সবার সঙ্গে মিশতে অনীহা, কথাবার্তায় আত্মবিশ্বাসের অভাব—আমি কী করব?
প্রতিদিনের চিঠি – আমাদের প্রতিদিনের জীবনে ঘটে নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা। যা প্রভাব ফেলে আমাদের মনে। সেসবের সমাধান নিয়ে মনের খবর এর বিশেষ আয়োজন ‘প্রতিদিনের চিঠি’ বিভাগ। এই বিভাগে প্রতিদিনই আসছে নানা প্রশ্ন। আপনিও লিখতে পারেন আমাদেরকে এই ইমেইলে monerkhaboronline@gmail.com। সেজন্য ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ।
প্রশ্ন- উত্তর পর্বে দেয়া উত্তরগুলো কেবলমাত্র প্রাথমিক দিকনির্দেশনা। সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের সাথে সরাসরি দেখা করে চিকিৎসা নিতে হবে।
প্রতিদিনের চিঠি
চিঠি
স্যার, আমি বেশ কিছুদিন ধরেই এক ধরনের সমস্যা অনুভব করছি নিজের ভেতরে। গতকাল আমার বয়স ২৫ পূর্ণ হলো। ঢাকার একটি কলেজে স্নাতকোত্তর করছি। আমি অবিবাহিত।
ইন্টারের পর থেকে একটি মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল, তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসতাম। কিন্তু অনার্সের ২য় বর্ষে এসে মেয়েটি আমাকে কিছু না জানিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করে নেয়। তারপর থেকে আমি কোনো সম্পর্কের মধ্যে যাইনি।
আমার সমস্যা হলো— সবসময় চুপচাপ থাকতে ভালো লাগে। কথা বলতে বা মানুষের সঙ্গে মিশতে চরম বিরক্ত লাগে। বিশেষ করে, মানুষের সঙ্গে কথা বলার প্রতি প্রচণ্ড অনীহা কাজ করে। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা না করলে বা খুব প্রয়োজন না হলে কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে না। অনেক সময় কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলেও উত্তর দিতে ইচ্ছে করে না।
কারও সঙ্গে কথা বললেও আমার স্বর খুব ক্ষীণ হয়ে যায়। গুছিয়ে, উচ্চস্বরে কথা বলতে পারি না। কথার মধ্যে জোর বা আত্মবিশ্বাস রাখতে পারি না। বন্ধুবান্ধব বা পরিচিত কেউ নিজে থেকে যোগাযোগ না করলে আমিও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে আগ্রহ বোধ করি না।
অন্যের অনুকরণ করতে পারি না। কেউ কিছু শিখিয়ে বা দেখিয়ে দিলেও তা আয়ত্তে আনতে পারি না। অনেক কিছু দেখি, কিন্তু কথা বলতে ইচ্ছে করে না।
কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে **সেলস এক্সিকিউটিভ** হিসেবে কাজ নিয়েছিলাম, কিন্তু উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কমান্ড ও নিয়ম অনুসরণ করতে পারিনি। ক্লায়েন্টদের সঙ্গে আন্তরিকভাবে কথা বলতে পারতাম না বলে চাকরিগুলো ছেড়ে দিয়েছি।
মোটকথা, মানুষের সান্নিধ্য এবং কথা বলার প্রতি চরম অনীহা ও বিরক্তি কাজ করে আমার মধ্যে। তবে আমি আগে থেকেই অনেক মেধাবী ছিলাম।
আমার এই সমস্যার জন্য আমি কী করতে পারি? কীভাবে পরিত্রাণ পেতে পারি?

উত্তর
প্রথমে তোমাকে ধন্যবাদ জানাই যে, তুমি বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছো এবং আমাদের কাছে উত্তর চেয়ে প্রশ্ন পাঠিয়েছো। তোমার এই সচেতনতা প্রশংসার যোগ্য কারণ বাংলাদেশে এখনো মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে মানুষ তেমন গুরুত্ব দিতে চায় না। অনেকেই মনে করে, এটি শুধুই মন খারাপ, যা আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। আবার কেউ কেউ ভাবে, এ বিষয়ে তার কিছু করার নেই বা এটি নিয়ে ভাবার প্রয়োজন নেই। আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যেও অনেকে আছেন, যারা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বললে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখান বা অবহেলা করেন।এই কারণেই দেখা যায়, অনেকেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে চান না বা নিতে পারেন না। তোমার সচেতনতার জন্য তোমাকে আবারও ধন্যবাদ।
দ্বিতীয়ত, তোমার যে সমস্যাটি রয়েছে, সেটি তুমি নিজেই বুঝতে পেরেছো। তুমি আগে স্বাভাবিক ছিলে, মেধাবী ছিলে এবং তোমার একটি দক্ষতা ছিল। কিন্তু কোনো একটি ঘটনার কারণে বা অন্য যেকোনো কারণেই হোক, তুমি সেই আত্মবিশ্বাস থেকে পিছিয়ে গিয়েছো। তবুও তুমি বিশ্বাস করো যে তোমার সেই দক্ষতা এখনো আছে। কিন্তু সমস্যা হলো, এখন তুমি তোমার কাজ ঠিকমতো করতে পারছো না বা মনোযোগ দিতে পারছো না। তোমার দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন সমস্যা ভর করেছে।
তবে, তুমি বিশ্বাস করো এবং আমরাও বিশ্বাস করি যে, তোমার মধ্যে যে দক্ষতা ছিল, সেটি এখনো রয়ে গেছে। এখন আমাদের দরকার সেই দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে তোমার জীবনকে সুন্দর করে তোলা। দেখো, মানুষের জীবনে কাঙ্ক্ষিত ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটবে, এটাই বাস্তবতা। যদি তুমি ভাবো, জীবন একটি সরলরেখার মতো হবে, যেখানে কোনো বাঁধা থাকবে না, কোনো সমস্যা আসবে না— তাহলে সেটি ভুল ধারণা। জীবনের পথচলায় বাধাবিপত্তি থাকবেই, কিন্তু আমাদের সেই পথ পেরিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।তুমি যে মানসিক অবস্থার মধ্যে আছো, সেটি বিষণ্নতা হতে পারে। আমি তোমাকে অনুরোধ করবো, দেরি না করে বিষণ্নতার যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণ করো। শুধু পরামর্শ নিলেই হবে না, সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ করা জরুরি।
চিকিৎসার ক্ষেত্রে তিনিটি গুরুত্বপূর্ন দিক আছে একটি হলো ফ্যমিলি সাপোর্ট যেটি হলে ভালো হয়। আর দুইটি হলো ঔষুধ ও সাইকোথেরাপি। তোমার ক্ষেত্রে ঔষধের পাশাপাশি কিছু মানসিক চিন্তার পরিবর্তনও প্রয়োজন হবে। একইসঙ্গে সঠিক চিকিৎসা নিলে তুমি ভালোভাবে সুস্থ হয়ে উঠতে পারবে।
অনেক সময় অর্থনৈতিক কারণে অনেকে চিকিৎসা নিতে চান না বা দেরি করেন। কিন্তু অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। সবকিছু সবাই পাবে না, এটাই স্বাভাবিক। তাই নিজের জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে। আমি তোমাকে অনুরোধ করবো, তোমার পরিবারের আর্থিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে যেখানেই হোক, চিকিৎসা গ্রহণ করো। এর মাধ্যমে তুমি তোমার দক্ষতাকে কাজে লাগাতে পারবে এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারবে। অবিলম্বে চিকিৎসা গ্রহণ শুরু করো। আপাতত তুমি Cap. Nodep 20 mg সেবন করতে পারো। তবে এটি তোমার চূড়ান্ত চিকিৎসা নয়, তাই দ্রুত একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নাও এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করো।
ইতি,
অধ্যাপক ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব
মনোরোগ, যৌন সমস্যা ও মাদকাসক্তি চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ।
মগবাজার রেইল গেইট।
অনলাইন: ০১৮৪৪৬১৮৪৮৪