বিশেষ শিশু: তাদের বিষণ্ন ও বিপন্ন অভিভাবকগণ

গত কয়েক দশক ধরে একটু একটু করে বাড়ছে বিকাশগত বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা ও মানসিক প্রতিবন্ধিতা বিষয়ক সচেতনতা। পাশাপাশি বেড়েছে রোগ নির্ণয়ের হার। একটা  সময় ছিল যখন এ বিশেষ শিশুদের নিয়ে আলাদাভাবে কোনো চিন্তা ভাবনা করা হতো না। পরিবারের অন্য শিশুদের সাথেই থাকতো, ধরে নেয়া হত আল্লাহ্‌ তায়লার দান, কি আর করা। আসলে এভাবেই সান্তনা পেত মা-বাবা। কিন্তু সময় বদলেছে, এখন পরিবারে সন্তানই থাকে একটি বা দুটি। তাই মা বাবার আশা আকাঙ্ক্ষা সব ওদের ঘিরেই।
একজন তরুণ বাবা-মা যখন জানতে পারেন তার অতি আদরের স্বপ্ন সন্তানটির স্বাভাবিক বিকাশের ঘাটতি রয়েছে, অর্থাৎ বিশেষ শিশুর তকমাটি তার গায়ে সেঁটে দেয়া হয় তখন সে বাবা-মার অবস্থা সহজেই অনুমেয়। তারা দিন-মাস-বছর ধরে লড়াই করতে করতে ক্লান্ত আর হতাশ হয়ে পড়েন। ক্রমশঃ তাদের অনেকের মধ্যে তৈরি হয় কিছু নেতিবাচক ধারণা। যেমন-
বাবারা মনে করেন এ বাচ্চার কারণে তিনি আরও উচ্চ পদে যেতে পারছেন না।
মা ভাবেন তার এত পড়াশুনা জলে গেল, তিনি এরকম সন্তানের কারণে চাকুরি করতে পারছেন না।
এ শিশুর কারণে বাড়িওয়ালা বাসা ভাড়া দিতে চান না।
বাইরে গেলে সবাই বাবুর দিকে কেমন ভাবে তাকায়।
তারা জনারন্যে  গিয়ে শান্তি পান না।
সামাজিক অনুষ্ঠানে স্বতস্ফুর্ত অংশ গ্রহণে বঞ্চিত।
সামাজিক ভাবে উজ্জ্বল জীবন যাপন থেকে ছিটকে পড়েছেন।
দাদা-দাদি ভাবেন-কূল প্রদীপ রইলনা।
মা বেচারির বাড়তি কিছু জোটে-বৈজ্ঞানিক ভিত্তি থাকুক আর নাই থাকুক এরকম শিশুর জন্ম দেয়ার পুরো দায় অনেক সময় তার উপর বর্তায়।

মনের মত ঘর সাজাতে পারেন না, ঘরে সারাক্ষণ অশান্তি।
এরকম ছোট বড় অসংখ্য মনোবেদনা তাদের দৈনন্দিন জীবনকে মাত্রাতিরিক্ত বিপর্যস্ত করে তোলে।

যেন এক পরিবারের সকল না পাওয়ার দায় ঐ নিষ্পাপ শিশুটির। কিন্তু একটু নিরপেক্ষ ভাবে ভাবুনতো যে পরিবারে এরকম বিশেষ শিশু নেই তারা কি নিরবিচ্ছিন্ন শান্তিতে আছেন? না নেই। অবশ্যই একটি বিশেষ শিশুর উপস্থিতি একটি পরিবারে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা অনেকাংশেই পরিবর্তন করে দেয়। আবার এও সত্যি যে সময়ের পরিক্রমায় অন্যান্য বিভিন্ন আকস্মিক এবং অনাকাংখিত ঘটনাও আমাদের স্বপ্নের জীবনের গতিপথ পাল্টে দিতে পারে। বরং এসব শিশুদের উপস্থিতি আমাদের সংসার জীবনের প্রথম থেকেই কঠিন পথ পাড়ি দেয়ার সূচনা করে, মানসিক ভাবে শক্ত করে তোলে।
বাবারা চিন্তা করুন-চাকুরিতে উচ্চ পদের সংখ্যা সীমিত। সকল স্বাভাবিক শিশুর বাবারা কি উচ্চ পদে যেতে পারেন? মা একবার ভাবুন, আপনার মত অনেক উচ্চ শিক্ষিত মহিলা আজও নানা পারিবারিক প্রতিকূলতায় এবং চাকুরির অভাবে গৃহবধূ হিসেবে আছেন, তাদের সবার কিন্তু এরকম সন্তান নেই, আবার বিশেষ শিশু নিয়েও অনেক সফল মা আছেন। অর্থাৎ সফলতার একমাত্র নির্ধারক একটি সুস্হ বা অসুস্হ শিশুই নয়। এখানে বিভিন্ন বিষয় অনুঘটক হিসেব কাজ করে।
বাড়ি ভাড়ার বিষয়টি স্পর্শ কাতর তবে সব বাড়িওলাই নিরাশ করেন না, আবার আমরাও অনেক বাড়ি পছন্দ করিনা, সবার নিজস্ব কিছু হিসেব নিকেশ আছে, এটি সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। মনে রাখবেন বিশেষ শিশুর অভিভাবক না হলেও আপনি ভাড়াটিয়া হিসেবে সবসময় গ্রহণযোগ্য হবেন এমন নিশ্চয়তা কিন্তু নেই। তাই এ বিষয়ে বাড়তি দুঃখ ত্যাগ করাটাই শ্রেয়।
সমাজে তারকার উজ্জ্বলতা ছড়ায় অতি অল্প মানুষ। আপনার অনুজ্জ্বলতার জন্য এ সন্তানটিকে দায়ী ভাবার আগে আপনার যোগ্যতা সর্ম্পকে একবার আত্মবিশ্লেষন করুন।
আপনার বিশেষ শিশু নিয়ে যখন আপনি বাইরে যান তা হোক শপিং মল, রাস্তা অথবা পারিবারিক কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানে তখন ‘কেমন ভাবে তাকায়’ বিষয়টি ঘটে। এটি ব্যতিক্রম কিছুর প্রতি মানুষের একটি প্রাথমিক ও সাধারণ প্রতিক্রিয়া। এটি আমাদেরও হয়। তবে পরবর্তী  প্রতিক্রিয়াটি স্বাভাবিক হওয়া কাম্য। অনাকাংখিত আচরণের বিষয়ে মনে রাখতে হবে আমাদের সমাজের যত্রতত্র  অনধিকার চর্চার বিষয়টি এখনও কমবেশি চলছে। শান্তভাবে বুঝিয়ে বলুন।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মা’দের ভোগান্তি বেশি। কারণ তারাই সন্তানের সাথে বেশি সময় কাটান। সন্তান নিয়ে হতাশা তো আছেই তার উপর অনেক পরিবারে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা এ  সন্তানের অস্বাভাবিকতার দায় তার উপর চাপিয়ে ভারমুক্ত হতে চান। এটি হাজার বছর ধরে চলে আসা দোষারূপ পদ্ধতি ও সুশিক্ষার অভাব মাত্র। দূর হতে সময় লাগবে। এ ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই ধৈর্য্য ধরে যুক্তি দিয়ে শোভন ভাবে বিষয়গুলো বুঝিয়ে বলুন। ব্যাখ্যা করুন, এ ত্রুটির জন্য আপনার বিশেষ কোনো ভূমিকা নেই এবং এ ধরনের সমস্যা একক কোনো কারণে হয় না।
মনের মত ঘর সাজানোর বিষয়টি আপেক্ষিক। তবে অশান্ত পরিবেশকে আয়ত্তে আনার জন্য অবশ্যই প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।
কিছু বিষয় মাথায় রাখুন-যখন আপনি অথবা পরিবারের অন্য সদস্যরা একটি ছোট্ট শিশুর মধ্যে কোনো  বিকাশগত অথবা আচরণগত অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করবেন তখন ‘বাচ্চাদের এরকম একটু হয়ই, বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে’ এ ধরনের মনোভাব পোষন না করে একবার  সংশ্লিষ্ট বিষয়ের চিকিৎসকের কাছে নিয়ে বিভ্রান্তি দূর করুন।
সঠিকভাবে কোনো রোগ নির্ণীত হলে এটি যত দ্রুত সম্ভব মন থেকে মেনে নিন। “এটি কোনো রোগ নয়/আমাদের জন্য আর্শীবাদ”-দয়া করে এ জাতীয় প্রচারে বিভ্রান্ত হবেন না। কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব না রেখে বাস্তবতার মুখোমুখি হোন। কেননা যত দ্রুত মেনে নিয়ে আপনি পরবর্তী পদক্ষেপ নিবেন শিশুর উন্নতির সম্ভাবনাও তত বেশি।
শিশুটির অস্বাভাবিক আচরণের ধরনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবস্থাপনা/চিকিৎসা কোথায় কিভাবে পাবেন তার তথ্য সংগ্রহ করুন এবং আপনার সঙ্গতির সাথে তাল রেখে এগিয়ে যান। মনে রাখবেন প্রতিটি শিশুর অস্বাভাবিকতার ধরন ও মাত্রা অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন পরিকল্পনা ও কর্মসূচি নিতে হয়। নিবিড় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তার ব্যক্তিগত কাজ ও সামাজিক দক্ষতা তৈরি হয়। এ বিষয়টি দীর্ঘ মেয়াদি।
অতিরিক্ত অস্থিরতা বা উত্তেজনার জন্য এ বিষয়ের সংশ্লিষ্ট  চিকিৎসকের পরামর্শে প্রয়োজনে স্বল্প মেয়াদে ঔষধ দিতে হবে। ঔষধের সাধারণ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার (বেশি ঘুম, পায়খানা কষা অথবা মোটা হয়ে যাওয়া ইত্যাদি) জন্য অনেকেই ঔষধ খাওয়াতে চান না। মনে রাখবেন  অস্থির ও  উত্তেজিত শিশুর পক্ষে যেমন প্রশিক্ষণে নিবিড় মনোযোগ দেয়া সম্ভব নয় তাই তাদের শেখাটাও ব্যাহত হয়।
পরিকল্পনা করে তাকে বাইরে নিয়ে যাবেন। যাবার কয়েকদিন পূর্ব থেকে দিন-তারিখ -সময়, সম্ভাব্য যানবাহন ও সঙ্গীদের বর্ণ না দিবেন। কত সময় থাকবেন, সেখানে কারা থাকবেন, কি থাকবে, কি করবেন এগুলো আগেই জানাবেন এবং সম্ভব হলে ছবি দেখাবেন। এভাবে বার বার বললে তার মানসিক প্রস্তুতি তৈরি হয়। ঠিক একই ভাবে আসবাবপত্র/বাসা পরিবর্তন/আপনার বাসায় আগত অতিথি সম্পর্কে আগাম ধারণা দিলে ভাল হয়। ও কিছু বোঝেনা এ ধারণাটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সঠিক নয়।
অভিভাবকরা যদি সারাক্ষণ এ সন্তানকে নিয়েই চিন্তা করেন এবং ব্যস্ত থাকেন তবে সহজেই ক্লান্ত হয়ে পড়বেন। আপনার যদি আরেকটি সন্তান থাকে তবে খেয়াল রাখবেন সে যাতে কোনোভাবে বঞ্চিত না হয়। কারণ এ বঞ্চনা তার মধ্যে বিশেষ ভাই/বোনটির প্রতি অকারণ ক্ষোভ তৈরি করতে পারে।
প্রতিদিনের চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে একটু সময় হলেও নিজের জন্য আলাদা করে রাখুন। নিজেকে সতেজ করুন। এটি আপনার কর্মস্পৃহা বাড়াবে।
মা যদি চাকুরীজীবি হন তবে হুট করে চাকুরী ছাড়বেন না। চাকুরী ছেড়ে যদি সারাক্ষণ মনে হতে থাকে  ‘ওর (শিশু) জন্য আমাকে চাকুরী ছাড়তে হয়েছে তবে তা আপনাকে হতাশায় ফেলবে এবং তার নেতিবাচক ফলাফল একসময় শিশুর উপরও পড়বে। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে সুসম্পর্ক থাকলে তারাও সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারেন। ‘তারা কেন আমার সমস্যা বোঝেনা’ এ ধরনের অভিমান বাদ দিয়ে সমস্যা খুলে বলুন ও সাহায্য চান।
বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র/বিশেষ সুবিধা যুক্ত/মূলধারার স্কুল যেখানেই সম্ভব তাদের যুক্ত করুন। তাতে তারা যেমন গঠনমূলক ভাবে শিখবে তেমনি আপনারাও কিছু সময় অন্যদিকে নিশ্চিন্তে ব্যয় করতে পারবেন। এছাড়া নিজে প্রশিক্ষণ নেয়াটাও জরুরি। আপনার মত অন্য অভিভাবকদের সাথে যোগাযোগ রাখুন, সমস্যায় পড়লে অভিজ্ঞতা বিনিময় করুন।
সবসময় আপনার এ সন্তানটি নিয়ে যে কোনো স্থানে (নিকটজন ব্যতীত) অতি আবেগপূর্ণ আচরণ থেকে বিরত থাকা ভাল। কারণ বেশিরভাগ মানুষই কিছু ‘আহারে’ জাতীয় বাক্য ছাড়া কোনো কাজে আসেনা, বরং আড়ালে অনেকে বিরূপ মন্তব্যও করেন।
আপনার নিজের উদ্বেগ/হতাশা/রাগ/ক্ষোভ/ঘুম ইত্যাদি আয়ত্তে আনতে না পারলে মানসিক স্বাস্হ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন। কেননা আপনার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক না থাকলে তা বিশেষ শিশুতো বটেই পুরো পরিবারের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করবে।
এ ছাড়াও অন্যের সুস্থ শিশু দেখে হা-হুতাশ করে কষ্ট পাওয়া কমিয়ে দিন। মনে রাখবেন একটি বিশেষ শিশুকে যত স্বাভাবিক জীবন যাপনের দিকে নিয়ে যেতে পারবেন তার কৃতিত্ব একজন সুস্থ শিশুর বাবা-মায়ের থেকে অনেক বেশি।


প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।

Previous articleপ্রসব পরবর্তী মানসিক সমস্যা- সাইকোসিস
Next article“মানসিক স্বাস্থ্য সেবা খাতে রাষ্ট্রের আরো অর্থ বিনিয়োগ চাই” আইনজীবিদের আবেদন
সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here