সব বাবা-মার কাছেই নিজের সন্তান সবচেয়ে ভাল, সব চেয়ে সুন্দর, সবার সেরা। তাই একটি গল্প মনে করি, “একবার এক স্কুলে বেস্ট স্টুডেন্ট প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হল। যেন সুষ্ঠু বিচার হয় তাই স্কুলের প্রিন্সিপাল সব মা-কেই বিচারের ভার দিলেন। তিনি সব মায়ের হাতেই একটি করে জয়ের মালা দিয়ে বললেন, “আপনার চোখে যে শিশুটি সেরা তাকেই পরিয়ে দিন এবং অবশ্যই আপনার বিচার যেন সুষ্ঠু হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন”। দিন শেষে দেখা গেল সব মায়েরাই নিজ নিজ সন্তানকে বিজয়ের মালা পরিয়ে দিয়েছেন।”
সত্যিকার অর্থেই বাবা-মার কাছে নিজ সন্তান সেরা। কেননা সন্তান আমাদের চোখের মনি। বুকের মানিক। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে যখন সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরি তখন পৃথিবীটাই অন্য রকম হয়ে যায়। একজন সু-সন্তান যেমন আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। তেমনি আমরা যখন কোন মানুষের অপকর্মের ঘটনা শুনি প্রথমেই বলি এদের বাবা-মা কেমন? ওদের বাবা-মার শিক্ষা কেমন? কিন্তু আমি নিজে যখন বাবা-মা তখন আমি কতটা সচেতন! অনেকেই গর্ব করে বলি, “আমার সন্তানের কোনো চাওয়াই আমি অপূর্ণ রাখিনা। যা চায়, যেভাবে চায়, যত টাকাই লাগুক ওর খুশির জন্য সব করি”।
কিন্তু আসলে এই খুশির লাগাম টানা যে দরকার তা কি আমরা বুঝি? আমরা কোনো বাবা-মাই সন্তানকে অহংকার করা শিখাই না কিন্তু যখন বলি “অমুক নামীদামী ব্রান্ড ছাড়া আমি কাপড় পরিনা” চলুন জিজ্ঞেস করি তো একবার, ‘বাবা আমার এই আচরণ থেকে তুমি কি শিখলে? আমি যখন আত্মিয় বা প্রতিবেশীর সুখবর শুনে মুখ বাঁকা করি তখন কি বলে দিতে হয় যে, “বাবা এখন থেকে এভাবেই হিংসা করবে”! আমরা নিজের ভুল মানতে নারাজ হব নাকি নিজেকে শুধরে নিবো! একটু ভেবে দেখি!
সন্তান জন্মদান করা মানেই বাবা-মা হয়ে যাওয়া নয়। আমার সন্তানের সঠিক আচরণ করতে শেখানো আমার দায়িত্বের অংশ। এটি সময় এবং ধৈর্যের ব্যাপার। তবে কার্যকর ও স্বাস্থ্যকর শৃঙ্খলা কৌশলগুলো শিখতে আমাদের “গুড প্যারেন্টিং স্কিল’ প্রশিক্ষণ দরকার হতে পারে।
আমেরিকান একাডেমি অফ পেডিয়াট্রিক্স (এএপি) থেকে আপনার সন্তানের বড় হওয়ার সাথে সাথে গ্রহণযোগ্য আচরণ শিখতে সহায়তা করার সেরা উপায়গুলি দেয়া হল।
এএপি ইতিবাচক শৃঙ্খলার ১০ টি কৌশল প্রস্তাব দেয় যা কার্যকরভাবে শিশুদের তাদের আচরণ পরিচালনা করতে এবং স্বাস্থ্যকর বিকাশের জন্য তাদের ক্ষতিকর আচরণ থেকে দূরে রাখতে শেখায়। এর মধ্যে রয়েছে:
১। মডেলিং: আমার সন্তান আমারই প্রতিচ্ছবি। তাই আমি যা করি ওরা দেখে এবং যা বলি শুনে অনুকরণ করে শেখে। যদি শান্ত থাকি, কথা বলার সময় শব্দচয়ন এবং নিজের কাজগুলোর বাপারে সচেতন হই। কেননা মডেলিং এর মাধ্যমে আমার আচরণগুলো আমার বাচ্চাদের মধ্যে দেখতে পাই।
২। সীমা নির্ধারণ: আমার বাচ্চারা স্পষ্ট এবং ধারাবাহিক নিয়ম অনুসরণ করছে কিনা এবং এই নিয়মগুলো বয়স-উপযুক্ত কিনা যা তারা বুঝতে পারে তা ব্যাখ্যা করার বিষয়ে নিশ্চিত হই। কিছু অলিখিত নিয়ম সেট করি।
৩। পরিণতি: তারা নির্ধারিত আচরণ না করলে শান্ত এবং দৃঢ়তার সাথে পরিণতি ব্যাখ্যা করি। উদাহরণস্বরূপ, তাকে বলতে পারি যে, “তুমি যদি খেলনা না তুলে রাখো তবে আমি সেগুলো সারা দিন অন্য জায়গায় রেখে দিবো”। তবে এরকম বলে যদি তার কান্না দেখে আবার কয়েক মিনিট পরে ফিরিয়ে দেই, তবে সেটা কার্যকর হবেনা। মনে রাখতে হবে যে বাচ্চার সত্যিকারের প্রয়োজন এমন কোন জিনিস যেমন, খাবার কখনোই সরাবো না ।
৪। শোনা: শোনা গুরুত্বপূর্ণ। শিশুর সমস্যা সমাধানে সহায়তা করার আগে তার গল্পটি শেষ করতে দেই। শিশু যদি কারো প্রতি ঈর্ষা বোধ করে তাহলে উপদেশ না দিয়ে বিষয়টি নিয়ে তার সাথে সময় দিয়ে কথা বলি।
৫। মনোযোগ দেই: কার্যকর অনুশাসনের সবচেয়ে শক্তিশালী উপায় হল মনোযোগ। শিশুর ভাল আচরণগুলোকে প্রশংসা দিয়ে শক্তিশালী করি এবং অন্য নেতিবাচক আচরণ নিরুৎসাহিত করি। মনে রাখি, সমস্ত শিশু তাদের বাবা-মার মনোযোগ চায়।
৬। ভাল কাজে প্রশংসা: বাচ্চাদের কখন খারাপ কিছু করা উচিত এবং কখন তারা ভাল কিছু করে তা জানতে হবে। সাফল্য, ভাল চেষ্টা এবং ভাল আচরণ লক্ষ্য করে প্রশংসা করি। সুনির্দিষ্ট আচরণে সুনির্দিষ্ট প্রতিক্রিয়া দেই। যেমন, “বাহ, তুমি খেলনাগুলো গুছিয়ে রেখে একটি ভাল কাজ করেছ!”, “তুমিতো গুড বয়/গার্ল তাই মা-র কথা মন দিয়ে শুনেছো” ইত্যাদি।
৭। কখন প্রতিক্রিয়া জানাবো: সারাক্ষণ শিশুকে “এটা করো না”, “ওটা “করো না” না বলি। যতক্ষণ শিশু বিপজ্জনক কিছু না করে ততক্ষণ তার দিকে অতি মনোযোগ না দেই। খারাপ আচরণ উপেক্ষা করা এটি বন্ধ করার কার্যকর উপায় হতে পারে। খারাপ আচরণ না করার উপদেশ না দিয়ে বরং বাচ্চাদের তাদের কাজের ক্ষতিকর পরিণতি সম্পর্কে গল্পাকারে বুঝিয়ে বলি। উদাহরণস্বরূপ, যদি আমার সন্তান খাবার নস্ট করে তাহলে তাকে বুঝিয়ে বলি “এভাবে নস্ট করলে সব খাবার শেষ হয়ে যাবে তখন ক্ষুধা লাগলে আমরা কি খাবো?” যদি সে তার খেলনা ছূড়ে মারে, অন্যান্য শিশুদেরকে আঘাত করে, অনেক সময় শিশুরা থুতু ছিটিয়ে মজা পায়। এরকম করলে তাকে বুঝিয়ে বলি যে, “তুমি আঘাত করলে ওরা ব্যাথা পায়, থুতু দিলে মন খারাপ করে আর এরকম করলে ওরা আর তোমার সাথে খেলবে না, তুমি তখন কার সাথে খেলবে? খেলনা ভেঙে গেলে কি দিয়ে খেলবে?”
৮। ঝামেলার জন্য প্রস্তুত থাকি: আমার সন্তানের আচরণ করতে সমস্যা হতে পারে এমন পরিস্থিতির পরিকল্পনা আগেই করি। আসন্ন ক্রিয়াকলাপ এবং আমি কীভাবে তাদের আচরণ দেখতে চাই সেগুলোর জন্য তাদের প্রস্তুত করি।
৯। খারাপ আচরণ পুনঃনির্দেশ করি: এই লকডাউনে ঘর বন্দি থাকায় কখনো কখনো বাচ্চারা বিরক্ত হওয়ার কারণে খারাপ আচরণ করে যেমন, চিৎকার, চেঁচামেচি, লেখাপড়ায় অনীহা ইত্যাদি। তারা হয়ত এর চেয়ে ভাল কিছু এই মুহুর্তে জানে না। সন্তানের আরও কিছু করার উপায়গুলো দেখিয়ে দেই, তাদের বিভিন্নরকম সৃজনশীল কাজ, ঘরের কাজকে উৎসাহিত করি।
১০। টাইম আউট: নির্দিষ্ট নিয়ম ভাঙলে একটি সময়সীমা/টাইম আউট দেয়া যেতে পারে। শিশুদের সতর্ক করার মাধ্যমে সবচেয়ে ভাল কাজ করে যে তারা যদি শৃঙ্খলা ভাঙে তবে তাদের ১ মিনিট ধরে প্রিয় কাজ থেকে দূরে রাখি। মনে রাখতে হবে এটি শাস্তি নয় এবং “টাইম আউট”-এর জন্য শিশুর বয়স কমপক্ষে ৩ বছর হতে হবে। এই কৌশলটি শিশুকে স্ব-পরিচালনার দক্ষতা শিখতে এবং অনুশীলন করতে সহায়তা করে। এটি বড় শিশু এবং কিশোরদের জন্য ভাল কাজ করে।
শাস্তি: এএপি নীতি বলে যে, “স্বাস্থ্যকর বাচ্চার জন্য দরকার কার্যকর শৃঙ্খলা”। খারাপ আচরণের শাস্তি দেওয়ার পরিবর্তে ভাল আচরণের শিক্ষায় মনোনিবেশ করা জরুরি। গবেষণা দেখা যায় যে ঝাঁকুনি দেয়া, চড় মারা এবং অন্যান্য শারীরিক শাস্তি শিশুর আচরণ সংশোধন করতে ভাল কাজ করে না। শিশুর সাথে চিৎকার করা বা লজ্জা দেওয়ার ক্ষেত্রেও তাই। কঠোর শারীরিক ও মৌখিক শাস্তি বরং শিশুর দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করতে পারে।
এএপি পরামর্শ দেয় যে বাবা-মা এবং যত্নশীলদের বাচ্চাদের ঝাঁকুনি বা আঘাত করা উচিত নয়। কারণ শাস্তি দায়িত্ব ও আত্ম-নিয়ন্ত্রণ শেখানোর পরিবর্তে, প্রায়ই বাচ্চাদের মধ্যে আগ্রাসন এবং ক্রোধ বাড়িয়ে তোলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২০ টি বড় শহরে জন্ম নেওয়া শিশুদের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, যে পরিবারগুলি যে শারীরিক শাস্তি ব্যবহার করেছিল তারা নেতিবাচক চক্রের মধ্যে পড়েছিল।
১। স্প্যাংকিং: স্প্যাংকিং বা ঝাঁকুনির প্রভাবগুলি পিতামাতার এবং সন্তানের সম্পর্কের বাইরেও ক্ষতিকর হতে পারে। কারণ তারা শিখেছে যে মন খারাপের সময় বাবা-মার কাছ থেকে আরও শারিরীক ও মানসিক আঘাত আসতে পারে। এসব শিশুরা যখন যা চায় তা না পেলে অন্যকে আঘাত করার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
২। শারীরিক শাস্তি: এটি আঘাতের ঝুঁকি বাড়ায়, বিশেষত ১৮ মাস বয়সের শিশুদের মধ্যে মস্তিষ্ক এবং শরীরে অন্যান্য সমস্যা হতে পারে। উচ্চ স্তরের টক্সিন হরমোন বিষাক্ত চাপ তৈরি করে। শারীরিক শাস্তি মস্তিষ্কের বিকাশকে প্রভাবিত করে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে বার্ধক্যজনিত অল্প বয়স্কদের মধ্যে গ্রে-ম্যাটার/ ধূসর পদার্থ কম ছিল, মস্তিষ্কের অংশটি স্ব-নিয়ন্ত্রণে জড়িত ছিল এবং নিয়ন্ত্রণ গ্রুপের চেয়ে তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের মতো আইকিউ পরীক্ষায় কম সম্পাদিত হয়েছিল।
৩। মৌখিক অপব্যবহার: শিশুদের সাথে চিৎকার করা, লজ্জা দেয়া, বুলি করা, অভিশাপ দেয়া, বাজে শব্দ ব্যবহার করে কথা বলা যেমন, “তুই মরলে আমি বাঁচি” অত্যন্ত ক্ষতিকারক বলে প্রমাণিত হয়েছে। গবেষণা দেখায় যে কঠোর মৌখিক শৃঙ্খলা বা দূর্ব্যবহার শিশুদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ হতে পারে। কিশোর বয়সে আচরণের সমস্যা এবং হতাশার লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
ভুল থেকে শিখি
পিতামাতা হিসাবে, নিজেকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে বোধ করলে নিজেকে সময় দিতে হবে। বাচ্চা কোনও নিরাপদ স্থানে রয়েছে তা নিশ্চিত হই এবং তারপরে নিজেকে শান্ত রাখতে কয়েকটি গভীর শ্বাস নেই। স্ট্রেস কমাতে বন্ধুকে কল করে কয়েক মিনিট কথা বলে হাল্কা হয়ে নিতে পারি। যখন ভাল বোধ করি তখন সন্তানের কাছে ফিরে যাই, জড়িয়ে ধরি এবং আবার নতুন করে শুরু করি। যদি প্রথমবার কোনো পরিস্থিতি ভালভাবে পরিচালনা না করতে পারি তবে এটি নিয়ে উদ্বিগ্ন না হই। আলাদাভাবে কী করতে পারি তা ভেবে দেখি এবং পরের বার তা করার চেষ্টা করি। যদি মনে হয় যে এই মুহুর্তে রেগে গিয়ে আমি সত্যিকার ভুল করেছি তাহলে নিজেকে ঠান্ডা হওয়ার জন্য অপেক্ষা করি, প্রয়োজনে সন্তানের কাছে দুঃখ প্রকাশ করি এবং ভবিষ্যতে কীভাবে পরিস্থিতি পরিচালনা করবো তা ব্যাখ্যা করি। প্রতিশ্রুতি পালন করতে না ভুলি। এটি বাচ্চার জন্য কীভাবে ভুল শুধরে নিতে হবে তার একটি ভাল মডেল হতে পারে। সন্তানের কোন আচরণে উদ্বিগ্ন হলে ধৈর্য্য রেখে পূনরায় প্রথম থেকে শুরু করি।
জীবনের উদ্দেশ্য শুধু অর্থ উপার্জন আর তার জন্য খুব বেশী শিক্ষা কিম্না জ্ঞ্যন দরকার হয় না এমনটা একজন শিশু তার চারপাশের পরিবেশ থেকেই শেখে। দয়া, ক্ষমাশীলতা, সহমর্মিতা, অন্যের বিপদে সাহায্য করা তথা সত্যের আলো তার আচরণে আছে কিনা খেয়াল করি। আমার সন্তানকে সামাজিক মূল্যবোধ, ন্যায় অন্যায় বোধ তথা নৈতিক শিক্ষা দেবার দায়িত্ব আমারই। একজন থেরাপিস্ট, মনোবিজ্ঞানী কিম্বা মনোচিকিৎসকের কাছে হয়ত সমস্যায় পরলে আমি পরামর্শের জন্য যাবো কিন্তু আমার সন্তান খারাপ কাজের জন্য খবরের কাগজের শিরোনাম হলে আমার মত কষ্ট আর কারো হবে বৈকি! ভেবে দেখি!
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে