ল্যাটিন ভাষার সুই সেইডেয়ার থেকে আত্মহত্যা শব্দটি এসেছে। যার অর্থ হচ্ছে নিজেকে হত্যা করা। ডাক্তারি ভাষায় আত্মহত্যার চেষ্টা করাকে মানসিক অবসাদজনিত গুরুতর উপসর্গ হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। ইতিমধ্যেই বিশ্বে অনেক দেশেই আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকে এক ধরণের অপরাধরূপে ঘোষণা করা হয়েছে। অনেক ধর্মেই আত্মহত্যাকে পাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অথচ জাপানের একটা জঙ্গল রয়েছে যেখানে সুইসাইড করতেই মানুষ যায়।
আওকিগাহারা ফরেস্ট নামক সেই বনে জাপানের অসংখ্য মানুষ সুইসাইডের উদ্দেশ্যেই পা বাড়ান। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, এই জঙ্গল থেকে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ১০০ জন মানুষের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। বনের সর্বত্রই ছড়িয়ে থাকে মৃত মানুষের কঙ্কাল, হাড়গোড়। জাপানের টোকিও শহর থেকে ১০০ মাইল পশ্চিমে মাউন্ট ফুজির উত্তর-পশ্চিমে ৩৫ বর্গকিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত আওকিগাহারা জঙ্গল।
আওকিগাহারা বন সম্পর্কে জাপানিদের মধ্যে অনেক গল্প প্রচলিত রয়েছে। তারা বিশ্বাস করে, এ বনের মধ্যে কেউ গেলে আর ফিরে আসে না। জাপানি পুরাণ মতে, এ বনে প্রেতাত্মারা ঘুরে বেড়ায় এবং তারা মানুষকে আত্মহতযার জন্য প্ররোচিত করে ডেকে নিয়ে আসে। ঘন গাছপালা। গুমোট নিস্তব্ধতা, আবছা আলোতে গা ছমছমে জনমানবশূন্য গোলকধাঁধাময় আওকিগাহারা জঙ্গল এতটাই বিভ্রান্তিকর যে অনেক সময় মৃতদেহের সন্ধানই পাওয়া যায় না!
গভীর ও সুবিশাল জঙ্গলে একবার ঢুকলে বের হওয়ার রাস্তা পাওয়া কঠিন। অদ্ভুত বাঁকানো আকৃতির গাছপালা বনের রহস্য আরো বাড়িয়ে দেয়। গাছের শিকড়গুলো জালের মতো আঁকড়ে রেখেছে পুরো অঞ্চলের মাটি। পাহাড়ি অঞ্চল হওয়ায় এর ভূমি অমসৃণ ও প্রস্তরাকীর্ণ। আরো রয়েছে শত শত গর্ত ও অন্ধকার গুহা। আওকিগাহারা ফরেস্টে বন্যপ্রাণীর অস্তিত্বও বিরল। এখানকার মাটিতে ম্যাগনেটিক আয়রনের পরিমাণ এতই বেশি যে সেলফোন সার্ভিস, জিপিএস সিস্টেম এমনকি কম্পাসও কাজ করে না। রহস্যময়তা আর অতিপ্রাকৃত সম্মোহনী শক্তির কারণেই প্রতি বছর প্রায় শখানেক জাপানি এই জঙ্গলে আত্মহত্যা করতে অনুপ্রাণিত হয়।
পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই আত্মহত্যাকে অপরাধ হিসেবে মনে করা হলেও জাপানে ঐতিহ্যগতভাবে আত্মহত্যার প্রচলন ছিল। সামন্ত যুগে জাপানে সামুরাই নীতিতে বিশ্বাসীরা মনে করত ‘সেপুকু’ (আত্মহত্যায় মুক্তি)-র মাধ্যমে ঈশ্বরের কাছে যাওয়া যায়। আধুনিক যুগেও অনেক জাপানি আত্মহত্যার নীতিতে বিশ্বাস করেন। ১৯৬০ সালে জাপানি লেখক সাইকো মাটসুমোটোর ‘টাওয়ার অফ ওয়েবস’ উপন্যাস প্রকাশের পর থেকেই আওকিগাহারা জঙ্গলে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়। উপন্যাসের দুটি চরিত্র এই জঙ্গলে এসে আত্মহত্যা করেছিল।
অথচ সুইসাইড হলো একপ্রকারের মানসিক রোগ। গবেষক সেজান মাহমুদ নিজের একটা লেখায় বলেছিলেন, ‘সুইসাইড একটি রোগ, যার পেছনে শতকরা ৯০% ক্ষেত্রেই আরও গভীর মানসিক রোগ থাকে। ১০-১৫% ক্ষেত্রে জিনেটিক বা বংশগত কারণ, পরিবেশগত কারণ।’ এই লেখক আরও যোগ করেন, ‘আমাদের সমাজে মানসিক রোগ বিষয়কে এখনো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে, মানসিক রোগ অন্য যেকোনো রোগের মতোই এক বিষয়। মানসিক রোগের জন্য চিকিৎসা এবং পারিবারিক বা সামাজিক সাপোর্ট দুটোই জরুরি।’
আর আত্মহত্যার মতো বিষয়কে সমাজ থেকে নির্মূল করতে তাই আমাদের মানসিক রোগ নিয়ে কাজ করতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে হবে। তাহলে ‘সুইসাইড ফরেস্ট’ নামক আওকিগাহারা জঙ্গল উন্মুক্ত থাকলেও মানুষ সেখানে ঘুরতেই যাবে কেবল আত্মহত্যা করতে নয়।
লিখেছেন- কামরুল ইসলাম ইমন
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে