বিষণ্নতা এবং নেতিবাচক চিন্তা

0
179

জীবন একটি চলমান প্রক্রিয়া। এই চলার পথে নানা ধরনের ঘটনা, সমস্যা বা দ্বন্দ্বের সন্মুখীন হতে হয় প্রতিনিয়ত। বিরূপ ঘটনাকে মেনে নিতে না পারা, সমস্যা বা দ্বন্দ্বের সমাধান করতে না পেরে বিষণ্নচিত্তে জীবন অতিবাহিত করছে কত মানুষ। পত্রিকায় প্রায়ই আমরা দেখি যে বলা হয়ে থাকে ২০৩০ সাল নাগাদ রোগ হিসেবে বিষণ্নতা এক নম্বর স্থানে চলে আসবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কী এমন ঘটে মানুষের মনে যে এত বিপুল সংখ্যক মানুষ বিষণ্নতায় আক্রান্ত হচ্ছে বা হতে চলেছে?
বিখ্যাত বিজ্ঞানী অ্যারন বেক যিনি বিষণ্নতার চিকিৎসায় প্রভূত অবদান রেখেছিলেন। তাঁর তত্ত্বে আমরা দেখি নেতিবাচক চিন্তা ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি যখন বেড়ে যায় তখন মানুষের বিষণ্ন মুড দেখা যায়। আর যখন এসব নেতিবাচক চিন্তা কমে যায় তখন বিষণ্ন মুডও কমে যায়। নৈরাশ্যবাদী মনোভাব, একটু ভুলকেই বড় করে দেখার প্রবণতা মনকে করে তোলে বিপন্ন ও বিষণ্ন। নেতিবাচক চিন্তার প্রতি অধিক মনোযোগ দেয়া, ইতিবাচক চিন্তাকে গুরুত্ব না দেয়া আর নিখুঁতভাবে কোনো কিছু করার প্রবণতা, অতঃপর তা সেভাবে করতে না পারলে নিজেকে ব্যর্থ হিসেবে ধরে নেয় কেউ কেউ। একজন মানুষের নেতিবাচক এবং অকার্যকর মনোভাব, সকলের কাছেই ভালো হতে হবে, গ্রহণযোগ্য হতে হবে এমন প্রত্যাশা তাকে দ্বন্দ্ব বা চাপময় পরিস্থিতিতে ফেলে দেয়। ফলে অবাস্তব বিশ্বাসের ভিত্তি মজবুত হয়। আর এই বিশ্বাসগুলো তৈরি হয় শৈশবকালীন অভিজ্ঞতা থেকেই। যেমন- একটি শিশু তার বিকাশের পর্যায়ে যদি এই ধারণা নিয়ে বড় হয় যে, শুধুমাত্র যখন খুব বেশি ভালো করবে কেবলমাত্র তখনই পুরষ্কার পাবে। তখন অন্যের কাছে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য খুব বেশি ভালো করতেই হবে তার মধ্যে এমন একটা বিশ্বাস বা ধারণা জন্মলাভ করে। এই ধরনের দৃঢ় বিশ্বাস তাকে পরবর্তীতে বিষণ্নতার ঝুঁকিতে ফেলে দেয়। শৈশবের এই ধরনের চিন্তার মানসিকতা, আবেগ তার কার্যক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে। করে তুলে সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন।
বিজ্ঞানী বেক-এর মতে, নেতিবাচক চিন্তাগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে মনে আসতে থাকে। নিজেকে নিয়ে, পৃথিবীকে নিয়ে এবং অনাগত ভবিষ্যত কে নিয়ে এই নেতিবাচাক চিন্তাগুলো সৃষ্টি হয়। তার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোকে সে নেতিবাচক ভাবে বিচার এবং ব্যাখ্যা করে। পৃথিবীটা তার কাছে জটিল এবং ব্যবহার অযোগ্য বলে মনে হতে থাকে। জীবনকে বয়ে নিয়ে যাওয়া তার কাছে একটা কষ্টকর পরিস্থিতি বলেই মনে হয়। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তার আশাহীন অবস্থার সৃষ্টি হয়। সে ভাবে ভবিষ্যতে সে ব্যর্থ হবে। আর এই নৈরাশ্য বা আশাহীন অবস্থা যখন অধিক পরিমাণে হয় তখন সে বেঁছে নিতে পারে আত্মহত্যার পথ।
যাইহোক, শৈশবের বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা যেমন একজন ব্যক্তির জীবনে ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে তেমনি পরবর্তী জীবনের ঘটনাবলী, তাৎক্ষণিক কিছু কারণসহ ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব, বংশগতিসহ নানাবিধ জৈবিক কারণ বিষণ্নতার জন্য দায়ী থাকে। বিষণ্নতার লক্ষণসহ নানাবিধ আলোচনা স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। তথাপি গুরুতর বিষণ্নতার লক্ষণের ক্ষেত্রে দেখা যায় প্রতিদিন তার মন খারাপ থাকে। মনের মধ্যে খালিখালি অনুভূতি বা গভীরে দুঃখবোধ কাজ করে। চোখ অশ্রু-সজল থাকে। কাজ-কর্মের প্রতি আগ্রহ বা আনন্দের ঘাটতি দেখা যায় এবং অন্যরা সেটি বুঝতে পারে। শরীরের ওজন একসাথে শতকরা ৫ ভাগের পরিমাণ বেড়ে বা কমে যেতে পারে। রুচির হ্রাস বৃদ্ধি ঘটে। নিদ্রাহীনতা বা অতিনিদ্রা দেখা দেয়। মনোদৈহিক অস্থিরতা বা স্থবিরতা, অতিমাত্রায় ক্লান্তি বা শক্তিহীনতা দেখা যায়। মূল্যহীন অনুভূতি, অপরাধবোধ সৃষ্টি হয়। মনোযোগের ক্ষমতা কমে যায়। মৃত্যুর চিন্তা, আত্মহত্যার চিন্তা সহ আত্মহত্যা করার পরিকল্পনা এবং প্রচেষ্টা নেয়। এই ধরনের লক্ষণগুলোর কারণে সামাজিক, পেশাগত এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজের ক্ষেত্রে বিঘ্ন বা সমস্যার সৃষ্টি হয়।
তাই আমাদের এই মহামূল্যবান জীবনকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্ত থেকে রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে আমাদেরকেই। অভিভাবকের সচেতনতা এক্ষেত্রে খুবই জরুরি। রোগীকে মনোচিকিৎসার আওতায় আনতে হবে। ঔষধ খেতে হবে আর নেতিবাচক চিন্তার বলয় থেকে বের করে আনতে প্রয়োজন সাইকোথেরাপি বা কাউন্সেলিং-এর।


প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।

Previous articleভার্চুয়াল জগতের প্রতি আসক্তি মানুষকে একাকী ও বিষণ্ন করে তোলে
Next articleকানাডায় তরুণদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র খোলা হচ্ছে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here