প্রসব পরবর্তী মানসিক সমস্যা- সাইকোসিস

প্রসব পরবর্তী সময়ে মায়েদের যেসব মানসিক সমস্যা হয় তার মাঝে ‘পোস্টপার্টাম সাইকোসিস’ সবচেয়ে কম হলেও, সমস্যার মাত্রা ও তীব্রতায় এটি সবচেয়ে ভয়াবহ। এ সমস্যায় মা ও শিশু দুজনের ক্ষতির সম্ভাবনাও সবচেয়ে বেশি। জীবনও ঝুকিপূর্ণ হতে পারে। প্রয়োজনীয় এবং সময়মতো চিকিৎসার আওতায় না আনালে দুজনেরই মৃত্যু কিংবা অপমৃত্যু দুধরনের আশঙ্কাই থেকে যায়। সুতুরাং এটিকে অবশ্যই বুঝতে হবে এবং সময় মতো সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
প্রসব পরবর্তী মায়েদের বিভিন্ন মানসিক সমস্যা হতে পারে। তীব্রতাভেদে এসব সমস্যার মাত্রা কমবেশি হলেও কোনটিকেই অবহেলা করার সুযোগ নেই। ‘পোষ্টপার্টাম সাইকোসিস’ রোগটি সবচেয়ে কম হলেও সমস্যা ও তীব্রতার মাত্রার দিক থেকে এটি সবচাইতে বেশি ভয়াবহ। ‘পোষ্টপার্টাম সাইকোসিস’-এ মা ও সন্তান উভয়েরই ক্ষতির সম্ভাবনা সবচাইতে বেশি।
পোষ্টপার্টারম সাইকোসিস বা পিউরপেরাল সাইকোসিস কি?
পরিসংখ্যানে দেখা যায় গড়ে প্রতি ১০০০ প্রসবের মাঝে ১ কিংবা ২ জন এ সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে থাকে। এই সমস্যাটির প্রকাশভঙ্গি বিভিন্ন রকম হয়ে থাকতে পারে এবং রোগের ধরনের মধ্যে অনেক নাটকীয়তা থাকে। সাধারণত সন্তান জন্মদানের প্রথম দু’সপ্তাহের মধ্যে সমস্যা শুরু হয়। তবে সন্তান প্রসবের তিন মাসের মধ্যে যেকোনো সময়ের মধ্যে রোগটি হতে পারে। রোগটি রোগীকে এতটাই নাটকীয় ভঙ্গিতে আক্রান্ত করে যে ৪৮ থেকে ৭২ ঘন্টার মধ্যে রোগীর সমস্যা শুরু হতে পারে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগীকে ভুল বোঝার একটা সম্ভাবনা তৈরি হয়।
লক্ষণ
প্রথমদিকে অস্থিরতা, বিরক্তি অথবা ঘুমের সমস্যা দিয়ে শুরু হওয়া এ সমস্যাটি রোগীর মানসিক অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন ঘটায়। এই হাসি তো এই কান্না অথবা হঠাৎ অস্বাভাবিক কোনো আচরণ দিয়ে রোগটি প্রকাশ পেতে শুরু করে। অকারণে ক্ষেপে যাওয়া, উত্তেজিত হয়ে যাওয়া, মানুষজনকে মারতে যাওয়া বা দ্রুত এদিক সেদিক ঘোরাফেরারসহ রোগীর সার্বিক আচরণে এক ধরনের উত্তেজনা সবসময় লক্ষ্য করা যেতে থাকে। এদের অনেকের মধ্যেই এমন বিশ্বাস পোক্ত হয় যে, কেউ তাকে বা তার সন্তানকে মেরে ফেলবে। 
এছাড়াও সন্তানের গঠন ঠিকমতো হয়নি, সন্তান ভালো হবে না তাই তাকে মেরে ফেললে ভালো হবে এমন ভাবনা আসতে পারে। আবার উল্টোটি যেমন, আমার সন্তান কোনো বিশেষ ক্ষমতা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে বা সে সাধারণ কোনো মানুষ নয় এমন বিশ্বাসও মায়ের মধ্যে আসতে পারে। বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয় ‘ডিল্যুশন’, যেটি এক ধরনের চিন্তাগত সমস্যা।
অনেকে আবার বিভিন্ন ধরনের গায়েবী আওয়াজ শুনতে পায় যেটিকে বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ‘অডিটরি হ্যালুসিনেশন’। সেখানে হয়তো গায়েবীভাবে রোগী বিভিন্ন নির্দেশ পেয়ে থাকে। যেমন, তার নিজের বা বাচ্চার ক্ষতি করতে হবে। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় এসব গায়েবী নির্দেশের কারণে মা তার সন্তানকে মেরে ফেলতে পারে বা করতে পারে নিজে আত্মহত্যা।
রোগের কারণ
প্রসব পরবর্তী হরমোনের বিভিন্ন তারতম্য এমন সব মানসিক রোগের জন্য দায়ী হতে পারে বলে ধারণা করা হলেও রোগের ক্ষেত্রে পূর্ববর্তী মানসিক রোগের ইতিহাস এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ যাদের এ ধরনের সমস্যা আগে ছিল তাদের ক্ষেত্রে এসব রোগ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এছাড়াও পরিবারের কারো বা রক্ত সম্পর্কের কারো মাঝে এমন লক্ষণ দেখা দিয়ে থাকলে আগে থেকেই একটু সচেতন থাকা প্রয়োজন। আবার প্রসব পরবর্তী কম ঘুম বা অতিরিক্ত পরিশ্রম এসব সমস্যা তৈরি করতে পারে বা সমস্যাকে বাড়িয়ে দিতে পারে।
চিকিৎসা 
চিকিৎসার ক্ষেত্রে রোগীকে দ্রুত রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রোগীকে চিকিৎসাকেন্দ্রে ভর্তি থেকে চিকিৎসা নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়ে থাকে। একই সাথে শিশুটির প্রয়োজনীয় সেবা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সার্বিকভাবে এ সমস্যাটিকে মনোচিকিৎসার ভাষায় ‘সাইকিয়াট্রিক ইমার্জেন্সি’ হিসেবে ধরা হয়ে থাকে।
সাধারণ মানসিক রোগের মধ্যে ‘বাইপোলার ডিজঅর্ডার’-এর সাথে এ রোগের লক্ষণে অনেক মিল থাকে এবং এর চিকিৎসা পদ্ধতিও প্রায় একই হয়ে থাকে। মুড স্টেবিলাইজার, এন্টিসাইকোটিক ঔষধ এবং এর সাথে কিছু ঘুমের ঔষধের প্রয়োজন হয়। তবে চিকিৎসা পদ্ধতি নির্ধারণ করার আগে বুকের দুধ খাওয়া সন্তানের কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে।
বিশেষ তথ্য
এসব ক্ষেত্রে যেহেতু দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠা উচিত বা সুস্থ হয়ে উঠতে পারলে শিশুটির সেবা দ্রুত নিশ্চিত করা যায় তাই দ্রুত চিকিৎসার ক্ষেত্রে ইসিটি (ECT) একটি অত্যন্ত ফলপ্রসু পদ্ধতি। ইসিটি একটি ঝুঁকিমুক্ত ও কার্যকরী পদ্ধতি। মনে রাখতে হবে এ রোগটিতে আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক বেশি থাকতে পারে, এমনকি সন্তান হত্যার হারও এক্ষেত্রে শতকরা চার ভাগ। সুতরাং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিশ্চিত করা মা ও সন্তান উভয়ের জন্যই অত্যন্ত জরুরি।


প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।

Previous articleপরীক্ষা শুরুর এক মাস আগে আমার মেয়ের খিঁচুনি শুরু হয়
Next articleবিশেষ শিশু: তাদের বিষণ্ন ও বিপন্ন অভিভাবকগণ
চেয়ারম্যান, মনোরোগবিদ্যাি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here