খুব খুঁতখুঁতে বা শুচিবাইতা কি কোন রোগ?

খুব খুঁতখুঁতে বা শুচিবাইতা কি কোন রোগ?

বরাবরের মতো এবারও খুব ভালো রেজাল্ট করে ক্লাস টেনে উঠলো মনন। বয়সের তুলনায় খুব চুপচাপ আর সব বিষয়ে অতিরিক্ত সিরিয়াস হিসেবেই সবার কাছে সে পরিচিত। বাবা-মা ও এক বোনকে নিয়ে ছোট এক পরিবারে নিরিবিলি পরিবেশে বেড়ে উঠা তার। কিন্তু অনেকদিন ধরেই মননের মন বেশ খারাপ থাকে। প্রায়ই মনে হয়, সবকিছু আপাতত ঠিকমতো চললেও তার কিছু কাজ, আচরণ, চিন্তা ঠিক যেন স্বাভাবিক না।

খুঁতখুঁতে ভাবটা ইদানিং যেন খুব বেড়ে গেছে। একদম আজেবাজে অপ্রয়োজনীয় একই চিন্তা জোর করে বারবার মাথায় ঢুকতে থাকে। তালাটা বা সুইচটা দু-তিনবার চেক করার পরেও মনে হয় ঠিকমতো বন্ধ আছে তো? ভালোমতো ধোয়ার পরেও মনে হয় হাতে কি ময়লা লেগে আছে? ফলে একবার দু’বারের জায়গায় ১৫-২০ বার হাত ধোয়া, তালাটা বা সুইচটা কমপক্ষে ৮-১০ বার চেক করা। যেকোন কাজ একবার শেষ করার পর আবার প্রথম থেকে শুরু করা ইত্যাদি যেন ক্রমাগত বেড়েই চলছে।

OCD_01-08-03-15

বিশেষ করে এবারের অঙ্ক পরীক্ষায় তো বেশ মুশকিলেই পড়তে হয়েছিলো। একটা জটিল অঙ্ক করার সময় হঠাৎকরেই মাথায় আসলো ৪x১০ কি আসলেই ৪০? ক্লাসের তুখোড় ছাত্র মননের যদিও এ ব্যাপারে কোন সন্দেহই নেই, তবু এ অমূলক প্রশ্নটি যেন কোনভাবেই মাথা থেকে তাড়াতে পারলো না। ফলে নানাভাবে মেলাতে থাকে ৪x১০ যে ৪০ হয় সে বিষয়টি। বাংলা পরীক্ষার সময়ও আরেকটি সমস্যা, প্রতি তিন লাইন লেখার পরেও মনে হয় দাঁড়ি-কমা কি ঠিক মতো হয়েছে? ফলে তিন লাইন লেখার পরেও শুরু করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চেক করা। পরীক্ষার সময় চলে যায় কিন্তু এক রকম বাধ্য হয়েই যেন বারবার দাঁড়ি-কমা চেক করতে থাকে সে।

এমনকি মাঝে মধ্যে খুব অদ্ভুত চিন্তা হানা দেয় মননের মাথায়। যেমন- বাম পা’টা আগে ফেললে দুনিয়াটা ধ্বংস হবে অথবা লাল রঙের কিছু গায়ে লাগলেই এইডস হয়ে যাবে ইত্যাদি। শুধু তাই না, কখনও কখনও খুব অশালীন শব্দ, দৃশ্য মাথায় ঢুকে পড়ে যা তাকে ভয়াবহ রকমের কষ্ট দেয়।

ক্রমাগত এসব অদ্ভুত অভিজ্ঞতায় খুব বিচলিত হয়ে যায় সে। দৈনন্দিন জীবনের কোন কিছুই যেন সে স্বাভাবিক ভাবে করতে পারে না। বাথরুমে সময় লাগে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, নামাজের সময় চলে যায় কিন্তু শেষ হয়না অযু করা। প্রতিটা বিষয়েই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। মাঝে মাঝে খুব কান্না পায়, কখনও মনে হয় ‘‘তাহলে কি আমার ‘মাথা-খারাপ’ হয়ে যাচ্ছে?” মাথা থেকে এসব চিন্তা ছুঁড়ে ফেলতে চায়, চেষ্টা করতে করতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে যায়। এক সময় মনে হয় এ রকম ভয়ংকর অবস্থা থেকে তার বোধহয় কোন নিস্তার নেই।

এক সময় বাধ্য হয়েই বাবা-মাকে বলে তার সমস্যাটি। বাবা-মা মননকে নিয়ে শরণাপন্ন হয় মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে। মনোযোগ দিয়ে শোনার পর চিকিৎসক বলেন, মনন বিশেষ ধরনের মানসিক সমস্যায় ভুগছে, যার নাম অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার (Obsessive Compulsive Disorder) বা সংক্ষেপে ওসিডি (OCD)। তবে না, মাথা অস্বাভাবিক হয়ে যাবার যে ভয়টা মনন পাচ্ছে সে রকম গুরুতর কিছু না।

OCD যদিও লঘুতর মানসিক সমস্যার মধ্যে পড়ে, এর উপসর্গগুলো রোগীকে যথেষ্ট কষ্ট দেয়।

Obsessive Compulsive Disorder এর মূলত দুটি অংশ: Obsession ও Compulsion। এ ধরনের সমস্যায় ব্যক্তির মনে অপ্রয়োজনীয় একই ধরনের চিন্তা, ইচ্ছা, দৃশ্য ইত্যাদি বারবার জোর করে মাথায় ঢুকে পড়ে। এসব চিন্তায় ব্যক্তি ভয়াবহ কষ্ট পায় বা অস্বস্তি বোধ করে; কিন্তু কোনমতেই এগুলো সে মাথা থেকে সরাতে পারেনা। আর Obsession এর কারণে ব্যক্তির Compulsion হয়। Compulsion হলো একই ধরণের কাজ বারবার করা। যেমন- বারবার হাত ধোয়া, চেক করা, মনে মনে count করা ইত্যাদি।

OCD এর উপসর্গগুলো এমন থাকে যা তার প্রাত্যহিক জীবনযাত্রাকে নানাভাবে ব্যাহত করে এবং জীবনের গুণগত মান নষ্ট করে। মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মননকে আশ্বস্ত করেন যে, শুধু সেই নয় সারা পৃথিবীতে প্রায় ১.১% হতে ১.৮% মানুষ এ ধরনের অদ্ভুত সমস্যায় ভুগছেন। এ ধরনের সমস্যা যেকোন শ্রেনি পেশার মানুষেরই হতে পারে।

তবে OCD কেন হয় এ প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয় সুনির্দিষ্টভাবে এর কারণ এখনও অজানা। তবে গবেষণালব্ধ ফলাফলে ধারণা করা হয়, এর মূল কারণ জৈবিক (Biological)। মস্তিষ্কের নানা ধরনের নিউরোট্রান্সমিটারের অসামঞ্জস্যতা (বিশেষ করে সেরোটনিন), জ্বীনগত ত্রুটি ইত্যাদি এ সমস্যার জন্য দায়ী। রক্তের সম্পর্কের কারো (বিশেষতঃ মা-বাবা, ভাই-বোন) থাকলে এ রোগের সম্ভাবনা বেশি থাকে।

OCD কি ভালো হয়? -এ প্রশ্নের উত্তরে চিকিৎসক বলেন, চিকিৎসা ছাড়া এ সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী (Chronic) হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে, যেখানে মাঝে মাঝে উপসর্গগুলো বাড়বে আবার কমবে। কারো কারো ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য উপসর্গগুলো দেখা যায় (Episodic) এবং অন্য সময় সম্পুর্ণ ভালো থাকে। শৈশব বা কৈশোরে এ সমস্যা শুরু হলে অনেক ক্ষেত্রে সারা জীবনব্যাপী এ রোগ থাকতে পারে (Life-time), তবে ৪০ ভাগ ক্ষেত্রে পূর্ণ বয়ষ্ক হবার পর উপসর্গসমূহ একদম কমে আসে। তবে এসব তথ্যের পরেও আশার কথা হলো এ রোগটির খুব ভালো আধুনিক চিকিৎসা রয়েছে। ওষুধ ও কাউন্সেলিং (সাইকোথেরাপী) -এর সমন্বিত চিকিৎসার মাধ্যমে এর উপসর্গসমূহ অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। বর্তমানে OCD-র নানা ধরনের ওষুধ রয়েছে, যার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কম এবং কার্যকরী ক্ষমতা চমৎকার।

মনে রাখা দরকার, OCD-তে ভুক্তভোগী ব্যক্তি স্বাভাবিক জীবনযাপন করলেও এক দীর্ঘ কষ্টকর প্রক্রিয়ার মধ্যে যায়। সুতরাং এক্ষেত্রে পরিবারের সহযোগিতা ও সহমর্মী মনোভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যেকোন মানসিক চাপে এর উপসর্গের তীব্রতা বাড়ে বলে যেকোন বিষয়ে যতটা সম্ভব মানসিক চাপ কম দিতে হবে। বারবারই একই কাজ করাকে (Compulsion) প্রশ্রয় দেয়া বা বকা-ঝকা, বিরক্তি প্রকাশ বা কটুক্তি করা যাবেনা। মানসিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ মতো রোগীর প্রতি পরিবারের সদস্যদের আচরণ এ ধরনের কষ্টকর সমস্যা মোকাবেলা করতে সাহায্য করবে।

ডা. মেখলা সরকার
মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ
সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা

Previous articleমানসিক রোগ: প্রয়োজন সহযোগিতার
Next articleগর্ভাবস্থায় শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশে যা করবেন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here