করোনার দিনে বাচ্চাদের কিভাবে সামলানো যায়?

করোনার দিনে বাচ্চাদের কিভাবে সামলানো যায়?
করোনার দিনে বাচ্চাদের কিভাবে সামলানো যায়?

দৃশ্য-১
জেরিন শহরে থাকে, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। স্কুল খোলা থাকার সময় বিভিন্ন ব্যস্ততায় কেটে যেত সময়। আর অবসর কাটতো মোবাইল আর ল্যাপটপে ভিডিও গেম খেলে। প্রথম দিকে করোনার জন্য ছুটি পেয়ে ভেবেছিল কোথাও বেড়াতে যাবে। তার বান্ধবীরা ঠিকই কক্সবাজার থেকে ঘুরে এসেছে। কিন্তু এরপরেই নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে কোথাও আর বেড়ানো হলো না। এখন ঘরের মধ্যে থাকতে থাকতে বিরক্ত লাগছে তার। ফলশ্রুতিতে ভিডিও গেইম নিয়েই কাটছে দিনরাত।
দৃশ্য-২
আকবর গ্রামে থাকে। খেলার মাঠেই তার বেশি সময় কাটতো এতদিন। কিন্তু গ্রামে বিদেশফেরত আসায় বাবা-মা আর বাইরে বের হতে দেয় না কোনভাবেই। সে প্রায় দিনই ঘ্যানর ঘ্যানর করতে থাকে মায়ের কানের কাছে। একটু বের হলে কি হয়। আচ্ছা, সে কারো সাথে খেলা করবেনা, এমনিতে একটু কথাবার্তা বলে আসবে। কিন্তু তার বাবা-মা পাশের উপজেলায় করোনা পজিটিভ প্রবাসী আছে শুনে আতংকে বের হতে দিতে রাজি না। বিশেষত ছেলের উপর ভরসা নেই বিন্দুমাত্র। ছাড়া পেলেই কোথায় না কোথায় যায় ঠিক নেই।
দৃশ্য-৩;
সোহানা তার পরিবারের সাথেই আছে আপাতত ঘরবন্দী হয়ে। তাদের বাসায় একসাথে অনেকেই থাকে। কিন্তু, সবার মধ্যেই যেন চাপা আতংক। বড়রা দিনরাত টেলিভিশনের সামনে করোনার খবর নিয়ে ব্যস্ত। তাঁদের সাথে ভাইয়ারাও যোগ দেয়, ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে। দিনরাত সারাক্ষণ ‘করোনা’ আর ‘করোনা’। ছোটরা কেউ একটু শব্দ করলেই বা লাফালাফি করলেই সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে থামাতে। বাবাকে কাজের প্রয়োজনে বাইরে বের হতে হয়। তাঁকে নিয়েও সবাই উদ্বিগ্ন। ঘরে ঢুকার সময় সেনিটাইজার মাখা, এরপর গোসল করা এসব এখন প্রাত্যহিক বিষয়। তিনিও বাইরে থেকে এসে যা যা শুনে এসেছেন তা নিয়েই আলোচনা করেন। ধীরে ধীরে সোহানার মনে হচ্ছে, তারা কেউই বাঁচতে পারবেনা এই করোনার হাত থেকে। তার বুক ধরফর করতে থাকে, নিশ্বাস আটকে আসতে থাকে একদিন, এবং কিছুক্ষণ পরেই জ্ঞান হারায়।
করোনা নিয়ে এভাবেই কাটছে আমাদের পরিবারের ছোট সদস্যদের বর্তমান দিনকাল। তারা অল্পদিনেই যেন হাঁপিয়ে উঠছে এই অবরুদ্ধ জীবনযাপনে। এমনিতে অন্য সময় হলে খুশিই লাগত এত লম্বা একটা বিরতি পেয়ে। কিন্তু, এখন সময়টা কেমন যেন উপভোগ্য হচ্ছে না। বড়দের অস্বস্তি, অশান্তি হয়তো একটা কারণ। বড়দেরও যেন একই সমস্যা। সেই সাথে যোগ হয়েছে এইসব বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা, তাদের মানসিক ভাবে চাঙ্গা রাখা এবং তাদের বিভিন্ন আবদার বা যন্ত্রণা সহ্য করার সমস্যা। তাই, এই অবরুদ্ধ সময় শিশু-কিশোরদেরকে নিয়ে কিভাবে সময় কাটানো যায় সেটাই আজকের লেখার উদ্দেশ্য। স্বাভাবিকভাবেই প্রাপ্তবয়স্করা এর বাইরে থাকবে।
সত্যিকার অর্থে, এখানে আমরা শুধু কি কি করা যায় তার একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করব। তাই, প্রথমেই কয়েকটি বিষয় আমাদেরকে ব্যাকরণের ‘নিপাতনে সিদ্ধ’ বা জ্যামিতির সুত্রের মত মেনে নিতে হবে বা মনে গেঁথে রাখতে হবে-
১) এদেরকে নিতান্ত জরুরী প্রয়োজন ছাড়া কোন অবস্থাতেই ঘরের বাইরে বের হবার অনুমতি দেয়া যাবে না। যেমন- ভালো লাগছে না তাই একটু দেখে আসি কি হচ্ছে বা একবার গিয়েই চলে আসব এমন অনুরোধে সাড়া দেয়া যাবে না।
২) সবসময়ের জন্য বাচ্চা বা শিশুকিশোরদের লালন-পালনের যে নীতি, তার থেকে বিচ্যুত হওয়া যাবে না। যেমন- কিছু তো করার নেই এ কারণে ঘন্টার পর ঘন্টা ভিডিও গেইম খেলতে বা টিভি দেখতে দেয়া যাবে না। কিংবা এখন তো স্কুল নেই-লেখাপড়া নেই, তাই রাত জাগা বা বেশি বেশি ঘুমালে সমস্যা নেই এমন ভাবা যাবে না।
৩) শিশুকিশোরদের নিয়ন্ত্রণ করতে সময়ে সময়ে উপস্থিত বুদ্ধি প্রয়োগই প্রধান সমাধান। শুধু কিছু সূত্র দিয়ে বা কোন একটা গৎবাঁধা ফরম্যাট দিয়ে সবক্ষেত্রে বা সব সময় কাজ হবে না।
৪) আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে Quality time বা কার্য্যকরী সময় নিশ্চিত করার বিষয়ে।
তাহলে, কি করা যায় বা কি করণীয়। আসুন সে সম্পর্কে কিছু সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে আলোচনা করি-
প্রথমতঃ আমাদের চেষ্টা করতে হবে এদেরকে বিভিন্ন রকম কর্মকান্ডে ব্যস্ত রাখা। এগুলো হতে হবে ওদের কাছে মজাদার, ওদের বেশ সময় কাটবে এমন, প্রতিদিনই অল্প অল্প করে ভিন্ন ভিন্ন আয়োজনের অনেক কিছু এবং সেখানে আপনাদেরও উপস্থিতি থাকবে। যেমন হতে পারে-
১) কিছু ঘরোয়া খেলাধুলার আয়োজনঃ ঘরের সবাই মিলে ছোট ছোট খেলা চালু করা যায়। যেমন- লুডু, দাবা, ক্যারাম প্রভৃতি। তবে, সংক্রমণের কোন কারণ থাকতে পারে বলে মনে হলে সেক্ষেত্রে ঘনঘন বা খুব কাছে না এসেও খেলা যায় এমন খেলাকে উৎসাহিত করা হয়। যেমন হতে পারে- লুকোচুরি খেলা। তবে, খুব বেশি সময় ধরে এ ধরণের খেলা চালিয়ে যাওয়া একটু কঠিন হতে পারে। এছাড়া ঘরে যদি খালি জায়গা থাকে তবে ফুটবল, ক্রিকেটও খেলা যায়। এসব বিষয়ে ছোটখাট টুর্নামেন্টও আয়োজন করে ফেলা যায় নিজেদের মধ্যে।
২) কিছু বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে অংশগ্রহণঃ যেমন বই পড়া প্রতিযোগিতা, উপস্থিত গল্প বলা প্রতিযোগিতা, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, কার্টুন আঁকা, শব্দজব্দের আয়োজন, সুডোকু খেলা, ধাঁধা খেলা প্রভৃতি। এসব কাজে অংশগ্রহণ করলে চিন্তাশীলতার চর্চা যেমন হবে, তেমনি সময়ও কাটবে ভাল। আর এসব বিষয়ে একবার আগ্রহ জন্মালে অল্পতেই বিরক্ত হবার সম্ভাবনা অনেক কম থাকে।
৩) কিছু বিনোদনমূলক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণঃ যেমন একসাথে বসে সিনেমা দেখা, নাটক দেখা, নির্ধারিত শব্দ দিয়ে গান গাওয়ার আসর, বালিশ খেলা, চেয়ার খেলা প্রভৃতি।
৪) কিছু শারীরিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণঃ যেমন শারীরিক ব্যায়াম করা, যোগ অভ্যাস করা, ঘরদোর পরিষ্কার করা, ঘর গুছিয়ে রাখার কাজ করা প্রভৃতি।
৫) কিছু নিয়মিত কর্মকান্ডে সময় ব্যয় করাঃ মন আগের মতই নির্ধারিত সময়ে পড়তে বসা, খাবার খাওয়া, ঘুমাতে যাওয়া, ঘুম থেকে উঠা, নামাজ পড়া বা প্রার্থনা করা। এগুলোতে যেন নিয়মের খুব একটা ব্যতিক্রম না হয় সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখা উচিৎ। কেননা, জীবনযাপনের পদ্ধতিতে যদি একবার পরিবর্তন চলে আসে তবে তা স্বাভাবিক করতে পরবর্তিতে অনেক বেগ পেতে হতে পারে। অন্যদিকে, এই সময়টাকে ব্যবহার করতে পারেন আপনার সন্তান যদি অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে থাকে তা নিয়ন্ত্রণে আনতে। যেহেতু, এই সময়টাতে আপনিও বেশি সময় ঘরে থাকছেন, তাই সরাসরি তদারকি করতে পারবেন আরো ভালোভাবে। তবে, বিষয়টিকে চাপাচাপি বা জোরাজুরির পর্যায়ে না নেয়াই ভাল।
দ্বিতীয়তঃ এই সময়টা হতে পারে পরিবারের সাথে একান্ত সময় কাটানোর একটা মাধ্যম। এইটাকে সঠিকভাবে ব্যবহারে উদ্যোগী হতে পারেন। যেমন- হতে পারে আপনার সন্তান আপনার সাথে প্রায়ই জিদ করে, আপনাকে ভুল বুঝে, বেশি অভিমানী। হতে পারে আপনাদের পরিবারের অন্য সদস্যদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি এত তীব্র যে তা ছোটদের মনেও সমস্যা করে। হতে পারে আপনার ব্যক্তিত্বের চাপে কিংবা ব্যস্ততার কারণে ওদের সাথে আপনার একধরণের মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়েছে। অথবা এসবের কোন কিছুই না, শুধু ব্যস্ততার কারণেই আপনার মন মত করে ওদের আদরযত্ন করতে পারেন না। সেক্ষেত্রে এটাই উৎকৃষ্ট সময়। কথা বলুন, গল্প করুন, উপরে বলা কর্মকান্ডে একসাথে সময় কাটান। তাদেরকে গল্প বা আড্ডার ছলে আপনার নিজের জীবনের কথা জানান, কিভাবে আপনি আগে অনেক সমস্যার সমাধান করেছেন, কিভাবে দুর্যোগে-বিপদে নিজের মনোবল ধরে রেখেছিলেন, জীবনে সুখের বা দুঃখের সময়গুলো কিভাবে কাটিয়েছেন। তাদেরকে বলতে পারেন আপনার জীবনের ভুল থেকে কি কি শিক্ষা পেয়েছেন, কিভাবে অপ্রাপ্তির বেদনা বা হতাশা মেনে নিয়েছেন। এইতো সময় তাদেরকে মানসিক ভাবে প্রস্তুত করার, সেখানেও কিছু সময় ব্যয় করুন। জানতে চান তাদের স্বপ্ন কি, তারা কি ভাবে, কি চায় তাদের মন। এইতো সময় তাদেরকে আর ভালো করে বুঝার, কাছে টানার।
তৃতীয়তঃ খেয়াল রাখুন তারা কোন কারণে কোন মানসিক চাপের শিকার হচ্ছে কিনা। আপনাদের আলাপ-আলোচনায়, কথা বলার ভঙ্গী, ভয় দেখানো কিংবা বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যম থেকে পাওয়া তথ্য তাদের মধ্যে আতংক তৈরি করছে কি না। সেক্ষেত্রে আপনিও কিছু সময় করোনা নিয়ে আলোচনা করতে পারেন, সঠিক তথ্যগুলো দিয়ে আতংকের পরিবর্তে সচেতনতা তৈরি করতে পারেন।
চতুর্থতঃ যদি তারা কথা না শুনে বা আপনার পরিকল্পনা অনুসারে আগাতে না চায় অথবা বিরোধিতা করে তাহলে কি করবেন সেটা ঠিক করে নিন। এসব ক্ষেত্রে স্বাভাবিক সময়ে যে সব নিয়ম মেনে আগানোর কথা বলা হয় সেভাবেই আগানো ভাল। যেমন- বিস্তারিত বুঝিয়ে বলা, আপনাদের যৌক্তিক চাওয়াগুলো সহজ ভাবে তুলে ধরা, প্রভৃতি। এরপরেও কথা না শুনলে মনস্তাত্ত্বিক কিছু শাস্তি দেয়া। মনস্তাত্ত্বিক শাস্তির বিষয়টি একটু জটিল। সংক্ষেপে একটা উদাহরণ দিতে পারি। যেমন- কেউ যদি টিভি দেখতে পছন্দ করে তবে তাঁর টিভি দেখার সময় কমিয়ে দেয়া এবং বুঝিয়ে বলা যে তুমি এই কাজটা করোনি বলে তোমার টিভি দেখার সময় কমিয়ে দেয়া হচ্ছে।
তবে সব কথার শেষকথা, অস্থির এই সময়ে কিছু সমস্যা হবেই। বিশেষতঃ যারা আগে থেকেই অনিয়ন্ত্রিত ভাবে চলতে অভ্যস্ত অথবা যেখানে বাবা-মা নিজেই অনিয়ন্ত্রিত ভাবে চলেন। যেখানে আগে থেকেই মা-বাবার সাথে সন্তানের মানসিক দূরত্ব আছে। তবে, সমস্যা আছে বলে হতাশ হওয়ার কিছু নেই। বরং ভাবতে পারেন, এই অস্থির সময়টা আসাতে নিজেদের ভুলগুলো চোখে পড়ল। সমস্যা তো চিহ্নিত হল। আগামীতে সমাধান আসবেই।
শারীরিক দূরত্ব মেনে চলার এই সময়টুকু কাটুক আমাদের মানসিক দূরত্ব কমানোর চেষ্টায়।

Previous articleশিশুদের মাধ্যমে নীরবে ছড়াতে পারে করোনাভাইরাস
Next articleকরোনায় মানুষ কেন বাইরে বের হচ্ছে?
ডা. পঞ্চানন আচার্য্য। স্থায়ী ঠিকানা চট্টগ্রাম। তবে, কলেজ শিক্ষক মায়ের চাকুরিসূত্রে দেশের বিভিন্ন জায়গায় কেটেছে শৈশব। মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবং উচ্চ-মাধ্যমিক চট্টগ্রাম কলেজ থেকে। সিলেট এম. এ. জি. ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ থেকে এম.বি.বি.এস পাসের পর সরকারি চাকুরিতে যোগদান করেন। মেডিক্যালে পড়ার সময় থেকেই মনোরোগ নিয়ে পড়ার প্রতি আগ্রহ। তাই, ইউনিয়ন পর্যায়ে নির্ধারিত সময়ের চাকুরি শেষে ভর্তি হন মনোরোগবিদ্যায় এম.ডি(রেসিডেন্সি) কোর্সে। বর্তমানে তিনি একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। বংশপরম্পরায় প্রাপ্ত শিক্ষকতার ধারা বজায় রেখে চিকিৎসক ও শিক্ষক হওয়াটাই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। বই, সঙ্গীত আর লেখালেখিতেই কাটে অবসর সময়ের বেশির ভাগ। স্বপ্ন দেখেন - মেধা ও মননশীলতার চর্চায় অগ্রগামী একটা বাংলাদেশের।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here