ডা. মাহবুবা রহমান
এমবিবিএস, এমডি (চাইল্ড এন্ড অ্যাডোলেসেন্ট সাইকিয়াটি) রেজিস্ট্রার, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ,
মেডিক্যাল কলেজ ফর উইমেন এন্ড হসপিটাল, ঢাকা।
সন্তানকে শেয়ার করার মনোভাব শেখানোঃ
শিশুকে পরার্থপরতা শেখানোর ক্ষেত্রে প্রথম ধাপ হতে পারে নিজের যেকোনো জিনিস অন্যের সাথে শেয়ার করা শেখানো, এবং এই শিক্ষাটা শুরু হতে পারে নিজের ঘর থেকেই। শিশুর যদি অন্য কোনো ভাই-বোন থাকে তবে তার সাথে নিজের বাবার, খেলনা, বই ইত্যাদি শেয়ার করার ব্যাপারে উৎসাহ দিতে হবে ধীরে ধীরে পরিবারের অন্যান্য সদস্য, আত্মীয় এবং স্কুলের বন্ধুবান্ধবদের সাথেও শেয়ার করার ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলতে হবে শিশু যদি শেয়ার করে সেক্ষেত্রে তার এই আচরনের বেশি বেশি প্রশংসা করতে হবে যাতে করে পরবর্তীতেও শিশুর শেয়ার করার এই ধারা বজায় থাকে।
পরার্থপরতা নিয়ে নির্মিত বিভিন্ন শিক্ষামূলক বিনোদনের সাথে পরিচয় করানোঃ
শিশুদের একটি সহজাত স্বভাব হচ্ছে বাস্তবতার চেয়ে কাল্পনিক গল্প বা চরিত্র দিয়ে বেশি প্রভাবিত হওয়া। তাই পরার্থপরতা শেখানোর একটি ভাল মাধ্যম হতে পারে শিশুদের জন্য নির্মিত বিভিন্ন বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান, যেমন বিভিন্ন কার্টুন বা সিসিমপুরের মত টেলিভিশন সিরিজ। পাশাপাশি এই বিষয়ের উপর লেখা গল্পের বই কিংবা ধর্মগ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত উক্তি ও বিভিন্ন মনীষীদের জীবনীও তাদেরকে শোনানো যেতে পারে নিয়মিত এই বিষয়ের সাথে পরিচিতি ঘটলে একসময় শিশু নিজের অজান্তেই পরার্থপরতাকে তার দৈনন্দিন চর্চার অন্তর্ভুক্ত করে ফেলবে।
বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী দল, সংগঠন ও কাজে অংশ নিতে উৎসাহ প্রদানঃ
প্রায় প্রতিটি স্কুলেই বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবক দল বা ক্লাব থাকে, যেমন স্কাউট টিম। এসব দলের সাথে ছোটবেলা থেকেই শিশুর সংশ্লিষ্টতা রাখতে হবে। পরবর্তীতে অনেকসময় শিশুদের সুযোগ আসে এসকল দলের মাধ্যমে স্কুলে বা নিজ এলাকায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে বিভিন্ন কাজে অংশ নেয়ার, বিশেষত কোনো দেশের দূর্যোগের মূহুর্তে বা সংকটপূর্ণ অবস্থায়। সেসময় এসকল কাজে অংশ নিতে শিশুকে বেশি বেশি উৎসাহ দিতে হবে। শিশুকে সমাজে একজন স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা ও গুরুত্ব বোঝাতে হবে এবং শিশু যদি স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা পালন করতে আগ্রহ দেখায়, সেক্ষেত্রে তার প্রচেষ্টার প্রশংসা করতে হবে।
শিশুকে তার দ্বায়িত্ব সম্পর্কে অবহিত করুনঃ
একটি শিশুর বয়সানুযায়ী তার নিজের প্রতি, পরিবারের প্রতি, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি ভিন্ন ভিন্ন দ্বায়িত্ব থাকে, শিশুকে সেইসব দ্বায়িত্ব সম্পর্কে জানান। তাকে তার দ্বায়িত্বগুলো পালনে উৎসাহ দিন, প্রয়োজনে দ্বায়িত্ব পালনে তাকে সাহায্য করুন। যেমন, রাস্তায় ময়লা না ফেলা, প্রতিবেশীর সাথে ভাল আচরন করা ইত্যাদি। সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি এরকম ছোট ছোট দ্বায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে কিন্তু শিশু পরার্থপরতার শিক্ষা পাবে।
পশুপাখি ও অন্যান্য প্রাণীর প্রতি সদাচরনের শিক্ষা দেয়াঃ
শিশুর মধ্যে ছোটবেলা থেকেই অন্যের প্রতি দয়ালু মনোভাব ও সদাচারনের শিষ্টাচার গড়ে তুলতে হবে এক্ষেত্রে কেবল মানুষই নয়, অন্যান্য প্রাণীর প্রতিও যেন শিশুর এই মনোভাব বজায় থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। রাস্তায় ক্ষুধার্ত প্রাণীকে খাবার দেয়া, তাদের প্রতি সহমর্মী হওয়া ইত্যাদি আচরনের মাধ্যমে এই অভ্যাস গড়ে তোলা সম্ভব। এভাবে প্রাণীর প্রতি সদাচরনের অভ্যাস থেকেই শিশুর মধ্যে ধীরে ধীরে একসময় পরার্থপরতার চর্চা গড়ে ওঠে।
পারিবারিকভাবে পরার্থপরতার চর্চা করাঃ
শিশুরা স্বভাবগতভাবেই অনুকরনপ্রিয় তারা যতটা না শুনে শেখে, তার চেয়ে বেশি শেখে অন্যকে দেবে। তাই কোনো পরিবারের বড়রা যদি পরার্থপরতার চর্চা করে থাকেন তাহলে সেই পরিবারের শিশুটিও খুব সহজেই এই গুনটি রপ্ত করে নেবে। সেজন্য বাবা মা সহ পরিবারের অন্য সদস্যদের উচিত সুযোগ পেলেই বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী কর্মকান্ডে অংশ নেয়া। এছাড়া প্রতিবেশি ও আত্মীয় স্বজনের প্রতি সবসময় একটা সহানুভুতিশীল ও দয়ালু মনোভাবের চর্চা বজায় রাখা যাতে করে শিশুও বড় হতে হতে এই চর্চার মধ্যে দিয়ে যায়।
শিশুকে পরার্থপরতা কেন শেখাবেন?
মানুষ সামাজিক জীব। একজন মানুষ নিজে যতই স্বয়ংসম্পূর্ন হোক না কেন, জীবনের কোন না কোন সময়ে তার অন্যের সাহায্যের প্রয়োজন হয় সেজন্য সবসময় নিজের চাহিদাগুলোকে প্রাধান্য না দিয়ে অন্যের প্রয়োজন পূরনে এগিয়ে আসা উচিত কেননা, অন্যকে সাহায্য করলে তবেই নিজের বেলায়ও সাহায্য পাওয়া যায়। তাছাড়া একজন মানুষের ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়ার বাইরেও রাষ্ট্রের প্রতি, সমাজের প্রতি কিছু দায়বদ্ধতা থাকে সেই দায়বদ্ধতাগুলো পূরন করতে গেলে পরার্থপর হওয়ার কোন বিকল্প নেই। ধর্মীয় দিক থেকে চিন্তা করলেও প্রায় প্রত্যেকটি ধর্মেই পরার্থপরতার শিক্ষা দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি, পরার্থপরতার গুনটি যার ভেতর থাকে তাকে সমাজের সবাই সম্মান ও ভালবাসার চোখে দেখে। আর এই গুনটি গড়ে তোলা একদিনের বিষয় না। একদম ছোট বয়স থেকেই যদি একটি শিশু তার পরিবার, স্কুল ও পরিবেশ থেকে পরার্থপরতার শিক্ষা পায় কেবলমাত্র তবেই বড় হয়ে সে এর চর্চা করতে পারে। তাই আপনার শিশুকে একজন স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে তাকে পরার্থপরতার চর্চা শেখান।
এপোয়েন্টমেটের জন্য এখানে ক্লিক করুন- Prof. Dr. Shalahuddin Qusar Biplob
আরও দেখুন-