শরীর এবং মন এ দুই নিয়ে হচ্ছে মানুষ। শরীরবিহীন যেমন মানুষের অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না, তেমনি মনবিহীন মানুষও অসম্ভব। সুস্থ-সুন্দরভাবে জীবনযাপন করতে গেলে সুস্থ শরীর এবং সুস্থ মন সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। শরীরেরও রোগ হয়, অসুখ হয়। তাই মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষা আমাদের প্রত্যেকের জীবনে ভীষণ দরকার। সুস্থ-সুন্দরভাবে জীবনযাপন করতে গেলে সুস্থ শরীর এবং সুস্থ মন সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশের মানসিক অসুখ নিয়ে সমাজে ট্যাবু থাকায় এই রোগ গোপন করে রাখার প্রবণতা রয়েছে। এরই সঙ্গে করোনা অতিমারী ও লকডাউনের প্রভাবে মনের ওপর চাপও বেড়েছে।
মানসিক রোগ সম্পর্কে এখনো বাংলাদেশের মানুষ নানা কুসংস্কারে বিশ্বাস করে। তাদের সবাই চিকিৎসা পায়না। যারা চিকিৎসা করে তারা বিভিন্ন কারনে মাঝপথে ছেড়ে দেয়। এতে করে তাদের সামাজিক, পারিবারিক, আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। অনেক সময় তাদেরকে একঘরে করে রাখা হয়। বেশিরভাগ মানুষ জ্বিন ভূতের আছর বলে ধরে নিয়ে কবিরাজী চিকিৎসা করে। কখনো বা মানসিক বিশেষজ্ঞ না দেখিয়ে অন্য বিষয়ের ডাক্তার দেখান। ফলে অনেক সময় রোগের জটিলতা বাড়তে থাকে।
বর্তমানে কোভিড পরিস্থিতির কারনে অসমতা আরও বেড়েছে। মানুষের মাঝে হতাশা, অনিশ্চয়তা, টাকা পয়সার অভাব, চাকরি হারানো, অশান্তি, অস্থিরতা, আতংক, বিষন্নতা, পারিবারিক কলহ, মৌলিক চাহিদা পূরণ না হওয়া, জীবনযাত্রার মান কমে যাওয়া এসব কিছুই মানুষের জীবনে পরিবর্তন এনেছে। চিকিৎসা খাতে ব্যয় বেড়েছে কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বাড়েনি। মানসিক সমস্যা বেড়ে গেলেও মানুষের মাঝে মানসিক সমস্যার চিকিৎসা নিয়ে একধরনের অনাগ্রহ কাজ করে। তারা মনে করে মানসিক রোগ মানেই পাগল হয়ে যাওয়া। আর ডাক্তারের কাছে গেলে সমাজের মানুষের কাছে ছোট হতে হবে এই ভেবে তারা আরও আসতে চায়না। এই কোভিড পরিস্থিতিতে প্যানিক ডিজঅর্ডার রোগটি বেড়ে গেছে অনেকখানি। সেই সাথে আত্মহত্যার প্রবনতা বেড়েছে মানুষের মাঝে আতংক সামলাতে না পেরে। একদিকে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার ফলে এই বছরে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রিয়জন, বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে পারেনি। লকডাউনে বাড়িতে আটকে পড়া, যার ফলে অ্যাংজাইটির সমস্যা বহু মানুষের মধ্যেই দেখা গিয়েছে। সঙ্গে করোনার ভয়ও বাদ যায়নি।
মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া নতুন করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বজুড়ে জনসাধারণের মধ্যে বাড়তে থাকা মানসিক চাপের ব্যাপারে সতর্ক করেছে জাতিসংঘ। এতে বলা হয়েছে, নতুন করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামনের সারিতে থাকা স্বাস্থ্যকর্মী, কাজ হারানো শ্রমিক, ঘরবন্দি দশা, অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম, বয়স্কদের একাকিত্ব ও দুশ্চিন্তায় ভোগা এ সব কিছু মিলেই চলতি মহামারী বিশ্বের অসংখ্য মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যে ভয়াবহ প্রভাব ফেলছে। “কার্যকরী সমাজের জন্য ভালো মানসিক স্বাস্থ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য যদি পদক্ষেপ না নেয়া হয় তাহলে বিশ্বকে কেবল শারীরিক স্বাস্থ্যজনিত সংকটেরই মুখোমুখি হতে হবে না, মানসিক স্বাস্থ্য সংকটেরও মোকাবেলা করতে হবে,” বলেছে জাতিসংঘ। আমেরিকান মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত রিপোর্ট : ফ্রন্টলাইন স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর পরিচালিত এ গবেষণা থেকে জানা যায় তাঁদের (ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা) মানসিক যাতনা, সমস্যা ব্যাপক হারে দেখা যাচ্ছে ।
এর মাঝে বিষণ্ণতা : ৫০%, উদ্বিগ্নতা : ৪৫%, ঘুমের সমস্যা : ৩৪%, মানসিক যাতনা বা ডিস্ট্রেস : ৭২%। আবার তাদের মধ্যে সুইসাইডাল ঝুঁকিও দেখা যাচ্ছে। অনেক প্রফেশনাল মানুষ সুইসাইড করছে চাপ সামলাতে না পেরে। অন্য এক করা গবেষণায় আতঙ্কের পরিমাণ ছিল ৭৯.৬%। আতঙ্কের সাথে যুক্ত প্রধান কারণগুলি ছিল বয়স্ক হওয়া (৩০ বছরের বেশি), উচ্চ শিক্ষা (স্নাতকের উপরে), বিবাহিত হওয়া এবং একটি যৌথ (বর্ধিত) পরিবারের সাথে বসবাস করা। যদিও এই ফলাফলগুলির মধ্যে কিছু (যেমন, বয়স )। শিক্ষার ক্ষেত্রে দেখা যায় নিম্ন শিক্ষার অধিকারী ব্যক্তিরা মহামারীটির সম্ভাব্য ক্ষতি সম্পর্কে সচেতন না এবং তাই তারা কম আতংকগ্রস্থ। WHO অনুমান করেছে যে উদ্বেগজনিত ব্যাধি সহ বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যার অনুপাত ছিল ৩.৬%, এবং উদ্বেগজনিত ব্যাধি পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মধ্যে বেশি সাধারণ ছিল। বিশ্বব্যাপী ২.৬% পুরুষদের এবং ৪.৬% মহিলাদের। এই প্যাটার্নটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় স্পষ্ট (WHO, ২০১৭)। সুতরাং, বর্তমান গবেষণায় আতঙ্ক এবং সাধারণ উদ্বেগের অনুমান বেশি বলে মনে করা হচ্ছে। চীনে একটি গবেষণায় ২০১৯ সালে ১২০০ জন ডাক্তারের উপর করা হয়। তাতে দেখা যায় উদ্বিগ্নতা ১২%, বিষন্নতা ১৫%, প্যানিক ডিসঅর্ডার ৩৫% ও ঘুমের সমস্যা ৮%। সাধারণ মানুষের মাঝেও উদ্বেগ, প্যানিক ডিসঅর্ডার, বিষন্নতা এগুলো বেড়ে গেছে করোনায়। বেশ কিছু তথ্য বলছে, করোনায় প্যানিক অ্যাটাক শব্দটি ছিল ইন্টারনেটে সব চেয়ে বেশি সার্চ হওয়া কিওয়ার্ড।
প্যানিক অ্যাটাকের চিকিৎসা
মনে রাখতে হবে প্যানিক অ্যাটাক মানে মৃত্যু নয়। এটি একটি সাময়িক পরিস্থিতি। প্যানিক অ্যাটাক বার বার হলে অবশ্যই মানসিক চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। তার কারণ, প্যানিক অ্যাটাক হলে বুঝতে হবে, এটির পিছনে মানসিক কোনও সমস্যা জড়িয়ে রয়েছে। এই প্যানিক অ্যাটাক অনেক সময় সুইসাইড করার প্রবণতাও বাড়িয়ে দেয়। একটি গবেষণা অনুযায়ী যাঁরা প্যানিক ডিজঅর্ডারে ভোগে, তাঁদের মধ্যে ৪৭ শতাংশ মানুষের মধ্যে সুইসাইড করার প্রবণতা থাকে। কাজেই এ বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। রোগীকে একা রাখা যাবেনা। সার্বক্ষণিক লোক থাকতে হবে। রোগীর হাতে ওষুধ দেয়া যাবেনা। প্রয়োজন হলে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা নিতে হবে।
দীর্ঘ শ্বাস প্রশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। এতে নিঃশ্বাসের কষ্ট দূর হতে সাহায্য হয়। সেকেন্ড ধরে ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস নিতে হবে। এরপর কয়েক সেকেন্ড নিঃশ্বাস ধরে রাখতে হবে। এরপর ধীরে ধীরে কয়েক সেকেন্ড ধরে নিঃশ্বাস ছাড়তে হবে। এই পদ্ধতিটি ৪-৫ বার করতে হবে। প্যানিক অ্যাটাক যে কোনো সময় যে কোনো স্থানে শুরু হতে পারে। উত্তেজনা তৈরি হয় এমন পরিস্থিতি বা ব্যক্তিকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতে হবে। অতিরিক্ত ক্যাফেইন জাতীয় খাবার যেমন কফি, চা, কোলা ও চকলেট খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। যে মুহূর্তে মনে হবে প্যানিক শুরু হচ্ছে সাথে সাথে উচিত মনকে অন্যদিকে ব্যস্ত করে ফেলতে হবে। গান শোনা, গল্প করা, পড়া বা যা ইচ্ছা লিখতে শুরু করা যায়। প্রথমেই মনে রাখতে হবে এটা সাময়িক পরিস্থিতি। মনকে বোঝাতে হবে যে এটা অল্প সময়ের একটা অবস্থা, একটু পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে। এই অ্যাটাক হলে কখনই মৃত্যু হবেনা। এটা সবসময় মনে রাখতে হবে। প্যানিক অ্যাটাকের লক্ষণগুলো কমিয়ে আনতে স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট করতে হবে।
প্রিয়জন কাছে থাকলে তাঁকে অবশ্যই জানাতে হবে যে কষ্ট হচ্ছে। তাঁকে বলতে হবে দুহাতে জড়িয়ে ধরতে। এতে মানসিক শক্তি বৃদ্ধি হয়। মনে জোর ফিরে আসতে থাকে। নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করতে হবে। এই সমস্যা সাইকোথেরাপির বিভিন্ন পদ্ধতিতে সেরে উঠতে পারে। কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি বা অ্যাংজাইটি ও মানসিক অবসাদ সারিয়ে তুলতে বিভিন্ন ওষুধ ব্যবহার করা হয়। যাতে এই ধরনের প্যানিক অ্যাটাকের প্রবণতাও কমতে পারে। যখন মনে হবে এই ধরণের পরিস্থিতি তৈরি হতে চলেছে তখন প্রথমেই মুখে চোখে বারবার ঠাণ্ডা জলের ঝাপটা দেওয়া দরকার। সাথে আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা জল পান করাও দরকার। এগুলো মনকে অন্যমনস্ক করে ফেলে। ফলে প্যানিক অ্যাটাক হওয়ার যে ট্রিগারটি সক্রিয় হচ্ছিল তা নিস্ক্রিয় হয়ে যায়। কাছে কেউ থাকলে থাকলে তাঁকে দিয়ে ঘাড়ে, পিঠে, কাঁধে হালকা হাতে মালিশ করতে বলতে হবে। খালি পায়ে হাটার চেষ্টা করতে হবে। যদি কষ্ট বেশি হয় তাহলে করার দরকার নেই। নাহলে একটু শুয়ে বা বসে থাকতে হবে।
এই বিষয়ে যুক্ত বিভিন্ন দলের সাথে যোগাযোগ করে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহন করলে খুব উপকার হয়। তাছাড়া একই ধরণের অসুস্থতার শিকার সমব্যাথী মানুষের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠলে প্রয়োজনে তাঁদের পাশে পাওয়া যায়।
যখনই মনে হবে অস্বস্তি শুরু হচ্ছে তখনই কোনো প্রিয়জনকে ফোন করে কথা বলতে হবে। এতে ভেতরের ভয় আস্তে আস্তে প্রশমিত হতে থাকে। অ্যাটাক থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ হবে। অন্য কিছু সম্ভব না হলে কাগজে যা পারেন আঁকতে হবে বা লিখতে হবে যা হোক। দৈনন্দিন জীবনে যোগব্যায়াম, প্রাণায়াম করা অভ্যাস করলে উপকার হয়।
সবশেষে প্রয়োজনে অবশ্যই মনোরোগ চিকিৎসকের সাহায্য নিতে হবে।
ডা. ফাতেমা জোহরা
এমবিবিএস(ডিইউ), এমডি সাইকিয়াট্রি (বিএসএমএমইউ),এফএমডি (ইউএসটিসি),ডিএইচএমএস (বিডি)
সহকারী অধ্যাপক, মানসিক রোগ বিভাগ
ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
সূত্রঃ মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ৪র্থ বর্ষ, ১০ম সংখ্যায় প্রকাশিত।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে