গর্ভধারণের প্রস্তুতি

0
53

প্রতিটি ছেলেমেয়েই সাধারণত বিয়ের স্বপ্ন দেখে। বিবাহিত হিসেবে নতুন জীবন শুরু করার দু’এক বছর পরই এক নতুন চাহিদা অনুভব করে, আর তা হলো সন্তান পাওয়ার চাহিদা। সব দম্পতি চায় ভালো মা-বাবা হতে যাতে সে সুন্দর, সুস্থ ভবিষ্যতের অধিকারী হতে পারে। এই চাওয়া দেশ, জাতি ও সময় ভেদে প্রায় অভিন্ন। কিন্তু মা-বাবা হিসেবে এই প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষাই যথেষ্ট নয় বরং মা-বাবা হিসেবে সন্তান জন্ম দেয়ার আগেই আমাদের ভাবতে হবে আমরা সন্তান জন্ম দেয়ার ও যত্ন নেয়ার জন্য প্রস্তুত কিনা। আমাদের দেশে বেশিরভাগ দম্পতিরাই কোনো রকম প্রস্তুতি ছাড়াই বাবা-মা হয়ে যান। ফলে শিশুর লালন-পালনের গুরু দায়িত্বটি পালনের জন্য নিজেরা যেমন অসুবিধায় পড়েন তেমনি শিশুর জীবনকেও বিপর্যন্ত করে তোলেন।

এবার দেখা যাক মা-বাবা হওয়ার প্রস্তুতি বলতে কি বোঝায়।

যখন কোনো দম্পতি ভালোভাবে চিন্তা করে সন্তান পাওয়ার এবং তাকে সুস্থ  ভাবে যত্ন নেয়ার জন্য নিজেদের সবদিক থেকে উপযুক্ত মনে করেন এবং সেই উপযুক্ততার প্রতি নিজেদের মানসিক সমর্থন থাকে তাকেই আমরা মা-বাবা হওয়ার প্রস্তুতি বলতে পারি। এই প্রস্তুতি মূলতঃ চার ধরনের হতে পারে। মানসিক প্রস্তুতি, শারীরিক প্রস্তুতি, আর্থিক প্রস্তুতি এবং দ্বিতীয় সন্তান জন্মের ক্ষেত্রে ভাই-বোনকে প্রস্তুত করা।

মানসিক প্রস্তুতি

মা-বাবা হওয়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি বলতে বোঝায় গর্ভকালীন সময়কে স্বাভাবিক ভাবে গ্রহণ করা, মা-বাবা হিসেবে নিজেদের পরিচিতিকে সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহণ করা, সন্তানের যত্নের বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা, সন্তানকে ঘিরে নিজেদেরকে সুখে রাখার পরিকল্পনা করা, সন্তানের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়া ও মা-বাবা হিসেবে জীবনকে উপভোগ করার প্রস্তুতি।

মানসিক প্রস্তুতি ছাড়াই যখন কেউ মা-বাবা হয়ে যায় তখন সন্তান আসার পর সংসার জীবনে যে পরিবর্তন আসে তা সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মা সন্তানের প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগী হয়ে পড়েন। ফলে স্বামী ও পরিবারের অন্যান্যদের প্রতি বেশি অবহেলা দেখান। পরিবারের সদস্যরা বিশেষভাবে স্বামী বিচ্ছিন্ন  হয়ে পড়ে এবং প্রতিরোধ করতে শুরু করে; ছোটখাটো বিষয় নিয়েই স্বামী-স্ত্রী’র মধ্যে সমস্যা হতে শুরু করে। আবার যদি সন্তান অনেকটা অপ্রত্যাশিত থাকে এবং মায়ের বয়স কম থাকে তবে মা সন্তানের প্রতি যথেষ্ট মনোযোগী হয় না, সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতে আগ্রহী হয় না, সন্তানের সাথে জড়িত সব ধরনের কাজ কর্মকেই বাড়তি ঝামেলা মনে করে। ফলে সন্তান যেমন ঠিকমত যত্ন পায় না তেমনি মায়ের মেজাজও খিটখিটে হয়ে যায়। আর খিটিখিটি মেজাজ হওয়ার কারণেই শুরু হয় পারিবারিক অশান্তি। মানসিকভাবে প্রস্তুত না থাকার ফলে সন্তানের বাবা সন্তান আসার পর তার দায়িত্ব কী হবে, কীভাবে স্ত্রী ও সন্তানের যত্ন নেবে, কিভাবে স্ত্রীকে নানা কাজে সাহায্য করবে এসব নিয়ে কোনো পরিকল্পনা করে না। মনে করে শিশু যত্ন ও লালন পালনের পুরো দায়িত্বই মায়ের। ফলে বাবা শিশুর যত্নের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হন, শিশুর বিকাশে অসুবিধা হয়, আবার শিশুটিকে নিয়ে মায়ের অতিরিক্ত ব্যস্ততার কারণে মা নিজেকে বঞ্চিত মনে করেন। এই মানসিক প্রস্তুতি শুধু সন্তান জন্মের পরেই নয় বরং গর্ভকালীন সময়কে স্বাভাবিক ভাবে একটু বিশেষ সময় ভাবার, নিজেকে মানসিক শান্তিতে রাখার, নিজের শরীরকে সুস্থ রাখার এবং সহজ কর্মে  লিপ্ত থাকার প্রস্তুতিকেও বোঝায়।

শারীরিক প্রস্তুতি

মা-বাবা হওয়ার শারীরিক প্রস্তুতি বলতে বোঝায় স্বামী-স্ত্রীর বয়স, শারীরিক অবস্থা এবং দুটি সন্তানের মধ্যে সময়ের ব্যবধান প্রভৃতিকে বিবেচনা করে সন্তান নেয়ার প্রস্তুতি। শারীরিক প্রস্তুতির জন্য যেসব নিয়ে ভাবতে হবে তা হলো:

মা-বাবা বিশেষ করে মায়ের বয়স যখন অনেক কম (২০এর কম) হবে তখন সন্তান নেয়া ঠিক নয়। যখন বাবার বয়স ৪৫ এবং মায়ের বয়স ৩৫এর বেশি হয় তখন সন্তান নেয়া মা ও সন্তানের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়। এক্ষেত্রে সন্তানের মধ্যে নানা ধরনের প্রতিবন্ধীতা (disability/impairment) হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই নিজেদের বয়সের কথা চিন্তা করেই মা-বাবা হওয়ার প্রস্তুতি নিতে হয়।

স্বামী-স্ত্রীর অসুখ বিসুখ ও শরীরের অন্যান্য অবস্থার কথা বিবেচনা করে মা-বাবা হওয়ার কথা ভাবতে হয়। মায়ের রক্ত স্বল্পতা, বাবা-মায়ের বহুমূত্র রোগ, এইচ আই ভি ভাইরাসের উপস্থিতি, আরএইচ ফ্যাক্টর ইত্যাদি নানা বিষয় বিবেচনা করে স্বামী-স্ত্রীকে ঠিক করতে হবে তারা বাবা-মা হতে শারীরিক ভাবে প্রস্তুত কিনা।

খুব কাছাকাছি সময়ে দুটো সন্তান নেয়া ঠিক নয়। এতে একদিকে যেমন মায়ের শরীর পরিবর্তী সন্তান ধারণের জন্য তৈরি হয় না তেমনি দুটো শিশুর যত্ন নেয়া মা-বাবার জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। কাছাকাছি দুটো সন্তানের জন্ম বাবা-মায়ের জীবনকে বিপর্যস্ত করে, তাদের পারিবারিক শান্তি বিঘ্নিত হয়। এজন্য দুটো সন্তানের মধ্যে জন্ম বিরতিকাল (birth spacing) দু’বছরের কম হওয়া উচিত নয়। আবার অনেক বেশি বছরের বিরতিও ঠিক নয়। তাই শারীরিক প্রস্তুতির ক্ষেত্রে জন্ম বিরতি ব্যাপারটা বিবেচনা করতে হয়।

আর্থিক প্রস্তুতি

গর্ভকালীন মায়ের চিকিৎসা, যত্ন, সন্তান জন্মানো এবং ছোট শিশুকে লালন পালন করা সব মিলিয়ে একটি শিশুর আগমনের সাথে অনেক ধরনের খরচ জড়িত। তাই সন্তান নেয়ার পরিকল্পনা করার সময় নিজেদের আর্থিক সংগতি, আয়ের অবস্থা ও অন্যান্য খরচ প্রভৃতির কথা বিবেচনা করতে হয়।

monon-600

ভাই/বোনকে প্রস্তুত করা

দ্বিতীয় সন্তান জন্মের ক্ষেত্রে প্রথম সন্তানটিকে এমন ভাবে তৈরি করতে হবে যাতে সে অত্যন্ত আগ্রহে তার ছোট ভাই/বোনের জন্য অপেক্ষা করে এবং জন্মের পর তাকে আনন্দের সাথে গ্রহণ করে। প্রায়ই দেখা যায় একটি শিশু যখন বোঝে যে তার বাবা-মা আরেকটি সন্তানের বাবা-মা হতে যাচ্ছে তখন শিশুটি মনে মনে ভাবে তার জায়গা দখল করতে আরেকজন আসছে। সে তখন ঈর্ষান্বিত ও শঙ্কিত হয়। ভাবে এখন থেকে বাবা-মা তাকে আর আদর করবে না কিংবা তার আদর ভাগাভাগি হয়ে যাবে ছোট ভাই/বোনের সাথে। এই অনুভূতি শিশুটির জন্য যথেষ্ট কষ্টের কারণ হয়, তার মন খারাপ থাকে, মা-বাবাকে আঁকড়ে রাখতে চায় এবং এক ধরনের অনিশ্চয়তায় ভোগে। তবে শিশুটির এই অবস্থার জন্য অনেকাংশে দায়ী মা-বাবা, পরিবারের সদস্য ও অন্যান্যরা। মা-বাবা ও অন্যান্যরা এমন কিছু কথা বলেন যা শিশুর এই ঈর্ষাবোধের জন্ম দেয় এবং তা বাড়িয়ে তোলে। সাধারণত তারা যেসব কথা বলেন তার কিছু উদাহরণ হলো:

তুমি এখন আর ছোট নও অনেক বড় হয়ে গেছো, কারণ তোমার ছোট ভাই বা বোন আসছে।

ছোট বাবু আসলে কেউ তোমাকে আর আদর করবে না। সবাই শুধু ছোট বাবুকেই আদর করবে।

এখন থেকে মা বাবা সব সময় ছোট বাবুকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, তোমাকে নিয়ে চিন্তা করার সময় থাকবে না।

ছোট বাবু এলে তুমিতো আর মায়ের কাছে ঘুমাতে পারবে না, তাই এখন থেকেই দাদু/নানুর কাছে ঘুমানোর অভ্যাস করো।

তোমার ছোট ভাই/বোন হবেতো তাই আম্মু অসুস্থ। আম্মুকে বিশ্রাম করতে দাও, বিরক্ত করো না।

মূলত এই ধরনের কথাবার্তা শুনেই শিশু ভাবতে শুরু করে যে তার জন্য আদর ফুরিয়ে গেছে। সবাই ছোট বাবুকে আদর করবে। এই চিন্তা থেকেই তার মনে অনাগত ছোট ভাই/বোনের প্রতি ঈর্ষাবোধ তৈরি হয়। এর ফলে মাকে নানা ভাবে কষ্ট দেয়ার বা আঘাত করার কথা ভাবে, কখনও কখনও আঘাত করে এবং ছোট ভাই/বোনের জন্মের পর তাকে মারে এবং নানা ভাবে কষ্ট দেয়ার চেষ্টা করে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য মা-বাবা এবং অন্যান্যদের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তারাই কেবল পারেন শিশুকে এমনভাবে তৈরি করতে যাতে সে ছোট বাবুকে নিজের শত্রু না ভেবে বরং বন্ধু ভাবে এবং ছোট বাবুর সাথে কীভাবে সময় কাটাবে, কীভাবে খেলবে, কীভাবে গল্প করবে এসব নিয়ে নানা রকম মজার মজার পরিকল্পনা করতে পারেন। যেসব করলে ছোট ভাই বোনের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব গড়ে উঠবে সেগুলো হলো:

মা গর্ভবতী হওয়ার পর এ খবরটা শিশুর কাছে লুকিয়ে না রেখে এমনভাবে বলা যাতে সে মনে করে মা তার জন্য একটি ছোট বন্ধু আনছে।

ছোট শিশু আসলে মা-বাবা ব্যস্ত হয়ে যাবে এমন কথা না বলে বরং বলা ‘ছোট বাবু আসলে তো তুমি খুবই ব্যস্ত হয়ে যাবে। ছোট বাবুর সাথে কথা বলা, খেলা এসব নিয়ে এতই ব্যস্ত হয়ে পড়বে যে আমাদের দিকে তোমার খেয়ালই থাকবে না।’

ছোট ভাই বোন আসার পর ঘর সাজাতে যেসব পরিবর্তন আসবে বা নতুক যেসব কাজ কর্ম বাড়বে সেসব পরিকল্পনার সময় শিশুটিকে অবশ্যই সামনে রাখতে হবে এবং তার মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে।

ছোট ভাই/বোনের জন্য শিশুটি নিজে কী কী কাজ করতে পারে তা তাকে জিজ্ঞেস করতে হবে এবং খুঁজে বের করতে সাহায্য করতে হবে। কাজগুলো খুবই সাধারণ হতে পারে। যেমন- ছোট বাবুর পাশে বসে থাকা, তাকে গান শোনানো, কাঁথা ভাঁজ করে রাখা, ছোট বাবুর খেলনা গুছিয়ে রাখা, ছোট বাবুর দোলনা দোলানো, দোলনার উপরে খেলনা থাকলে মাঝে মাঝে তা নাড়িয়ে দেয়া, বেড়াতে যাওয়ার সময় ছোট বাবুর ঝুড়ি/ব্যাগ নেয়া ইত্যাদি।

ছোট শিশুটি দেখতে কেমন হয়েছে এ প্রসঙ্গ আসলে বড় শিশুটিকে উপেক্ষা না করে বরং বলা দু’জনে অনেকটা একই রকম হয়েছে। ছোট শিশুটি বেশি সুন্দর এমন কথা বড় শিশুটির সামনে বলা যাবে না। ছোট শিশুর জন্ম হলে সাধারণত যারা দেখতে আসেন তারা কোনো না কোনো উপহার নিয়ে আসেন। কিন্তু যখন ছোট শিশুটির জন্য উপহার আনা হয় এবং বড়টির জন্য কিছুই আনা হয় না তখন স্বাভাবিক ভাবেই বড় শিশুটির মন খারাপ হয়। পরিবারের লোকেরা উপহার কেনার সময় ছোট এবং বড় দুজনার জন্যই একসাথে উপহার কিনবেন। বাইরের লোকেরা যদি একটি উপহার আনেন তবে তা আস্তে করে সরিয়ে নিতে হবে এবং পরে তার থেকে কোনোটি ছোট শিশুকে দিতে হবে এবং কোনোটি বড় শিশুকে দিতে হবে। আর যদি এমন কিছু উপহার আসে যা ভাগ করা যায় তবে তা দুজনের মধ্যে ভাগাভাগি করে দিতে হবে। ছোট শিশুটির একা ছবি বেশি না তুলে বরং দুজনের একত্রে ছবি তুলতে হবে। ছোট শিশুটি কয়েক মাসের হলে বড় শিশুটিকে নিরাপদে বসিয়ে ছোট শিশুটিকে কোলে দেয়া যায়। এক্ষেত্রে বাবা-মা ছোট শিশুটিকে আলগোছে ধরে রাখতে পারেন। কোলে নেয়ার ফলে ভাই/বোনের প্রতি শিশুটির মমত্ব বেড়ে যায়।


প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।

Previous articleগণমাধ্যম বা টেলিভিশনগুলো প্রতিদিনই অপরাধ করছে: তুষার আব্দুল্লাহ
Next articleমানসিক রোগ নিয়ে ধারণা, ভুল ধারণা এবং বিবিধ  (পর্ব –৮)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here