চিকিৎসা শাস্ত্রে ভাষাবিজ্ঞানের ব্যবহার

0
47

একুশ বাঙ্গালীর আবেগ, বাঙ্গালীর অহংকার, বাঙ্গালীর চেতনা ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। বাংলাভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন সালাম, রফিক, শফিক সহ নাম না জানা আরো অনেক ভাষা শহীদরা। বাংলা ভাষা (মাতৃভাষা) আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একটি ভাষা, আমাদের গর্ব, আমাদের অস্তিত্ব। এই বাংলা ভাষাকে নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের “ভাষা বিজ্ঞান” বিভাগ। এই বিভাগে চলছে বাংলা ভাষাকে নিয়ে বিভিন্ন গবেষনামূলক কর্মকান্ড। গবেষকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ডঃ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ, তিনি ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের একজন স্মরনীয় বাঙালী ভাষাবিদ, ভাষা বিজ্ঞানী, বিশিষ্ট শিক্ষক ও দার্শনিক এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী ডঃ মুনীর চৌধুরী, তিনি ছিলেন একজন বাঙালী ভাষাবিদ এবং ভাষাবিজ্ঞানী, বিশিষ্ট শিক্ষক ও নাট্যকার। যুগ যুগ ধরে চলছে বাংলাভাষাকে নিয়ে গবেষণামূলক কার্যক্রম।
বর্তমানে “চিকিৎসা ভাষাবিজ্ঞান” ভাষা বিজ্ঞান বিভাগের একটি নতুন সংযোজন। রোগ ও শোকের কারণে মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাভাবিক বৃদ্ধি ও বিকাশ যেমন ব্যাহত হয় তেমনি রোগ ও শোকের কারণে কোন মানুষের বিকশিত “ভাষা” দক্ষতাটি হঠাৎ করে হারিয়ে যেতে পারে অথবা হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। বর্তমানে পৃথিবীর সকল চিকিৎসা ভাষাবিজ্ঞানীরা সারা পৃথিবীতে এই বিষয় নিয়ে তৎপর হয়েছে উঠেছেন। বাংলাদেশও এক্ষেত্রে খুব একটা পিছিয়ে নেই। আধুনিক বিজ্ঞানের একটি নতুন ক্ষেত্রের উন্মেষই হলো “চিকিৎসা ভাষাবিজ্ঞান”।
প্রথমে পশ্চিমের একাডেমিতে চর্চিত হলেও বর্তমানে প্রয়োজন ও চাহিদার নিরিখে এই ক্ষেত্রটি একটি দ্রুত বিকাশমান জ্ঞানক্ষেত্র হিসেবে প্রায় সব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে চর্চিত হচ্ছে, কারণ প্রত্যেকটি দেশের সকল ভাষিক সমাভুক্ত মানুষকেই প্রতিমুহূর্তে নানা ধরনের “ভাষা বৈকল্য” মোকাবেলা করতে হচ্ছে, এসব সমস্যার প্রতিকার প্রাপ্তির প্রত্যাশায় মানুষ তাদের নিজস্ব জ্ঞান পরিমন্ডলে নতুন বিকশিত এই শাস্ত্রের দরোজাকে উন্মুক্ত করেছেন। বাংলাদেশের একাডেমিয়াও সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক কাউন্সিলের সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাভাষী সহ এদেশের বিভিন্ন আদিবাসীদের ভাষা বৈকল্যগ্রস্থ মানুষের বৈকল্য ও বিকারের ধরন শনাক্তকরণসহ এই রোগসমূহের প্রতিকারকল্পে পঠনকার্য ও গবেষনাকর্ম সম্পাদনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কারণ পৃথিবীর সকল সমাজেই মানুষ তার মনের মৌলিক আবেগ আকাঙ্খা ও আনুষাঙ্গিক বিষয়গুলো প্রকাশ করে থাকে ভাষার মাধ্যমে। আর যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রকাশ করে থাকেন তাকে বলা হয় যোগাযোগ প্রক্রিয়া।
ভাষাবিদরা ভাষাকে ব্যাখ্যা করে থাকেন ঠিক এভাবে, যেমন- ভাষার কিছু আবশ্যিক উপাদান আছে, যেমন- ধ্বনি, শব্দ, বাক্য ও অর্থ আর এই ৪টি আবশ্যিক উপাদান নিয়েই ভাষা বিজ্ঞানে গড়ে উঠেছে যথাক্রমে ধ্বনিবিজ্ঞান ও ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব, বাক্যতত্ত্ব ও অর্থতত্ত্ব এবং প্রয়োগিত অর্থ বৈচিত্র নিয়ে গড়ে উঠেছে প্রয়োগার্থবিজ্ঞান। প্রত্যেকটি ভাষারই এই আবশ্যিক উপাদানগুলো আছে, সে ভাষার লিখিত রূপ থাক বা নাই থাক।
অর্থাৎ যোগাযোগের জন্য ভাষার রূপ ত্রিবিধ, যথা- বাচন ও লিখন (দৃশ্যমান) এবং অবাচনিকতা। যদিও অবাচনিকতা এক অদৃশ্য কারণে আমাদের চিন্তা ভবনায় এবং একাডেমিতে কম গুরুত্ব পেয়েছে।
ভাষার উপরিউক্ত আবশ্যিক উপাদানগুলোর মধ্যে যদি এতটুকু সমতার বিঘ্ন ঘটে তখনই তৈরি হবে “ভাষা বৈকল্য”, ব্যহত হবে যোগাযোগ। আর এই সমতার বিষয়টি শেখা এবং বিভিন্ন ধ্বনির সমন্বয়ে যে শব্দ তৈরি হয় তা একটি শিশু মাতৃগর্ভে থাকাকালীন সময়েই কানে শোনার মাধ্যমে আয়ত্ত করে থাকেন এবং জন্মের পর পরই বয়স বাড়ার সাথে সাথে বয়স অনুপাতে তা বিকশিত হতে থাকে।
সুতরাং, রোগশোক, স্নায়ুগত এবং শারীরিক প্রতিবনন্ধকতার দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে যদি কোন মানুষের সম্ভাবনাময় ভাষা বিকাশ পর্বটি ব্যহত হয় তখনই চিকিৎসা ভাষাবিদরা রোগের কারণে ভাষার কোন উপাদানটি আক্রান্ত হয়েছে তা সনাক্ত ও নির্ধারণ করেন এবং কিভাবে আরোগ্য করা যায় তার উপায় উদঘাটন করেন। আর এই প্রক্রিয়াকেই চিকিৎসা শাস্ত্রে বলা হয় স্পিচ ল্যাংগুয়েজ থেরাপী। যে সকল ভাষাবিদরা এই সকল রোগ নিয়ে কাজ করেন তাদেরকে বলা হয় চিকিৎসা ভাষাবিদ অথবা স্পিচ ল্যাংগুয়েজ স্পেশালিষ্ট অথবা স্পিচ ল্যাংগুয়েজ প্যাথলজিষ্ট। যে কোন ভাষা বৈকল্য রুগীকে প্রথমে চিকিৎসক দিয়ে রোগের কারণ নির্ধারণ করতে হবে। প্রয়োজন অনুযায়ী ঔষধও প্রদান করতে হবে।
লিখেছেন: ডাঃ ফাহমিদা ফেরদৌস
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসা ভাষাবিদ
সহকারী অধ্যাপক, (মনোরোগ বিদ্যা বিভাগ)
জেড এইচ সিকদার ওমেন্স মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।

Previous articleবিএসএমএমইউ মনোরোগবিদ্যা বিভাগের ফেব্রুয়ারী মাসের বৈকালিক সেবা সময়সূচি
Next articleশিল্পীসত্তাটাকে বাঁচাতেই নেশা ছেড়ে ফিরে আসা-ব্যান্ডশিল্পী মাকসুদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here