কৈশোরের ঘটনাটির পর পুরুষ জাতিটার ওপর ঘেন্না ধরে গিয়েছিল

খুন-ধর্ষণের ঘটনাগুলো সংবাদে ওঠে আসে বলে আমরা সেগুলো জানতে পারি। কিন্তু আমাদের জানার বাইরেও অসংখ্য লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটে প্রতিনিয়ত যেসব ঘটনা না সংবাদে ওঠে আসে, না প্রকাশিত হয় জনসম্মুখে। শুধু লাঞ্ছিত যে সেই বয়ে বেড়ায় এর ভার। আমাদের চেনা গণ্ডির প্রায় প্রত্যেকটি মেয়েকেই শৈশব, কৈশোর এবং পরিণত বয়সে মুখোমুখি হতে হয় এরকম লাঞ্ছনার। যা হয়তো সে সারাজীবনে কখনোই কারো কাছে প্রকাশ করে না। কিন্তু অনেক সময়ই তার পুরো জীবনের ওপর গভীর রেখাপাত করে এসব ঘটনা। নিজের জীবনের এমনই তিক্ত অভিজ্ঞতার স্মৃতি নিয়ে মনের খবরের মুখোমুখি হয়েছেন অলকা (ছদ্মনাম)। অলকার নিজের অভিজ্ঞতার গল্প বা সচেতনতা হয়তো অন্য একজনের জন্য সহায়ক হতে পারে এমন ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য।
এখন কী করছেন?
একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি; পাশাপাশি একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনে কাজ করছি।
পড়াশুনা বা কাজ করতে কত মানুষের সাথেইতো মিশতে হয়, ভালো অভিজ্ঞতা তো অবশ্যই অনেক আছে। এমন কোনো যন্ত্রণা বা তিক্ততার অভিজ্ঞতা আছে কি, যা বয়ে বেড়াচ্ছেন অথচ প্রকাশ করা হয়নি; যা প্রকাশ করলে হয়তো অন্য কেউ সচেতন হবে?
শৈশবের দু’টো দুঃসহ অভিজ্ঞতা আছে, যা এখনো মাঝে মাঝেই মনে পড়ে৷ দু’টো ঘটনাতেই আমি অল্পের জন্য ধর্ষণের হাত থেকে বেঁচে যাই৷ এখনো সেই রাতগুলো মনে পড়লে বুক ধরফর করে, আগে প্রায়ই দুঃস্বপ্ন দেখতাম৷
কত বছর বয়সে আপনি সেই ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিলেন?
প্রথম ঘটনাটি ছিল ৬ বছর বয়সে। আর দ্বিতীয়টি ১৫ বছর বয়সে৷
যাদের দ্বারা আপনি আক্রান্ত হয়েছিলেন তাদের বিষয়ে কি কিছু বলা যাবে?
একজন ছিল আমার খুব কাছের বান্ধবীর বড় ভাই, আরেকজন আমার বাবার ছাত্র – যাকে আমি আপন বড় ভাই হিসেবে দেখতাম ৷ মানসিকভাবে এরা আত্মীয়ের চেয়েও অনেক বড় ভরসার জায়গা ছিল আমার কাছে৷
যখন আপনি আক্রান্ত হন তখন কি বুঝতে পেরেছিলেন যে আপনার সাথে খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে, আপনাকে আত্মরক্ষা করতে হবে?
একদম শৈশবে যখন আমি আমার বান্ধবীর ভাই দ্বারা আক্রান্ত হই তখন কেন সে বারবার আমাকে বিবস্ত্র করার চেষ্টা করছে বুঝতে পারিনি৷ সে বলেছিল এটা একটা মজার খেলা৷ পরে তাদের বাসার কাজের মহিলার কারণে সে যাত্রায় বেঁচে গিয়েছিলাম৷ পরের ঘটনাটা ঘটায় আমার বাবার ছাত্র, যাকে বড় ভাইয়া বলে ডাকতাম । একদিন রাতে সিড়ির ওপর আমাকে জাপটে ধরে ৷ তার অস্বাভাবিক আচরণ এবং স্পর্শকাতর জায়গায় হাত দেয়ার প্রবণতা দেখে আমি তাকে জোরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে এক দৌড়ে বাসায় চলে আসি৷
ঐ ঘটনাগুলোর পর আপনি কীরকম মানসিক অবস্থার ভেতর দিয়ে গিয়েছেন?
ছোটবেলার ঘটনাটির পর আমি খুব চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলাম৷ ভয় হত, আতঙ্কে থাকতাম, আর সেই রাতের ঘটনাটা বোঝার চেষ্টা করতাম, কেন আমার সাথে সে এমন আচরণ করলো৷ আর কৈশোরের ঘটনাটির পর পুরুষ জাতিটার ওপর ঘেন্না ধরে গিয়েছিল, আমি কোনো পুরুষকে বিশ্বাস করতে পারতাম না, যা আমি এখনও পারি না৷ লেখাপড়ায় মন ছিল না, শুধু কতগুলো প্রশ্ন জাবর কেটে যেতাম মনে মনে। কেবলই মনে হত – ‘আমি কী দোষ করেছি, কেন আমার সাথে এমন হবে? ’
তৎক্ষণাৎ কাউকে জানিয়েছিলেন ঘটনাগুলো সম্পর্কে?
দুটো ঘটনাই মাকে বলেছিলাম ৷ ব্যাপারগুলো বাজে পর্যায়ে যায়নি বলে মাকে সিরিয়াস হতে দেখিনি৷ তবে ব্যাপারগুলো বাবা জানতেন, এরপর আমাকে কখনো কোথাও একা যেতে দেননি বাবা৷ বাবাও আমাকে নিয়ে অনেক দুঃচিন্তা করতেন৷ আমাকে ক্রমাগত পরামর্শ দিতেন নিরাপদে চলার, সামনে এগিয়ে যাওয়ার৷
এই বিষয়গুলো কি আপনার মধ্যে কোনো স্থায়ী প্রভাব তৈরি করেছে?
ঘটনাগুলো আমাকে এখনো ভোগায় ৷ হঠাৎই চুপচাপ হয়ে যাই, একা কোথাও যাওয়ার সাহস পাই না, কোনো পুরুষকে বিশ্বাস করতে পারি না। বয়ফ্রেন্ডকেও বিশ্বাস করতে পারি না কেন যেন, মাঝে মাঝে তাকেও ওই লম্পটদের কাতারের লোক মনে হয় – পুরুষ তো ! লোকগুলোকে যখন মাঝেমাঝে সামনাসামনি দেখি তখন কেমন যেন লজ্জায়, ভয়ে, আতঙ্কে কুঁকড়ে যাই৷ খুব খুন করতে ইচ্ছা করে লোকগুলোকে ৷
এখন যদি আবার শৈশব ফিরে পান তাহলে এমন ঘটনা এড়াতে কী করতে চাইবেন?
শৈশবের সময়টা ফিরে পেলে আমার কিছুই করার থাকবে না যদি না আমার মা, বাবা কিংবা আমার স্কুলের শিক্ষকরা এই বিষয়ে ধারণা দেন৷ সেক্ষেত্রে ঘটনাটা কী ঘটছে তা আমার জানা থাকবে এবং আমি যথাসম্ভব নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করব৷ অথবা কিছু ঘটে গেলে অবশ্যই আমার বাবা-মা কে বলবো ৷
এমন ঘটনা এড়াতে অন্যদের জন্য আপনার কী পরামর্শ?
আমার মনে হয় আমাদের দেশে যে হারে শিশু ধর্ষণ, এমনকি ধর্ষণের পর হত্যা দিনকে দিন বেড়ে চলছে, তাতে বাবা-মা সহ স্কুলের শিক্ষকদেরও এই বিষয়গুলো নিয়ে শিশুদের সাথে আলোচনা করা উচিত, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধ যেহেতু বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মেয়ে শিশুদের সাথে এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা উচিত, বিষয়গুলো তাদের কাছে পরিষ্কার করা উচিত৷ কিন্তু যেহেতু যৌনতা আমাদের দেশে ট্যাবু, তাই বাবা-মায়েরা এসব বিষয়ে খুলে বলতে নিজেরাই লজ্জা বোধ করেন। যে কারণে ধর্ষিত পর্যন্ত হতে হয় শিশুদেরকে। এক্ষেত্রে সমাজ সচেতনতায় বিভিন্ন সেমিনারের আয়োজন করা দরকার৷ আর ছেলে শিশুগুলোকেও ছোট বেলা থেকেই এ বিষয়ে শিক্ষা দেয়া উচিত যে সহপাঠী মেয়েরা বা তার ছোট বোনদের সাথে কেমন আচরণ করতে হবে, কোনো ঘটনা দেখতে পেলে কীভাবে তার বান্ধবী অথবা বোনটাকে রক্ষা করতে হবে- এই মূল্যবোধগুলো শিশুদের মাঝে গড়ে তোলা দরকার ৷ আর ভিকটিম শিশুগুলো সারা জীবন সেই দুঃসহ স্মৃতিতে ভোগে৷ আমার এক বান্ধবী এখনো সিনেমায় কোনো রেপসিন থাকলে চিৎকার করে ওঠে, কাঁদে৷ ব্যাপারগুলো সে এখনো নিতে পারে না ৷ আমাদের দেশে যদি ভিক্টিমদের কাউন্সিলিং এর ব্যবস্থা থাকতো, তবে মনে হয় না আমি বা আমার বান্ধবীসহ হাজার হাজার মেয়েকে এই স্মৃতিগুলো এত বাজেভাবে বয়ে বেড়াতে হত৷ যেহেতু আমাদের দেশে এই ব্যবস্থা নেই, তাই সামাজিক সচেতনতা, পরিবারের সহযোগিতা পারে এরকম অনাকাঙ্ক্ষিত লাঞ্ছনা থেকে আমাদের রক্ষা করতে, ধর্ষণ প্রতিরোধ করতে, একজন ধর্ষিতাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে৷
আমাদের সমাজের প্রায় প্রত্যেকটি মেয়েই ঘরে-বাইরে, পথে-ঘাটে এরকম অজস্র লাঞ্ছনার সাক্ষী হয়ে বেড়ে ওঠে। স্ত্রীলিঙ্গ নিয়ে জন্ম নেয়া মানুষের কোনো বয়স নেই এই সমাজে। যেকোনো বয়সেই সে হয়ে ওঠে পুরুষের লোলুপতার শিকার। এই বিষয়গুলো নিয়ে নিশ্চুপ থাকা, এড়িয়ে যাওয়া বা চোখ বুজে না দেখার ভান করার ফলে তৈরি হচ্ছে আরো গভীরতর ক্ষত। আর এর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন পারিবারিক সচেতনতা। এইসব ঘটনা প্রকাশ পেলে ‘লোকে কী ভাববে’ জাতীয় ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে সন্তানের নিরাপত্তার স্বার্থে। মনে রাখা প্রয়োজন শুধু হাজারটা নিষেধের বেড়ি পড়িয়ে মেয়েশিশুকে বড় করলেই তার নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না।
সাদিকা রুমন, বিশেষ প্রতিবেদক
মনেরখবর.কম

Previous articleভূতের ভয়, মৃত্যু ভয় এবং অকারণ ভয়
Next articleছোটবেলা থেকেই আমার হস্তমৈথুনের অভ্যাস আছে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here