেষণার উপর জোড় দেয়া হয় এবং পরিবর্তনকে জোর করে চাপিয়ে দেয়া হয় না। পরিবর্তনের কতকগুলো ধাপ রয়েছে
পরিবর্তনের ধাপ সমূহ (Stage of change) 
প্রচেশকা এবং ডিক্লিমেন্ট (১৯৮২, ১৯৮৪, ১৯৮৫, ১৯৮৬) তাদের ট্রান্সথিওরীটিক্যাল মডেলে পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ৬ টি ধাপ সনাক্ত করেছেন। এই ধাপ গুলোতে রোগীর বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। রোগী কোন ধাপে রয়েছে তা একজন চিকিৎসক এর সনাক্ত করণের দক্ষতা থাকা প্রয়োজন। ধাপ গুলো নিম্নরূপ
প্রাক- মনোনিবেশ (Pre-contemplation)
এই পর্যায়ে অনেক নেতিবাচক মনোভাব থাকে। সাবস্টেন্স (মাদক) ব্যবহার সমস্যা বা ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়- এই সম্বন্ধে অসচেতন থাকে। “আমি ভাল আছি ” এ ধরনের একটি মনোভাব থাকে তার মধ্যে। পরিবর্তনের কোন চিন্তা থাকে না।
রোগীর সাথে সম্পর্ক তৈরি করে সাবস্টেন্স (মাদক) নেয়ার পরিণতি সম্পর্কে তাকে সজাগ করে তুলতে হবে। এই পর্যায়ে কিছু প্রয়োজনীয় প্রশ্ন করে তাকে পরিবর্তন হতে সাহায্য করা যেতে পারে।
সাবস্টেন্স (মাদক) নেয়া শুরুর আগে আপনার জীবনটা কেমন ছিল?
এগুলো মনে পড়লে আপনি কেমন অনুভব করেন?
সাবস্টেন্স (মাদক) নেয়ার ফলে ভাল কি কি ঘটে? এর একটি তালিকা তৈরি করুন।
সাবস্টেন্স (মাদক) নেয়ার ফলে খারাপ কি ঘটে?
এভাবে যদি আপনি নিতেই থাকেন তবে সবচেয়ে ভাল কি বিষয়গুলো ঘটবে?
মনোনিবেশ (Contemplation)
এই পর্যায়ে সমস্যা, ক্ষতির বিষয়গুলো বুঝতে পারে এবং স্বীকার করে ফলে তার মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হয়। কিন্তু সেই সাথে তার মধ্যে একটা দ্বিধা বা দোদুল্যমনতা কাজ করে। এই পর্যায়ে তিনি সাহায্য চান। সুস্থ্যতা বিষয়ক তথ্য অনুসন্ধান করেন। কিন্তু এ পর্যায়েও তিনি সাবস্টেন্স ( মাদক) ব্যবহার করেন। অর্থাৎ তিনি দ্বিধা ও দোদুল্যমনতা  নিয়ে দীর্ঘদিন ব্যবহার করে যেতে পারেন। এক্ষেত্রে কিছু প্রয়োজনীয় প্রশ্ন করা যেতে পারে।
কি ঘটেছিল যা আপনাকে পরিবর্তন হওয়ার জন্য ভাবাচ্ছে?
বর্তমানে ভাল হওয়ার কি পথ আছে আপনার কাছে?
পরিবর্তন হওয়ার জন্য আপনার কি কোনো সাহায্যের প্রয়োজন আছে?
আপনি কি প্রস্তুত?
প্রস্তুতি(Preparation)
এই পর্যায়ে এসে সে সাবস্টেন্স (মাদক) ছাড়ার লক্ষ্য স্থির করে, পরিকল্পনা করে, ব্যবহারের মাত্রা কমায় এবং মাঝে মাঝে বন্ধ করে দেখে পারবে কিনা। চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ খবর নেয়। কিন্তু বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞান না থাকার কারণে তার এই প্রস্তুতি প্রক্রিয়া অনেক ক্ষেত্রেই সফল হয় না। এ পর্যায়ের জন্য কিছু প্রয়োজনীয় প্রশ্ন নিম্নরূপ।
পরিবর্তনের পক্ষে আপনার যে বাধা আছে তা অতিক্রম করতে আপনি কি প্রস্তুত?
সম্ভাব্য সমাধান গুলোর মধ্য থেকে আপনি একটিকে বেছে নিতে পারেন এবং আপনি কি তা চেষ্টা করবেন?
কি কারণে আপনি সম্ভাব্য সমাধানের জন্য সিদ্ধান্ত নিলেন?
পদক্ষেপ (Action)
এই পর্যায়ে কাজ শুরু করেন, আচরণের ব্যাপক পরিবর্তন হয়, পূর্বের ভূল-ত্রুটি সংশোধন করার চেষ্টা করেন। এক সাবস্টেন্স ( মাদক) ছেড়ে অন্য সাবস্টেন্স (মাদক) নেবার চেষ্টা করেন, যেটা তিনি কম ক্ষতিকর বলে মনে করেন। মাঝে মাঝে বন্ধও করে দেন। এছাড়া অনৈতিক আচরণ যেমনঃ চুরি, মিথ্যা ইত্যাদি বন্ধ করে দেন। সুন্দর- সুস্থ জীবনের পরিকল্পনা নিয়ে বন্ধু- বান্ধব, আত্মীয়- স্বজনের সাথে আলোচনা করেন। সাধারণত ৩-৬ মাস এই পর্যায়ে থাকে। নীচের প্রয়োজনীয় প্রশ্নগুলো প্রেষণা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
অভিনন্দন! এই পদক্ষেপগুলো নেয়ার জন্য আপনাকে কি কাজ করেছেন?
ভালোর দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য কোন বিষয়গুলো আপনাকে সাহায্য করতে পারে?
আমি কি আপনাকে সহযোগিতার জন্য কিছু করতে পারি?
বজায় রাখা (aintenance Stage)
এই পর্যায়ে এসে সম্পূর্ণরূপে মাদক ব্যবহার বন্ধ করে দেন। ইতোপূর্বে গ্রহণ করা পদক্ষেপ গুলো তিনি ধরে রাখেন। রুটিন মেনে জীবন-যাপন করেন। এই ধাপ যত ভাল হয় আরোগ্য লাভের সম্ভাবনা তত ভাল হয়। তবে এই পর্যায়ে এসেও তিনি আচরণে পুনরাবৃত্তি করতে পারেন। একবারের জন্য হলেও পুনরাবৃত্তি হতে পারে। তিনি আবার পূর্বের পর্যায়ে চলে যেতে পারেন। এক্ষেত্রে নিম্নের প্রশ্নগুলো করা যেতে পারে।
অভিনন্দন! যে কাজের মাধ্যমে আপনার জীবন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন এ ব্যাপারে আপনি কি ভাবছেন?
এক্ষেত্রে এমন কি কিছু করার আছে যা আপনাকে আরো ভালোর দিকে নিয়ে যেতে পারে?
কোন বিষয়গুলো আপনাকে সাহায্য করতে পারে?
পুনরাবৃত্তি (Relapse)
বন্ধ রাখা বা রিকভারী অর্জন করতে গিয়ে ব্যক্তির পুনরাবৃত্তি হয়ে যেতে পারে। এর অর্থ এই নয় যে, তিনি অঙ্গীকার থেকে সরে এসেছেন। ব্যর্থতা, হতাশা, নিরাশার অনুভূতি তৈরি হতে পারে। তিনি আবার প্রাক মনোনিবেশ এবং মনোনিবেশ পর্যায়ে চলে যেতে পারেন। কিছু প্রয়োজনীয় প্রশ্ন নিম্নরূপ।
কি ঘটেছিল যার কারণে আপনি আবার ব্যবহার করলেন?
এটা থেকে আপনি কি শিক্ষা অর্জন করলেন?
আপনি কি মনে করেন আরো অন্য কোনো উপায় আছে যা আপনাকে বিরত রাখতে সাহায্য করবে?
আমি কি আপনাকে সহযোগিতা করতে পারি?
সুতরাং উপরোক্ত আলোচনার মাধ্যমে আমরা দেখতে পাই যে, একজন রোগীর নিজের মধ্যেও বন্ধের চিন্তা বা প্রচেষ্টা থাকে। কিন্তু পর্যাপ্ত বিজ্ঞান ভিত্তিক জ্ঞানের অভাব, সচেতনতার অভাব, সহানুভূতি, সাহায্যের অভাবের কারণে সে আবারও পূর্বের ঝুঁকিপূর্ণ জীবন যাপনের দিকে চলে যেতে পারে। এ রোগের ক্ষেত্রে পুনরাবৃত্তি একটা বাস্তবতা আর এটা থেকেই শিক্ষার সুযোগ আসে পরবর্তীতে সুস্থ থাকার জন্য কিভাবে পথ চলতে হবে।
চলবে…


প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।

Previous articleশিশু কিশোরদের বিষণ্নতায় মিউজিক থেরাপি!
Next articleঅজানা মন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here