দাম্পত্য জীবন হলো মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল সম্পর্কগুলোর একটি। এটি শুধু দুজন নারী-পুরুষের মধ্যে গড়ে ওঠা একটি বন্ধন নয়, বরং একটি পুরো পরিবারের ভিত্তি, যেখানে ভালোবাসা, বিশ্বাস ও বোঝাপড়ার ওপর নির্ভর করে একটি নতুন প্রজন্মের ভবিষ্যৎ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, আধুনিক জীবনের চাপ, মানসিক দূরত্ব এবং ইগোর কারণে এই সম্পর্কগুলোতে ফাটল ধরছে। আমাদের সমাজে আত্মহত্যার অধিকাংশ ঘটনার পেছনে মূল কারণ হিসেবে উঠে আসছে পারিবারিক বা দাম্পত্য কলহ।
একটি সুস্থ দাম্পত্য সম্পর্ক জীবনের অন্যতম বড় প্রাপ্তি, কিন্তু যখন তা সুন্দর হয় না, তখন হতাশা, একাকিত্ব ও বিষণ্নতার মতো মানসিক অবক্ষয়গুলো ধীরে ধীরে বাসা বাঁধে। এই মানসিক যন্ত্রণা শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যার মতো একটি বিয়োগান্তক ঘটনায় রূপ নিতে পারে। আমাদের সমাজের এই নীরব ঘাতকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। এই লেখায় আমরা এই সংকটের কারণগুলো খুঁজে দেখব এবং সমাধানের পথ নিয়ে আলোচনা করব, কারণ দাম্পত্যের দ্বন্দ্বের সমাধান হতে পারে ভালোবাসা ও বোঝাপড়ায়, মৃত্যুর পথে নয়।
দাম্পত্যের দ্বন্দ্ব ঘুচুক সমাধানে
দাম্পত্যে দ্বন্দ্ব ও বিষণ্নতার মূল কারণ
একটি সুস্থ দাম্পত্য জীবন গড়ে ওঠে বিশ্বাস, বোঝাপড়া এবং আন্তরিক ভালোবাসার উপর। কিন্তু বর্তমান জীবনের চ্যালেঞ্জগুলো—যেমন কর্মজীবনের চাপ, আর্থিক সমস্যার টানাপোড়েন, বেকারত্ব, বা সন্তান লালন-পালনের চাপ—এগুলো দাম্পত্যে নতুন নতুন দ্বন্দ্ব তৈরি করে।
বিশ্বাসের সংকট ও সন্দেহ
আধুনিক যুগে অবিশ্বাস ও সন্দেহ সম্পর্ককে সবচেয়ে বেশি দুর্বল করে তুলছে। স্বামী বা স্ত্রী যদি একে অপরের প্রতি অতিরিক্ত সন্দেহ করে, ফোন বা সোশ্যাল মিডিয়া নজরদারি করে, তা সম্পর্ককে বিষাক্ত করে তোলে। অনেক সময় পরকীয়া বা পরকীয়ার মিথ্যা সন্দেহ একটি সুস্থ সম্পর্ককে এক নিমিষে ধ্বংস করে দেয়।
যোগাযোগের অভাব ও ইগো
বর্তমান যুগে আমরা সামাজিক মাধ্যমে যত বেশি সংযুক্ত, বাস্তবে আমাদের নিজেদের মানুষের সঙ্গে ততটাই বিচ্ছিন্ন। মন খুলে কথা না বলার ফলে ছোট ছোট সমস্যাগুলো চাপা পড়ে থাকে এবং জমে জমে একসময় বিশাল আকার ধারণ করে। “আমি-ই সঠিক”, “তুমি কি আমার চেয়ে বেশি বোঝ” বা “আমি কেন আগে কথা বলব?”—এই ধরনের ইগো ও হীনমন্যতা দাম্পত্যকে ভেতর থেকে দুর্বল করে তোলে।
পারস্পরিক সম্মান ও ভালোবাসার অভাব
একে অপরকে ছোট করা, তুচ্ছ বিষয় নিয়ে খোঁচা দেওয়া, বা অন্যদের সঙ্গে তুলনা করা সম্পর্ককে ভেঙে দেয়। ‘তুমি অযোগ্য’, ‘তোমার দ্বারা কিছু হবে না’—এই ধরনের বাক্যগুলো মানসিক নির্যাতন। যখন যত্ন ও সমঝোতার অভাব দেখা যায়, তখন ভালোবাসা শুকিয়ে যায়, যা হতাশার মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ
শাশুড়ি-বউ, ননদ-ভাবি, বা অন্য আত্মীয়-স্বজনের অহেতুক হস্তক্ষেপ দাম্পত্যে প্রায়ই সংকট সৃষ্টি করে। অনেক সময় বন্ধু-বান্ধবের নেতিবাচক পরামর্শও ঝামেলা বাড়িয়ে দেয়। একটি ব্যক্তিগত সম্পর্কে তৃতীয় পক্ষের বাড়তি টানাপড়েন সৃষ্টি করা একেবারেই উচিত নয়।
দাম্পত্য কলহ থেকে আত্মহত্যা
দাম্পত্যে দীর্ঘদিন ধরে চলা দ্বন্দ্ব ও মানসিক অবহেলা মানুষকে ধীরে ধীরে বিষণ্নতা ও একাকিত্বের দিকে ঠেলে দেয়। এই প্রক্রিয়াটি একটি চক্রের মতো কাজ করে:
মানসিক অবক্ষয়
দিনের পর দিন মানসিক অবহেলা, অপমানের শিকার হয়ে মানুষ ধীরে ধীরে বিষণ্নতায় (Depression) ডুবে যায়। সে তার আত্মবিশ্বাস হারায় এবং নিজেকে মূল্যহীন ভাবতে শুরু করে।
মানসিক নির্যাতন
‘তুমি অযোগ্য’, ‘তুমি সারা দিন ঘরে কী করো?’ অথবা ‘খাওয়ানোর মুরদ নাই বিয়ে করছ কেন?’ —এই ধরনের বাক্যগুলো মানসিক নির্যাতনের চূড়ান্ত রূপ। এই নির্যাতন অনেক সময় শারীরিক নির্যাতনের চেয়েও ভয়াবহ হয়, কারণ এর ক্ষত দেখা যায় না, কিন্তু তা মনের গভীরে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে।
শারীরিক নির্যাতন
শারীরিক নির্যাতনের কারণে অনেক স্ত্রী চরম হতাশায় ডুবে যায়। স্বামীর দুর্ব্যবহার, বদমেজাজ, মাদকাসক্তি বা জুয়ার নেশা যখন প্রতিদিনের জীবনের অংশ হয়ে যায়, তখন অনেক স্ত্রীর মনে জীবন নিয়ে শুধুই ঘৃণা তৈরি হয়। অন্যদিকে যৌতুকের নাম করে চাপ, অপমান এবং নির্যাতনে অনেক নারী সহ্যক্ষমতার বাইরে চলে যায়। ঘরে প্রতিদিনের গালাগালি, অবহেলা, নির্যাতন আর লাঞ্ছনা মানুষকে ভেতর থেকে ভেঙে ফেলে। কোনো আশ্রয় বা সমাধান দেখতে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত অনেক নারী আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হয়।
সামাজিক চাপ ও একাকিত্ব
সংসার ভেঙে যাওয়ার ভয়, সন্তান ও সমাজের কাছে ‘ব্যর্থ’ হিসেবে পরিচিত হওয়ার চাপ এবং একাকিত্বের অনুভূতি হতাশাকে বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। মনে হয়, এই সমস্যা থেকে মুক্তির আর কোনো পথ নেই। এই একাকীত্ব এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে যায়, যখন মানুষ আর বাঁচার কারণ খুঁজে পায় না।
হতাশার চূড়ান্ত পর্যায়
যখন মানুষ চাপ সইতে না পেরে নিজেকে অসহায় ও মূল্যহীন মনে করে, তখন তারা এই সমস্যা থেকে ‘মুক্তি’ পাওয়ার জন্য আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। কিন্তু আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়, বরং সমস্যা ও কষ্ট থেকে পালিয়ে যাওয়ার একটি ভয়ংকর ভুল সিদ্ধান্ত।
দাম্পত্যে শান্তি ফিরিয়ে আনুন
দাম্পত্যের এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে:
মনোযোগ দিয়ে শোনা ও কথা বলা
একে অপরের কথা মন দিয়ে শোনা অত্যন্ত জরুরি। কোনো রকম বিচার বা পূর্বধারণা ছাড়া অন্যের কথা শুনলে সম্পর্কের গভীরতা বাড়ে। নিজের অনুভূতিগুলো খোলামেলাভাবে প্রকাশ করা সম্পর্ককে মজবুত করে।
খোলামেলা আলাপ
যেকোনো সমস্যা হলে সরাসরি কথা বলা, নীরবতা বা চাপা ক্ষোভ জমতে না দেওয়া সম্পর্ককে সুস্থ রাখে। রাগ বা ক্ষোভ জমে থাকলে তা একসময় বিস্ফোরিত হতে পারে। তাই, সমস্যাগুলো যথাসময়ে সমাধান করা উচিত।
একসাথে সময় কাটানো
এক সাথে বেড়ানো, শখের কাজ করা, সিনেমা দেখা বা ছোট ছোট আনন্দ ভাগ করে নেওয়া সম্পর্ককে শক্তিশালী করে। জীবনের কঠিন মুহূর্তগুলোতে একে অপরের পাশে থাকা ও সমর্থন দেওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ।
পেশাদার সাহায্য নেওয়া
যখন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনো সমস্যা সমাধান হচ্ছে না, তখন একজন নিরপেক্ষ ম্যারেজ কাউন্সেলর বা থেরাপিস্টের সাহায্য নেওয়া উচিত। এটি কোনো দুর্বলতা নয়, বরং একটি সম্পর্ক বাঁচানোর জন্য একটি সাহসী ও বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ।
সহনশীলতা ও ক্ষমা
ছোটখাটো ভুলগুলো ক্ষমা করা এবং একটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের চেষ্টা করা সম্পর্ককে দীর্ঘমেয়াদে টিকিয়ে রাখে। ভালোবাসা, সহমর্মিতা ও একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের মাধ্যমে এই সংকট থেকে বের হওয়া সম্ভব।
পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব
দাম্পত্যের সংকট থেকে আত্মহত্যা প্রতিরোধে শুধু স্বামী-স্ত্রী নয়, বরং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকেও দায়িত্ব নিতে হবে।
পরিবারের ভূমিকা
স্বামী-স্ত্রীর ব্যক্তিগত বিষয়ে অপ্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ না করা। শাশুড়ি-বউ বা ননদ-ভাবির ঝামেলা না বাড়িয়ে উভয় পক্ষকে সমাধানে উৎসাহিত করা। সন্তান বা প্রিয়জনের সমস্যা হলে তাকে মানসিক সহায়তা নিতে উৎসাহিত করা এবং কোনো রকম বিচার না করে পাশে থাকা।
রাষ্ট্র ও সমাজের ভূমিকা
পারিবারিক সহিংসতা (Domestic Violence) এবং মানসিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করা এবং তার দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা জরুরি। টেলিভিশন, রেডিও ও সামাজিক মাধ্যমে পারিবারিক শান্তি এবং মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান প্রচার করা উচিত। ম্যারেজ কাউন্সেলিং সেন্টার এবং ২৪/৭ হটলাইন পরিষেবা জনগণের কাছে সহজলভ্য করা উচিত। পাশাপাশি, পুরুষ নির্যাতনের ঘটনাগুলোকেও গুরুত্ব দেওয়া এবং পুরুষদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েও কাজ করা জরুরি।
প্রিয়জনের পাশে থাকা
একটি সম্পর্কের সমস্যা দেখে শুধুমাত্র সমালোচনা করা বা উপেক্ষা করা মানসিক অবস্থাকে আরও খারাপ করে। বরং সহমর্মিতা, মনোযোগ দিয়ে শোনা এবং সক্রিয়ভাবে সাহায্যের হাত বাড়ানো খুব গুরুত্বপূর্ণ। ছোট ছোট উদ্যোগ—যেমন খোলামেলা আলাপ, ছুটি কাটানো, বা শুধু পাশে থাকা—একজন মানুষকে হতাশা থেকে সরিয়ে জীবনের প্রতি আগ্রহ ফিরিয়ে আনতে পারে।
জীবন বাঁচানোর অঙ্গীকার
একটি দাম্পত্যের ভাঙন মানে শুধু সম্পর্কের ইতি নয়, বরং দুটি মানুষের মানসিক অবক্ষয় এবং আত্মহত্যার ঝুঁকি। আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়। বরং সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজে, একে অপরের পাশে দাঁড়ানোই আসল সাহস।
ভালোবাসা, সহনশীলতা ও সহমর্মিতার মধ্য দিয়েই এই সংকট থেকে বের হওয়া সম্ভব। পারিবারিক শান্তি ও বন্ধনের মাধ্যমেই আমরা একটি সুস্থ সমাজ গড়তে পারি এবং আত্মহত্যার মতো বিয়োগান্তক ঘটনাগুলো রোধ করতে পারি।
মনে রাখবেন, দাম্পত্যের দ্বন্দ্ব ঘুচবে সমাধানে, নয় মৃত্যুর পথে। ছোট ছোট সহমর্মিতা ও বোঝাপড়া একটি জীবন বাঁচাতে পারে। একটি জীবন হারানো নয়, বরং একটি জীবন ফিরিয়ে দেওয়াই হোক আমাদের লক্ষ্য।
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী
লেখক ও সমাজ গবেষক
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনেরখবর-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য মনেরখবর কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।
সিরিয়ালের জন্য ভিজিট করুন- এপোয়েন্টমেন্ট
আরও দেখুন-