সোশ্যাল মিডিয়া নার্সিসিজম বাড়াচ্ছে

ফেসবুক, ইন্সটাগ্রামসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দিকে যদি খেয়াল করেন আপনার অবশ্যই মনে হবে যে নার্সিসিজম্ বা আত্ম-প্রেমে ডুবে যাচ্ছে বিশ্বের সব দেশের মানুষ- অন্তত ডিজিটাল বিশ্বে এই প্রবণতা ক্রমেই বাড়ছে।

আর এটা কিন্তু মোটেই ভ্রান্ত কোন ধারণা নয়। মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে একমত যে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এই আত্ম-প্রেম এখন একটা বিরাট জায়গা করে নিয়েছে এবং আগের তুলনায় তা এখন খুবই প্রকট হয়ে উঠেছে।
আর এই প্রবণতা এমনভাবে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে এ নিয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লেখালেখি হচ্ছে প্রচুর। বাজারে নার্সিসিস্টদের এই মানসিক প্রবণতার বিশ্লেষণ করে বইও বের হয়েছে অনেক।
মোটের ওপর, এই আত্ম-প্রেমীদের খুঁজে বের করতে হলে আপনাকে অবশ্যই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেতে হবে- কারণ “সেলফি প্রজন্মের” বিচরণ ক্ষেত্র মূলত এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।
কিন্তু অতীতের তুলনায় এই আত্ম-প্রেমীদের সংখ্যা হঠাৎ করে এভাবে বেড়ে ওঠার পেছনে রহস্যটা কী? ‌ বিষয়ে গবেষণা করেছেন বিবিসির সাংবাদিক জলিয়ন জেনকিন্স।

নার্সিসিজম্ বা আত্ম-প্রেম আসলে কী?

সেটা বোঝার আগে দেখা যাক “আত্ম-প্রেমী” বলতে আমরা কাদের বোঝাই?
কলিন্স ইংরেজি অভিধান আত্ম-প্রেমকে ব্যাখ্যা করেছে এভাবে: “নিজের প্রতি অতিমাত্রায় ভালবাসা বা আগ্রহ – বিশেষ করে নিজের চেহারা দেখানোর ব্যাপারে।”
এটা হল আত্ম-প্রেমের মাত্রাতিরিক্ত বহি:প্রকাশ এবং সেটা প্রায়শই হয় কারো নিজের গুরুত্ব ও ক্ষমতাকে বাড়াবাড়ি রকমে জাহির করার প্রবণতা।
ব্যক্তি বিশেষের কিছু আচরণের সমষ্টিগত একধরনের বহি:প্রকাশ হল নার্সিসিজম্। এই আচরণ কমবেশি হয়ত আমাদের সবার মধ্যেই আছে।
কিন্তু সেটা যখন বাড়াবাড়ির পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছয়, তখন সেটাকে একটা মানসিক স্বাস্থ্যগত সমস্যা হিসাবে চিহ্ণিত করা হয়, যেটাকে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার (এনপিডি)।

একজন আত্ম-প্রেমীকে চিহ্ণিত করবেন কীভাবে?

ড: টেনিসন লী, যিনি ব্রিটেনে এনপিডি বিষয়ে একজন গবেষক ও বিশেষজ্ঞ, বলছেন এই মানসিক অসুস্থতা নির্ণয়ের নয়টি লক্ষ্মণ লিপিবদ্ধ রয়েছে বিশ্বে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের এই রোগ নির্ণয়ের নির্দেশিকা বইতে।
কাউকে আত্ম-প্রেম বা নার্সিসিজমের রোগী আখ্যা দিতে হলে তার মধ্যে নিচের লক্ষণগুলোর অন্তত পাঁচটি থাকতে হবে:

  • নিজের গুরুত্ব সম্বন্ধে তার অতি উচ্চ ধারণা
  • সাফল্য ও ক্ষমতা নিয়ে তার অলীক কল্পনা
  • নিজেকে বিশেষ কেউ এবং অতুলনীয় বলে বিশ্বাস
  • নিজেকে উচ্ছ্বসিত মাত্রায় প্রশংসা করার প্রবণতা
  • নিজের সম্পর্কে অধিকারবোধ
  • অন্যদের ব্যবহার করে নিজের স্বার্থ হাসিল করার প্রবণতা
  • অন্যদের অনুভূতির প্রতি অবজ্ঞার মনোভাব
  • অন্যদের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণতা
  • উদ্ধত আচরণ এবং নিজেকে বড়াই করার প্রবণতা

এধরনের কিছু কিছু প্রবণতা রয়েছে এমন মানুষকে আপনি নিশ্চয়ই চেনেন।
কিন্তু এটা রোগের পর্যায়ে কখন পৌঁছয় সেটা ব্যাখ্যা করেছেন ড: লী। “যখন এধরনের আচরণ একটা তীব্র মাত্রা নেয় এবং সেটা শুধু সেই ব্যক্তির জন্যই যে একটা মানসিক তাড়নার কারণ হয়ে দাঁড়ায় তা নয়, তার পরিচিতজনদের জন্যও সমস্যার কারণ হয়ে ওঠে, তখন এটাকে একটা মানসিক অসুস্থতা হিসাবে গণ্য করা হয়।”

এই সমস্যা আসলে কতটা ব্যাপক?

এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে আমেরিকার জনসংখ্যার শতকরা ছয় ভাগ আত্ম-প্রেমের এই চরম পর্যায়ে পড়ে। এই রোগ নির্ণয়ের নির্দেশিকা ব্যবহার করে এদের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে।
অন্যদিকে আবার আরও পাঁচটি গবেষণার ফলাফল বলছে বেশ কিছু মানুষের মধ্যে জরিপ চালিয়ে এবং রোগ নির্ণয়ের জন্য আরও কঠোর লক্ষ্মণ ব্যবহার করেও তারা কারো মধ্যে আত্ম-প্রেমের এই বাড়াবাড়ি খুঁজে পাননি।
কাজেই প্রশ্ন উঠতে পারে এনপিডিতে আক্রান্তের সংখ্যা খুবই বেশি অথবা এটা আদৌ কোন রোগ নয়।
অনেক মনোবিজ্ঞানী মনে করেন কোনো নির্দেশিকা ব্যবহার করে এটাকে রোগ হিসাবে চিহ্ণিত করা ঠিক নয়।
তবে ড: লী মনে করেন এটা যে একটা মানসিক অসুস্থতায় রূপ নিচ্ছে সেটা আমরা বুঝতে ব্যর্থ হচ্ছি। “আমি মনে করি ডাক্তাররা বিষয়টাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছেন না, ফলে এটা যে একটা রোগ তা যথেষ্টভাবে সামনে আসছে না।”
আনুষ্কা মার্চিনের স্বামীর মধ্যে এই আত্ম-প্রেমের প্রবণতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে যাবার পর তিনি স্বামীকে ছেড়ে যান। এখন তিনি একটি মনোরোগ বিষয়ে পরামর্শ কেন্দ্র চালান। তিনি অন্যদের পরামর্শ দেন আত্ম-প্রেম রোগের পর্যায়ে পৌঁছাচ্ছে কিন তা কীভাবে বোঝা যায়।
তিনি বলছেন, “নার্সিসিজম্ মহামারির মত বাড়ছে। প্রচুর মানুষ অবশ্যই এই প্রবণতায় আক্রান্ত।”

এনপিডির কি কোন চিকিৎসা আছে?

ড: লী বলছেন এনপিডি (নার্সিসিস্টিক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার) অর্থাৎ আত্ম-প্রেমের আচরণগত সমস্যা নিয়ে অনেক মানুষ তার দ্বারস্থ হয়েছেন যারা এসে বলেছেন তারা মানসিক অবসাদে ভুগছেন। কিন্তু এইধরনের মানসিক সমস্যায় অবসাদ কাটানোর ওষুধ কখনই কাজ করে না।
তিনি বলছেন, “এনপিডির চিকিৎসা খুব সহজ নয়।”
কারণ তিনি বলছেন এধরনের প্রবণতা আছে এমন মানুষ কখনই স্বীকার করতে চান না যে এটা কোন রোগ। তারা মনে করেন এটা তাদের কোন সমস্যা নয়- সমস্যাটা অন্যদের।
তাই তারা কোনরকম চিকিৎসার ব্যাপারে আগ্রহও দেখান না। তবে ড: লী বলছেন সুখের কথা একটাই যে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই প্রবণতাও নিজের থেকেই কমে যায়।
আমেরিকায় ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগ বিষয়ক অধ্যাপক ব্রেন্ট রবার্টস বলছেন, “বিশ্বের সর্বত্রই দেখা গেছে বয়স্ক মানুষ অল্পবয়সীদের তুলনায় কম আত্ম-প্রেমের প্রবণতায় ভোগেন।”
“বিভিন্ন দেশে চালানো জরিপের ফলাফল থেকে বারবার দেখা গেছে তরুণ বয়সে এই প্রবণতা যতটা বেশি থাকে বয়স বাড়ার সাথে সাথে তা যথেষ্ট মাত্রায় কমে যায়।”

সামজিক মাধ্যম ও আত্ম-প্রেম

ক্যালিফোর্নিয়ায় স্যান ডিয়েগো বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোরোগ অধ্যাপক জিন টোয়েংগ তার বই “দ্য নার্সিসিজম্ এপিডেমিক”-এ লিখেছেন আত্ম-প্রেমের চরম বহি:প্রকাশ যে দ্রুত বাড়ছে তার স্বপক্ষে জোরালো যুক্তি রয়েছে।
তার গবেষণা বলছে আমেরিকার কলেজ পড়ুয়ারা আগের তুলনায় অনেক বেশি আত্ম-প্রেমী হয়ে উঠেছে।
তিনি বলছেন ১৯৮২ থেকে ২০০৯-এ কলেজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে চালানো এক জরিপের সঙ্গে তুলনা করার জন্য একইধরনের প্রশ্ন করা হয়েছিল আজকের শিক্ষার্থীদের। তাতে দেখা গেছে আজকের শিক্ষার্থীরা নিজেদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে অতিরিক্ত আত্ম-প্রেমের পরিচয় দিয়েছে। তাতে অনেক বেশি বড়াই করার ব্যাপক প্রবণতা দেখা গেছে।
“এদের মধ্যে দেখা গেছে নিজেদের নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা জাহির করার ব্যাপক প্রবণতা, সামাজিক পর্যায়ে তারা খুবই ক্ষমতাবান বলে বড়াই করার এবং নিজেদের বুদ্ধির মাত্রা কত উঁচু তা জাহির করার একটা বিশাল প্রবণতা।”
ব্রিটেনের একজন সুপরিচিত আত্মপ্রেমী এইচ জি টিউডর বলেছেন তরুণ বয়সে তিনি খুবই নার্সিসিস্ট ছিলেন। মনে করতেন বিদ্যায় বুদ্ধিতে তাকে টপকে যাবার ক্ষমতা আরও কারো নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শেষ করার পর তার সেসময়কার এক বান্ধবী তাকে বলেন তার আত্ম-প্রেম রোগের পর্যায়ে পৌঁছেছে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞও বলেন তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ- এনপিডির শিকার।
এখন তিনি এই অবস্থা কটিয়ে উঠেছেন – বই লিখেছেন- অন্যদের পরামর্শও দিচ্ছেন।
তার এখন রমরমা ব্যবসা। বইএর কাটতি প্রচুর। তার কাছে পরামর্শ নিতেও আসে বহু মানুষ। যা প্রমাণ করে আত্ম-প্রেম এখন মানসিক ব্যাধির পর্যায়ে চলে গেছে এবং অনেকেই এই রোগে ভুগছেন।
“আমার বিশ্বাস সমাজ এখন মানুষকে আত্ম-প্রেমে উদ্বুদ্ধ করছে। সমাজ যেভাবে বদলেছে তাতে মানুষ এই প্রবণতাকে লালন করছে, এ নিয়ে রীতিমত চর্চ্চা করছে এবং নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে।”
বিশেষজ্ঞরা বলছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জনপ্রিয়তা ও বিস্তার এই প্রবণতাকে উস্কে দেওয়ার ক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা পালন করছে।
সূত্রঃ বিবিসি

Previous articleজলবায়ুর পরিবর্তন মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষেও ক্ষতিকর
Next articleঘুম নিয়ে যেসব প্রচলিত ধারণা আপনার স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here