একটা উদাহরণ দিয়ে বলি, নামিরার মা অন্য ঘর থেকে শুনতে পায় নামিরা বলছে, ডোরা, সাব্বাশ! আজ তুমি লক্ষ্মী করে খেয়েছো।
কথাটা কানে আসতেই নামিরার মা নামিরার ঘরে উঁকি দেয়। দেখে নামিরা তার পুতুলকে অতি যত্নে খাওয়াচ্ছে। নামিরার বয়স এখন চার বছর। মুচকি হাসে মাÑবয়স বাড়ার সাথে সাথে তার কল্পনার জগৎ বড়ো হচ্ছে। বড়ো হচ্ছে কল্পনাকে কাজে লাগিয়ে খেলার পরিসর।
কল্পনাশক্তি মেধাবিকাশের জন্য একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। একটু খেয়াল করলে বোঝা যায়, শিশু যা কল্পনা করে খেলছে, সেটা হয়ত সে আগে কাউকে করতে দেখেছে। সে সময়টাতে সে যেমন তার দৃষ্টিশক্তি, মনোযোগ, চিন্তাকে কাজে লাগিয়েছে; তেমনভাবেই পরবর্তীতে কল্পনার মাধ্যমে তার স্মৃতিশক্তি, সৃজনশীলতা, ভাবনাকে ব্যবহার করে কাজগুলো করছে।
যেহেতু কল্পনার কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। নেই কোনো গণ্ডি। কল্পনার জগতে তাই শিশু পৃথিবীকে তার নিজের ভাবনায় সাজাতে পারে, ভাবতে পারে। এতে করে ধীরে ধীরে তার চিন্তা, ধারণা, জ্ঞান, সৃজনশীলতা, স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পায়, সুগঠিত হয়। এক কথায় বিকশিত হয় তার প্রতিভা।
কল্পনাশক্তির সাথে যেহেতু মানসিক বিকাশ ওতপ্রোতভাবে জড়িত এর অভাবে শিশুর মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের অটিজমের আনুষঙ্গিক অনেক লক্ষণের সাথে এই কল্পনাশক্তি ব্যবহার করে না খেলার প্রবণতা লক্ষ করা যায়।
তাছাড়া কল্পনাক্ষমতা বিকাশ না হলে স্মৃতিশক্তি, মনোযোগ, সামাজিক বিকাশ, চিন্তাশক্তি, ধারণার বিকাশ ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যা পরবর্তীতে শিশুর আত্মবিশ্বাস, বন্ধুত্বের সম্পর্ক, সমস্যা সমাধানের যোগ্যতা, নতুন কিছু করার স্পৃহা কমিয়ে দেয়। এমনকি বিষণ্ণতাও হতে পারে।
কল্পনাশক্তি বিকাশের জন্য কোনো দামি খেলনার প্রয়োজন পড়ে না। বাসায় পড়ে থাকা কার্ড বোর্ড, খালি বাক্স যা দিয়ে পুতুলের ঘর বা গাড়ির গ্যারেজ বানানো যায়। তেমনি পুরোনো কোনো পুতুল, হাড়ি-পাতিল এমনকি সাদা কাগজ, রং-পেন্সিল হয়ে উঠতে পারে কল্পনাশক্তি বিকাশের উপকরণ, যা দিয়ে সে তার মনের জগতকে ফুটিয়ে তুলবে কাগজে।
তবে হ্যাঁ মোবাইল বা টিভি থেকে দূরে রাখা জরুরি। এসব গ্যাজেট থেকে শিশু শুধুই দেখে যায় বা শুনে যায় তার চিন্তা বা কল্পনার অবকাশ থাকে না। বাচ্চাকে একটু আলাদা সময় দিয়ে তার সেই কল্পনার ছোট্ট রান্নাঘরে হোক বা বাজার হোক পরিবারের সদস্যদের ঘুরে আসা জরুরি। এতে শিশু তার কাজে উৎসাহ পাবে। তবেই বিকশিত হবে তার কল্পনা। বিকশিত হবে বুদ্ধিদীপ্ত উজ্জ্বল সম্ভাবনা।
ওপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারছি কল্পনাশক্তি শিশু বিকাশে একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান। শিশুর মানসিক, সামাজিক, ভাষাগত, শারীরিক, সৃজনশীলতা বিকাশে কল্পনাশক্তি সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
শিশুরা যত বেশি কল্পনা করতে পারবে, ওদের মধ্যে ততবেশি আবিষ্কার-প্রবণতা জন্ম নেবে। কল্পনার তো কোনো সীমারেখা নেই, শিশু তাই নিজের মনের আনন্দে নিজের খুশি মতো কল্পনার সাগরে সাঁতার কাটতে পারে, তৈরি করে নিতে পারে নিজের ভাবনার জগৎ। এতে শিশুর সৃজনশীলতা বাড়ে, শিশু সৃষ্টিশীল হয়। শিশু তার কল্পনাশক্তি বিকাশের মাধ্যমে নিজেকে একজন মানবিক, পারিবারিক, বন্ধবৎসল, সামাজিক, সাংস্কৃতিকÑসর্বোপরি একজন পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারে।
শিশুর কল্পনাশক্তি বিকশিত করতে হলে শিশুকে উপযুক্ত পরিবেশ দিতে হবে। সে যেন একটি নিরাপদ, আরামদায়ক, দুশ্চিন্তামুক্ত, বাধাহীন পরিবেশ পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। দিনের বেশিরভাগ সময় শিশু যেখানে থাকেÑ বাসা, স্কুল, ডে কেয়ার, খেলার মাঠ এসব পরিবেশের ব্যাপারে আমাদের যত্নশীল হতে হবে।
খুব কম সংখ্যক শিশুই একটি মুক্ত প্রাকৃতিক পরিবেশে বাধাহীন চিত্তে বেড়ে উঠতে পারে, বিশেষ করে শহরবাসী শিশুরা এসব সুবিধা তেমন একটা পায় না। দেখা যায়, বিভিন্ন ডিভাইস নিয়ে তাদের সময় কেটে যায়। তারপরও কিছু সচেতন মা-বাবা এখন চেষ্টা করছেন শিশুদের মানসিক বিকাশের উপযুক্ত পরিবেশ দেবার জন্য।
আমরা কখনো ভেবে দেখেছি কেন শিশুরা তাদের বিকাশ-উপযোগী পরিবেশ পাচ্ছে না? এর পেছনে অনেকগুলো কারণের মধ্যে শহরকেন্দ্রিকতা, সামাজিক চাপ, চাকরিজীবনে মা-বাবার শিশুকে প্রয়োজনীয় সময় দিতে না পারা, প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনাকে মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দেয়া, শিশুকে নতুন কিছু করতে বা শিখতে উৎসাহ না দেয়া ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
এভাবে সব সময় যদি শিশুর কল্পনাশক্তি বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় তা সামগ্রিকভাবে একটি শিশুর গড়ে ওঠাকে ব্যাহত করে; শিশুর মানসিক, সামাজিক এবং শারীরিক বিকাশ হয় না; শিশুর সৃষ্টিশীলতা নষ্ট হয়ে যায়। শিশুর সৃজনশীলতা বিনষ্ট করার আরেকটি মাধ্যম হলো প্রযক্তি নির্ভরশীলতা।
হ্যাঁ এটা ঠিক যে প্রযুক্তিকে বাদ দিয়ে আমরা আমাদের জীবনকে আসলে ভাবতে পারি না; এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে শিশুদের জন্যও প্রযুক্তির ব্যবহার প্রয়োজন হয়। যেমন- কোভিডকালীন অনলাইন ক্লাস। কিন্তু আমাদের কোমলমতি ও কল্পনাবিলাসী শিশুরা যখন অতিরিক্ত মোবাইল, টিভি, ট্যাব ইত্যাদি ডিভাইসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে যায় তখন তারা তাদের কল্পনার জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কারণ বাচ্চারা এসব ডিভাইসে বিভিন্ন ভিডিও অথবা কার্টন শুধু দেখে যায়, এগুলো নিয়ে কিছু ভাবে না।
ওদের চিন্তাশক্তি স্থবির হয়ে যায়। তবে হ্যাঁ প্রয়োজন হলে অবশ্যই মা-বাবার তত্ত্বাবধানে সীমিতভাবে বাচ্চারা প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিত্য-নতুন তথ্য জানতে পারে। বর্তমান আর্থসামাজিক অবস্থায় আমাদের শিশুরা প্রবলভাবে প্রযুক্তি-আসক্ত, এটা থেকে বের হতে না পারলে আমাদের শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা খুব একটা আশাবাদী হতে পারব না।
তাই এই সমস্যা থেকে উত্তরণে আমাদের বেশ কিছু করণীয় রয়েছে। শিশুকে স্বাচ্ছন্দ্যে নিজের মনের আনন্দে খেলতে, দৌঁড়াতে, শিখতে দিন। শিশু প্রশ্ন করাকে বাধা দেবেন না বরং উৎসাহ দিয়ে তাকে নতুন নতুন জিনিস শিখতে আগ্রহী করে তুলুন।
শিশুকে কোয়ালিটি টাইম দিতে হবে, বই পড়তে, ছবি আঁকতে উৎসাহ দিন, প্রাকৃতিক পরিবেশে নিয়ে যান; কাদা-মাটি স্পর্শ করতে দিন। ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস না দিয়ে শিশুকে প্রচর গল্প বলুন, ছড়া-গান বলুন, দামি খেলনা না দিয়ে বাসায় যা আছে তা দিয়েই শিশুর সঙ্গে খেলাধুলা করুন।
যেসব খেলায় কল্পনার বিকাশ হয় যেমন লেগো, পাজল, ছবি আঁকা, লেখালেখি করাÑএগুলোকে উৎসাহিত করুন। শুধু পড়াশোনার মাঝে শিশুকে সীমাবদ্ধ রাখা ঠিক নয়, বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে উৎসাহ দিন, বড়োদের সম্মান করতে শিক্ষা দিন। শিশু কোনো ভুল করলে সমালোচনা না করে বুঝিয়ে বলুন, ভুলটা ঠিক করে দিন।
কিন্তু আমাদের শিশুদের ক্ষেত্রে দেখা যায় আমরা উল্টোটাই করি। এই ভুল থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা অত্যন্ত জরুরি। আমরা যদি আমাদের ভবিষ্যতের কাণ্ডারি আজকের শিশুদের কল্পনাশক্তিকে বিকশিত হতে দিই, তাদের একটি মুক্ত পরিবেশে আনন্দের সঙ্গে বড়ো হতে দিই, যে যেভাবে পারি ওদেরকে সময় দিই, প্রযুক্তির ব্যবহার থেকে ওদের দূরে রাখি, প্রযুক্তি ব্যবহারের নির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করিÑতাহলেই তাদের জন্য একটি সর্বাঙ্গীন সুন্দর ভবিষ্যৎ উপহার দিতে পারব।
ডা. সামিনা হক
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ।
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে