যুগ যুগ ধরে স্বপ্ন নিয়ে মানুষের কৌতুহলের শেষ নেই। আমরা কেন স্বপ্ন দেখি? কিভাবে চলে স্বপ্নের প্রক্রিয়া? স্বপ্ন কি আমাদের কোনো শুভ-অশুভ ঘটনা ঘটার ইঙ্গিত দেয়? সত্যিই কি মানুষ স্বপ্নের মাধ্যমে কিছু আবিস্কার বা সমস্যা সমাধানের পথ পায়? আমরা ঘুমের কোন পর্যায়ে স্বপ্ন দেখি? স্বপ্নের মাধ্যমে কি আমরা ভবিষ্যতে কিছু ঘটবে এমন ইঙ্গিত পাই? ইত্যাদি নানা প্রশ্ন মনে বয়ে চলে। যদিও স্বপ্নের অনেক বিষয় এখনও অজানা তথাপি আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের স্বপ্ন সম্পর্কে অনেক তথ্য দিয়েছেন যার ফলে আমরা স্বপ্ন সর্ম্পকে অনেক কিছু জানতে পারি।
ঘুমের সময় আমরা যে স্বপ্ন দেখি তা কতগুলো চিত্র, ধারণা, আবেগ এবং সংবেদনের সমষ্টি। সর্বনিম্ন সামান্য সেকেন্ড থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ২০ মিনিটের মতো স্থায়ী থাকে। একজন মানুষ প্রতিরাতে গড়ে ৩-৫ টি স্বপ্ন দেখে থাকে। স্বপ্ন সাধারণত কোনো ঘটনার বর্ণনা বা কাহিনীর আকারে আমরা দেখে থাকি। প্রায়ই স্বপ্নের সাথে আমাদের জীবনের একটা অর্থবহ সম্পর্ক পাওয়া যায়। স্বপ্নের বিষয়বস্তু সাধারণত কোনো ঘটনা থেকে শুরু করে যৌক্তিক, অবাস্তব, অদ্ভূত, নেতিবাচক বা আনন্দহীন ঘটনা হয়ে থাকে। আমাদের সেই স্বপ্নের কথাই বেশি মনে থাকে যা ভয়ানক, অদ্ভূত, আনন্দহীন বা যা ভীতির সৃষ্টি করে । যদিও ৭৫% স্বপ্নই নেতিবাচক ধরনের হয়ে থাকে তথাপি খুব বেশি দুঃস্বপ্ন মানুষ কমই দেখে। স্বপ্নের প্রধান চরিত্রে সব সময় ব্যক্তি নিজেই থাকে। বেশির ভাগ মানুষ রঙ্গীন স্বপ্ন দেখে তবে কিছু মানুষ সাদা-কালো স্বপ্ন দেখে বিশেষ করে যারা সাদা-কালো টেলিভিশন দেখতেন এখন থেকে ৫০ বৎসর আগে।
আমরা ঠিক কখন স্বপ্ন দেখি এ প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে ঘুমের প্রতিটি ধাপেই স্বপ্ন দেখে থাকি। তবে দ্রুত চক্ষু সঞ্চালন পর্যায়েই স্বপ্ন দেখার বিষয়টি বেশি ঘটে থাকে। অথার্ৎ ঘুমের শেষের দিকেই স্বপ্নের বিষয়টি বেশি ঘটে। অনেকে বলে থাকে আমি কোনো দিন স্বপ্ন দেখিনা, আসলে এ কথাটি সঠিক নয়। প্রত্যেকে প্রতি রাতেই স্বপ্ন দেখে। অতি শৈশব থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ স্বপ্ন দেখে থাকে । সেই স্বপ্ন সে মনে করতে পারুক আর নাই বা পারুক। স্বপ্নের স্মৃতির পরিধি খুবই কম। ঘুম থেকে জেগে উঠার সামান্য সময়ের মধ্যেই তা ভুলে যায় যদি না তা আমরা খুব জোর দিয়ে তা মনে করতে চাই বা লিখে না রাখি।
যাদের ঘুম সহজেই ভেঙ্গে যায় তারা স্বপ্নের বিষয় গুলো সহজে মনে করতে পারে। কিন্তু যাদের ঘুম গভীর তারা কম মনে করতে পারে। কিছু মানুষ কখনই স্বপ্ন মনে করতে পারে না। অল্প বয়সী শিশুরা অবশ্যই স্বপ্ন দেখে যদিও ৭ বৎসর বয়সী শিশুদের মধ্যে মাত্র ২০% শিশু দ্রুত চক্ষু সঞ্চালন পর্যায় থেকে জেগে উঠার পর স্বপ্ন দেখেছে এটা বলতে পারে। আর অল্প বয়সী শিশুদের প্রাপ্ত বয়স্কদের চেয়ে ঘুমের দ্রুত চক্ষু সঞ্চালন পর্যায়ে বেশি সময় থাকলেও তারা স্বপ্নের বিষয়গুলো মনে করতে পারেনা।
প্রথম দিকে শিশুরা স্বপ্নের ক্ষেত্রে প্রধান চরিত্রে না থাকলেও ৭ বৎসর বয়স থেকে তা পরিবর্তন হতে থাকে। অন্ধ মানুষেরাও স্বপ্ন দেখে আর যদি কেউ জন্ম থেকে অন্ধ হয় কোনো দিন এই পৃথিবীকে দেখতে পায়নি তারা শব্দ, চর্ম সংবেদন, ঘ্রাণ এসব নিয়ে স্বপ্ন দেখে।
স্বপ্ন নিয়ে মনোবিজ্ঞানীদের বিভিন্ন তত্ত্ব
দি অ্যাক্টিভেশন সিনথেসিস মডেল (The Activation Synthisis Model): জে অ্যালোন হবসন এবং রবাট ম্যাকক্ল্যারলি ((J. Allan Hobson and Rolant Mcclarly 1970) এনারা বলেন দ্রুত চক্ষু সঞ্চালন পর্যায়ে মস্তিষ্কেরে সার্কিট গুলো সক্রিয় হয়ে উঠে অথার্ৎ মস্তিষ্কের এ্যামিগডালা, লিমবিক সিস্টেম এবং হিপোক্যাস্পাস যা আমাদের আবেগ সংবেদন এবং স্মৃতির সাথে জড়িত সেগুলো সক্রিয় হয়ে উঠে। এ সময় মস্তিষ্ক তার আভ্যন্তরীণ কাজের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন ধারণা বিশ্বাস, কাজের ধরন ইত্যাদির একটি ব্যাখ্যা প্রদান করে এবং মস্তিষ্কে স্বত:স্ফূর্তভাবে যে সংকেত গুলো আসতে থাকে তার একটি অর্থ খোঁজার চেষ্টা করে যাকে আমরা স্বপ্ন বলি।
লং-টার্ম মেমরি এক্সাইটেশন থিওরি ((Long-term memory excitation theory) এই তত্ত্বের প্রবক্তা ইউগেন টারনাউ (Eugen Tarnow 2003) তিনি বলেন স্বপ্ন আমাদের দীর্ঘ মেয়াদী স্মৃতির একটি আভ্যন্তরীণ উত্তেজনাপূর্ণ বিষয়। এই তত্ত্ব বিশ্বাস করে যে আমাদের চলমান জীবনে সব সময় এটা হচ্ছে এমনকি আমরা যখন জেগে থাকি তখনও চলে। কিন্তু সব ধরনের বিষয়াবলীকে গুরুত্ব না দিয়ে যা আমাদের বাস্তবতার সাথে সম্পর্কিত সেগুলোকে রেখে অপ্রয়োজনীয় তথ্যাবলীকে বাদ দিয়ে দেয়। বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েডের মনোসমীক্ষণ মতবাদেও বলা হয় যে আমাদের অবচেতন মনের ঘটনাবলী দীর্ঘ মেয়াদী স্মৃতি ভান্ডারে জমা হয় যা পরবর্তীতে স্বপ্নের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
কন্টিনিউয়াল- অ্যাক্টিভেশন থিওরি অফ ড্রিম (Continual activation theory of dream in 2004) এই তত্ত্বটি জি জেহ্যাং (Jie Zhang 2004) প্রবর্তন করেন। স্বপ্নের সময় মস্তিষ্কের ওয়াকিং মেমরী দৃঢ়ভাবে কাজ করে দীর্ঘ মেয়াদী স্মৃতির ভান্ডার সমৃদ্ধ করে। তিনি বিশ্বাস করেন যে আমাদের মস্তিষ্কের কার্যাবলী সক্রিয় রাখার জন্য আমাদের সচেতন এবং অবচেতন স্তরের কার্যাবলীও সচল রাখা প্রয়োজন হয় এবং এ সফল কার্যাবলীর মাধ্যমে স্মৃতির ভান্ডার সংরক্ষণ হয়। স্বপ্ন এক্ষেত্রে সাহায্য করে। নিউরোট্রাসমিটার ডোপামিন স্বপ্নের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে। দ্রুত চক্ষু সঞ্চালন পর্যায়েই স্বপ্নের প্রকাশ ঘটে। এছাড়া মস্তিষ্কের পেরিটাল লোব স্বপ্নের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। স্ট্রোক এর ফলে তা নষ্ট হয়ে গেলে মানুষ আর স্বপ্ন দেখে না। স্বপ্নের উদ্দেশ্য বা কার্যক্রম সর্ম্পকে এখন পর্যন্ত সম্পূর্ণভাবে জানা যায়নি কেন আমরা স্বপ্নের মধ্যে থাকি এই ধরনের অনেক প্রশ্নের উত্তর আচরণ বিজ্ঞানের কাছে এখনও অজানা।
শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য দ্রুত চক্ষু সঞ্চালন পর্যায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর আমরা এই পর্যায়েই তো স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন আমাদের আবেগীয় সমস্যার সমাধান এবং মনকে ভাল রাখতে সাহায্য করে। জাগ্রত অবস্থায় আমাদের মস্তিষ্ক নানা বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকে যার ফলে অনেক ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে পারে না। কিন্তু মানুষ যখন ঘুমন্ত অবস্থায় থাকে তখন দ্রুত শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার পরিবর্তনের ফলে নানা ধরনের জটিল ঘটনাবলীর ব্যাখ্যা দিতে পারে। যা স্বপ্নের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। যেমন: স্বপ্নে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনা বাস্তব জীবনে ঘটে যায়। তাই অনেকে বলতে চান স্বপ্নের একটি ভবিষ্যত সর্ম্পকে র্পূবোক্তি করার ক্ষমতা আছে যার ফলে স্বপ্নের মাধ্যমে মানুষ ভবিষ্যতে কোন ঘটনা ঘটবে এমন ধরনের ইঙ্গিত পায়। যেমন: কেউ হয়তো স্বপ্ন দেখলো তার ভাই এর হাতে সমস্যা হয়েছে। সে এই কারণে অসহায় বোধ করছে। কিছু দিন পর সত্যিই দেখা গেল তার ভাইয়ের হাত ছিনতাইকারীর দ্বারা জখম হয়েছে। দৈনন্দিন জীবনে একজন হয়ত দ্বন্ধে ভুগছে চাকুরীটা ছেড়ে দিবে নাকি রাখবে। সেই রাতে সে স্বপ্নে দেখল যে তার চলার পথে অনেক পানি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সে বিপদের সম্মুখীন। স্বপ্নের অর্থ বুঝতে রোশাক-কালির চাপ পরীক্ষার কথা স্মরণ করতে পারি। এই পরীক্ষায় দেখা যায় যে আপাত দৃষ্টিতে অর্থহীন একটি ছবিকে ভালভাবে খেয়াল করলে সেটি একটি অর্থবোধক ছবি হয়ে যায়। এছাড়া অনেক বিখ্যাত জিনিসের আবিস্কারকগণ দাবী করেন যে তারা এটা স্বপ্নের মাধ্যমে পেয়েছেন।
তাই স্বপ্নকে আর অবহেলা নয়। স্বপ্নকে বিশ্লেষণ করুণ দেখুন তো স্বপ্ন আপনার কোনো দ্বন্ধের সমাধানে সাহায্য করছে কিনা? জীবনকে সুন্দরভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন আমাদেরকে আশাবাদী করে তোলে। সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে। তাই বেশি বেশি স্বপ্ন দেখতে ভুলবেন না কিন্তু।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।