প্রিয়জনের সংর্স্পশ’ই পারে বার্ধক্যের একাকীত্ব দূর করতে – মরমী কবি সাবির আহমেদ চৌধুরী

বাংলা সাহিত্যের নিভৃতচারী এক কিংবদন্তী তিনি। তিনি বিশ্ব মানবতার কবি। তিনি মরমী ও আধ্যাত্মিক ভাবনার কবি। লেখনির মাধ্যমে তিনি মানব মনে মনুষত্ব্যের বিকাশ ও মানবতাবোধ জাগিয়ে তোলেন। তাঁর লেখা বেশ কিছু বই ও প্রবন্ধ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য তালকিায় স্থান পেয়েছে। ৯৫ বছর বয়সেও তিনি প্রাণবন্ত এবং নিরন্তরভাবে মানবতার কল্যাণে সাহিত্য সাধনায় কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থসংখ্যা ১৯টি।  এ পর্ন্তত তিনি রচনা করছেনে ২০০০ গান, অসংখ্য কাব্য, গীতিনাট্য, সমাজ সংস্কারমূলক বই । তাঁর জীবন ও কর্মের  উপর দেশ ও বিদেশের লেখকরা লিখেছেন ২৪ টি গ্রন্থ। তিনি বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের কর্মী , ভাষাসৈনিক, মুক্তযুদ্ধের সংগঠক মরমী কবি সাবির আহমেদ চৌধুরী।  মনের খবর তারকার মন বিভাগের এবারের পর্বে পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল এই মহতারকার সাথে আলাপচারিতার কিছু অংশ। কথা বলেছেন মনের খবর প্রতিনিধি মো. মারুফ খলিফা

মনের খবর: কেমন আছেন?
মরমী কবি সাবির আহমেদ চৌধুরী: ভালো আছি।

মনের খবর: এত বছর বয়সেও একবাক্যে ভালো আছি বলে ফেলতে পারেন, এর জন্য কোনটির ভূমিকা সবচেয়ে বেশি বলে মনে করেন?
মরমী কবি সাবির আহমেদ চৌধুরী: এর জন্য সৃষ্টিকর্তার করুণা এবং তারপর আমার নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনই সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে বলে মনে করি।

মনের খবর: আপনার লেখালেখির শুরু সর্ম্পকে যদি একটু বলতেন।
মরমী কবি সাবির আহমেদ চৌধুরী: এটা আসলে অনেক বিস্তৃত। গ্রামীণ আবহ এবং পারিবারিক আবহ সবমিলে সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ আমার ছোটবেলা থেকেই। আমার পড়ালেখা শুরু গ্রামের বাড়িতেই। তখন আমাদের ওখান থেকে সবুজ বাংলা নামে একটি পত্রিকা বের হত। আমার বড় ভাই সেখানে লিখতেন। সেখানে ক্লাশ ফোরে পড়ার সময় আমার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। তখন সবাই সেই কবিতার খুব প্রশংসা করলেন। সেই থেকে নিয়মিত কবিতা চর্চার আগ্রহটা আরও বেড়ে গেল।

মনের খবর: লেখালেখির ক্ষেত্রে আপনি মন দ্বারা কতটা প্রভাবিত?
মরমী কবি সাবির আহমেদ চৌধুরী: সে সবচেয়ে ভালো লেখক যে নিজের সমালোচনা করতে পারে। আমি যখন কোন কিছু লিখি তখন সহজে কলম ধরি না। আগে বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করি, তারপর মন যেভাবে সায় দেয় সেভাবে লিখি।

মনের খবর: আপনার লেখা মানুষের মনকে কিভাবে প্রভাবিত করে?
মরমী কবি সাবির আহমেদ চৌধুরী: প্রত্যেক লেখকেরই একটা নিজস্ব ধরণ থাকে, স্বকীয়তা থাকে। নিজের মত করে লেখার স্বাধীনতা সবারই আছে। তবে লেখকের লেখা যদি আমার দেশের ১৫ আনা মানুষ তথা সাধারণ মানুষ বুঝতে না পারে তাহলে লেখকের স্বার্থকতা নেই বলে আমি মনে করি। আমি চেষ্টা করি সাধারণ মানুষের জন্য সহজবোধ্য এবং সহজপাঠ্য ভাষায় লিখতে।

মনের খবর: আপনার তো অনেক অর্জন, নিজের কোন অর্জনকে এগিয়ে রাখবেন?
মরমী কবি সাবির আহমেদ চৌধুরী: আমার আসলে কোন অর্জন নেই বলে আমি মনে করি। তবে আমার অনেক চাওয়া আছে, আমার সবচেয়ে বড় চাওয়া হল; মানুষের বসবাসের জন্য পৃথিবী শান্তিময় হোক।

মনের খবর: শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সবচেয়ে জরুরি কি বলে মনে করেন?
মরমী কবি সাবির আহমেদ চৌধুরী: বনের পশুরা একসাথে মিলে বাসা করতে পারে। কিন্তু মানুষ সেটা পারে না, মানুষ সামান্য স্বার্থের জন্য মানুষকে হত্যা করছে। মানুষ স্রষ্টার সেরা সৃষ্টি, শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। মানুষ বদলালেই কেবল পৃথিবী বদলাবে।

মনের খবর: আপনার পূর্ণতার পাল্লা ভারী, এরপরও কোন অপূর্ণতা আছে কি?
মরমী কবি সাবির আহমেদ চৌধুরী: আমি মানুষের কল্যাণে অনেক বেশি কাজ করতে চেয়েছি। তার সবটা হয়তো করে যেতে পারিনি, এটাই আমার সবচেয়ে বড় অপূর্ণতা। আমি বিশ্বাস করি মানুষের সবচাইতে বড় শক্তি জ্ঞান। আর সমাজে এই জ্ঞান বিতরণ করেন শিক্ষকরা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে আমাদের দেশে শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা অনেক কম, অন্য চাকরির তুলনায় তাদের সুযোগ সুবিধাও কম। আমাদের দেশে শিক্ষকদের সার্বিক মর্যাদা এবং তাদের সুযোগ সুবিধা যেন বৃদ্ধি পায়, এটা আমার সবসময়ের চাওয়া ছিল। এটি এখনও পূরণ হয়নি।

মনের খবর: আপনার ভালো লাগা মন্দ লাগা সর্ম্পকে কিছু বলুন।
মরমী কবি সাবির আহমেদ চৌধুরী: আমার ভালো লাগা মন্দ লাগা দুটোই মানুষকে ঘিরে। যা কিছু মানুষের জন্য কল্যাণকর তা আমার ভালো লাগে আর যা কিছু মানুষের জন্য ক্ষতিকর তা আমাকে ব্যথিত করে।

মনের খবর: ভালো মানুষ হওয়ার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় গুন কোনটি বলে মনে করেন?
মরমী কবি সাবির আহমেদ চৌধুরী: ভালো মানুষ হওয়ার জন্য মনের শুদ্ধতা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। মন শুদ্ধ না হলে কারো পক্ষে ভালো কাজ করা সম্ভব নয়।

মনের খবর: মনকে শুদ্ধ রাখার জন্য করণীয় কি বলে মনে করেন?
মরমী কবি সাবির আহমেদ চৌধুরী: মনকে শুদ্ধ রাখার জন্য সবচেয়ে জরুরী হচ্ছে সুন্দর চিন্তা করা, যেকোন ভালো কাজের সাথে জড়িত হওয়ার চেষ্টা করা, মানবিক হওয়া এবং ভালো ভালো বই পড়া। মনের শক্তি সবচেয়ে বড় শক্তি, যেকোন সফলতার জন্য মনে শক্তি রাখাটা জরুরী।

মনের খবর: আপনার লেখায়ও এই বিষয়গুলি প্রাধন্য পায়, আপনার মতে ন্যয়, নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধ এগুলি কি চর্চার মাধ্যমে বিকশিত করা সম্ভব?
মরমী কবি সাবির আহমেদ চৌধুরী: অবশ্যই সম্ভব। তার জন্য পারিবারিক শিক্ষা, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সেই সাথে সামাজিক রীতি নীতিও একটা বড় ভূমিকা এখানে পালন করতে পারে।

মনের খবর: লেখালেখিতে আপনার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা কি?
মরমী কবি সাবির আহমেদ চৌধুরী: আমার একাগ্রতা, সময়ানুবর্তিতা, পাঠাভ্যাস, মানব প্রেম এগুলোই আমার লেখার জন্য সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা।

মনের খবর: স্মৃতিকাতরতা আছে?
মরমী কবি সাবির আহমেদ চৌধুরী: আমার স্মৃতিশক্তি খুব প্রখর।  আমি আমার জীবনে দেখা বিভিন্ন সময়কে স্পষ্টতই স্মরণ করতে পারি।  লেখার জন্য সেখান থেকে উপকরণ সংগ্রহ করি। এটাকে আসলে স্মৃতিকাতরতা বলা যাবে না। আমি বিশ্বাস করি প্রতিটা সময়েরই একটা নিজস্ব সৌন্দর্য আছে, তাই আমি চলমান সময় থেকে শিক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করি সময়ের অগ্রগতি এবং অবনতি বিশ্লেষণের চেষ্টা করি।

মনের খবর: রাগ, ক্ষোভ , অভিমান আপনার মধ্যে কেমন আছে?
মরমী কবি সাবির আহমেদ চৌধুরী: রাগ, ক্ষোভ , অভিমান এই বিষয়গুলি বোধহয় সব মানুষের মধ্যে কম বেশি থাকে। এরপর সেটা সময় এবং বয়সের সাথে পরিবর্তিত হয়। কিন্তু আমার মধ্যে এই ব্যাপারগুলি সবসময়ই কম ছিল। এর পেছনে বড় কারণ ছিল বোধহয় মানব প্রেম। আমি মানুষকে প্রচন্ড পরিমাণে ভালোবাসি তাই এইসব নেগেটিভ বিষয়গুলি আমার মধ্যে প্রশয় পায়নি।

মনের খবর: আমরা জানি যে বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের একাকীত্ব বাড়তে তাকে। আপনার বয়স এখন ৯৫ বছর। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বার্ধক্য এবং একাকীত্ব বিষয়ে কিছু যদি বলতেন।
মরমী কবি সাবির আহমেদ চৌধুরী: বার্ধ্যকে মানুষের শরীর এবং মনে অনেক ধরনের রোগ বাসা বাধে। আমি বলি বার্ধ্যক্য নিজেই একটা রোগ। আল্লাহর রহমতে আমি এই বয়সে অন্যদের তুলনায় কম রোগ শোকে আছি। এর পেছনে আল্লাহর কৃপা এবং আমার নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করি। আর একাকীত্ব এই সময়ে স্বভাবতই মানুষকে ঘিরে ধরে।  কারণ, এই সময়ে তাদের আশেপাশে মানুষের সংখ্যা কমে যায়। আমাদের দেশেই প্রায়ই দেখা যায় বার্ধ্যক্যে মানুষ একদমই একা হয়ে যায়। তাই প্রত্যেক মানুষেরই উচিত বার্ধ্যকের সময়টা কিভাবে কাটাবে তার জন্য পূর্ব প্রস্তুতি রাখা।  আর বার্ধ্যক্যের একাকীত্ব মোকাবেলায় স্বজনদের সংর্স্পশ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। জীবন ও জীবিকার জন্য ছেলে মেয়ে বা অন্যান্য নিকটজনেরা হয়ত দূরে থাকতে পারেন। তবে সংস্পর্শের জন্য দূরত্বটা প্রতিবন্ধকতা নয়। নিয়মিত যোগাযোগটাই বড় কথা। এই যোগাযোগ তথা প্রিয়জনের সংর্স্পশ বার্ধক্যের একাকীত্ব দূর করতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে।  আর আমি যেহেতু এখনও লিখতে পড়তে পারি। তাই আমার ভেতরে একাকীত্ব বোধটা এখনও সেভাবে ভর করতে পারেনি।

মনের খবর: মন তো নিশ্চয়ই খারাপ হয়।  এই বয়সেও যখন মন খারাপ হয় তখন মন ভালো করার জন্য কি করেন?
মরমী কবি সাবির আহমেদ চৌধুরী: আমার সবচেয়ে বড় অস্ত্র হচ্ছে লেখালেখি। মন খারপ হলে লেখালেখি বা পড়ায় মনোনিবেশ করার চেষ্টা করি। আর তার আগে মন খারাপের কারণ বিশ্লেষণের চেষ্টা করি।

মনের খবর: লেখালেখির ক্ষেত্রে মনের সুস্থতা কতটা জরুরী বলে মনে করেন?
মরমী কবি সাবির আহমেদ চৌধুরী: মানসিক সুস্থতা ছাড়া ভালো লেখালেখি স¤ভব নয়। সাধারণ অর্থে আমরা মানসিকভাবে অসুস্থকে পাগল বলেই বিবেচনা করি। একজন মানসিক অসুস্থ কিংবা পাগল লোক কখনও সমাজের কল্যাণে মানবতার কল্যাণে ভালো কিচু লিখতে পারে না। শুধু লেখালেখি নয়, শারীরিক সুস্থতার জন্যও মানসিক সুস্থতা সবচেয়ে জরুরী বলে আমি মনে করি।

মনের খবর: আপনি জীবনে অনেক আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন। রাজপথের আন্দোলন, বন্দুকের সামনে আন্দোলন, লেখালেখি সবমিলে কখনও অতিরিক্ত মানসিক চাপ বোধ করেছেন কিংবা কাউন্সেলিং এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন?
মরমী কবি সাবির আহমেদ চৌধুরী: বর্তমান দ্রুত পরিবর্তনশীল এবং প্রতিযোগিতা মূলক পরিবেশের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে কাউন্সেলিং অপরিহার্য। আমাদের দেশে মানুষ মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে একটু কম সচেতন। তাই আমাদের সময়ে কাউন্সেলিং ধারণাটাই মানুষের ছিল না। তাই প্রয়োজন থাকলেও মানুষ বুঝত না যে এই সময়ে কাউন্সেলিং পেলে সে প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে পারত। আমি অনেক সময় কাউন্সেলিং এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেও তখন আমাদের দেশে ওরকম সুযোগ না থাকাতে নেওয়া হয়নি।

মনের খবর: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কিছু বলুন?
মরমী কবি সাবির আহমেদ চৌধুরী: আল্লাহ আমাকে যতদিন বাঁচিয়ে রাখেন আমি সব মানুষের শান্তিপূর্ণ বসবাসের জন্য লিখেই যাবো। আর যতটুকু সার্মথ্য আছে তার সর্বোচ্চ দিয়ে মানুষের জন্য কল্যাণকর কাজ করে যাব।

মনের খবর: ভালোবাসা এবং স্বপ্ন ব্যাপারটিকে কিভাবে দেখেন?
মরমী কবি সাবির আহমেদ চৌধুরী: ভালোবাসা মানুষের জীবনের অপরিহার্য উপাদান। আমরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মানুষ কিংবা স্রষ্টার সৃষ্টি প্রেমে পড়ি। ভালোবাসার কোন স্থান, কাল, পাত্র, বয়সের সীমাবদ্ধতা নেই। ভালোবাসা আছে বলেই পৃথিবী সুন্দর। আর স্বপ্ন ছাড়া সাফল্য অর্জন কতরা সম্ভব নয়। স্বপ্ন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, স্বপ্নহীন মানুষ মূল্যহীন।

মনের খবর: আমাদের দেশে মানসিক স্বান্থ্য বিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধিতে করণীয় হিসেবে কোন পরামর্শ দিবেন কি?
মরমী কবি সাবির আহমেদ চৌধুরী: মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতার জন্য প্রচারণার বিকল্প নেই। বই, পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি, টেলিভিশনে এই সমস্ত বিষয়ে বেশি বেশি প্রচারণার মাধ্যমে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

মনের খবর: মনের খবরকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মরমী কবি সাবির আহমেদ চৌধুরী: মনের খবরকেও ধন্যবাদ। মানসিক স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়নে তারা অনেক বড় ভূমিকা রাখবে বলে আশা করি।

Previous articleঅভিবাসন কী অসুস্থ করে তুলতে পারে!
Next articleবয়ঃসন্ধিকালে অভিজ্ঞতা থেকে শেখায় মস্তিষ্ক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here