শিশু মনে বিনোদন কেন প্রয়োজন?

শিশু মনে বিনোদন কেন প্রয়োজন?

মা, আমি এখন খেলতে যাই?
না, এখন খেলা যাবে না। সারাদিন খালি খেলা আর খেলা। সামনে তোমার পরীক্ষা, সে খেয়াল আছে?

সুমিতা মুখ গোমড়া করে সেই বিকেলবেলা তার পড়ার টেবিলে গিয়ে বসল। মা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। মা ভাবলেন, যাক মেয়ে বাইরে গিয়ে ব্যথা পাবে না, খারাপ ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে মিশবে না।

তিনি যদি সন্তানের রুমে একট উঁকি দিয়ে দেখতেন তাহলে দেখতে পেতেন সুমিতা পড়ছে না। পড়ার বই সামনে খুলে চুপচাপ বিষণ্ণ মনে বসে আছে। এ সময়টুকু খেলে আসতে পারলে তার বিষণ্ণতাও থাকত না আবার রাতে পড়ার উৎসাহও বেড়ে যেত।

প্রশ্ন আসতেই পারে-খেলা বা অন্য বিনোদন কি খব জরুরি? হ্যাঁ, জরুরি। কারণ মানুষ মাত্রই, হোক শিশু কিংবা বৃদ্ধ, বিনোদন সবার জন্যই অপরিহার্য। তবে শিশুদের বেড়ে ওঠার কালে এটি আরো বেশি প্রয়োজন। কারণ বয়সকালে তাদের সুস্থ ও পরিপক্ক সামাজিক আবেগ প্রকাশের ক্ষেত্রে বাল্যকালের সুস্থ সামাজিক বিনোদন ভূমিকা রাখতে পারে।

বিনোদন প্রাতিষ্ঠানিক পড়ার চাপের সঙ্গে শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার সমন্বয় সাধন করে। এছাড়াও কিছু শারীরিক ও মানসিক উপযোগিতা আছে যেমন:

শিক্ষা: বদ্ধ জায়গা থেকে উন্মুক্ত স্থানে খেলার মাধ্যমে শিশুদের শেখালে তা শিশুদের শেখার ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। নতুন দক্ষতা অর্জনে সহায়ক হয়।

সৃজনশীলতা: বিনোদনে অংশগ্রহণ তাদের সৃজনশীল কাজকর্মে আগ্রহী করে তুলতে পারে এবং সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করে। বাইরে খেলাধুলা তাদের কল্পনাশক্তিরও বিকাশ ঘটায়।

শারীরিক স্বাস্থ্য: প্রতিদিন শিশুরা বাইরে খেলার সুযোগ পেলে তাদের ভালোভাবে ক্ষুধা লাগবে, বাড়তি মেদ ঝরে যাবে। তাতে শিশু বয়সেই স্থূল হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। শক্তি বাড়ে। রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়। ফলে ক্যালরি গ্রহণ বাড়বে। তাতে হাড় এবং মাংসপেশির গঠন দৃঢ় হবে। বাইরে গিয়ে খেলার ফলে তারা সূর্যালোক থেকে প্রাকৃতিক ভিটামিন ডি পাবে। এতে ভিটামিন ডি’র অভাবজনিত রোগে ভোগার সম্ভাবনা কমে যাবে।

সামাজিক দক্ষতা: বিনোদনমূলক কাজে অংশ নিলে, বাইরে অন্যদের সঙ্গে মিশলে নতুন বন্ধুত্ব তৈরি, বন্ধুত্ব ও সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখা, দলগতভাবে কাজ করার শিক্ষা পায়।

মানসিক সুস্থতা: সুস্থ বিনোদন শিশুদের মন ভালো করে, শান্ত রাখে ও আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে সহায়তা করে। দীর্ঘ সময় ক্লাসরুমে কাটানের পর বাসায় বসে থেকে গেজেট ব্যবহার তাদের শারীরিক এবং মানসিক দু-ধরনের ক্লান্তিই তৈরি করে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, বাইরে কিছু সময় খেলা করলে ক্লাসরুমে তাদের মনোযোগ বাড়ে।

স্বনির্ভরতা: শিশুরা যখন বড়োদের তদারকি ছাড়া নিজেদের মতো করে খেলে তখন তারা শেখে, কীভাবে নিজের পালা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়, অন্যদের সঙ্গে সমন্বয় করা, নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে খেলতে হয়, খারাপ করার পর আবার ঘুরে দাঁড়াতে শেখা, জয়-পরাজয় মেনে নিতে হয়। এসবই তাদের বড়ো বয়সে দক্ষতার সঙ্গে সমস্যা মোকাবেলায় ভূমিকা রাখে। এভাবেই তারা আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে উঠে।

অনুসন্ধিৎসু: বিনোদনের মাধ্যমে তাদের মন অনুসন্ধিৎসু হয়ে ওঠে।

কোগনিটিভ বিকাশ: সমস্যার যৌক্তিক সমাধান, চিন্তা ও কার্যকরণ খোঁজার ক্ষমতা বাড়ে। এতে আত্মবিশ্বাসও বাড়ে বহুগুণ।

মোটর বিকাশে সহায়ক: নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে খেলার ফলে তাদের মোটর বিকাশেও ভূমিকা পালন ‚ করে। যেমন, ফুটবল খেলতে গেলে একটি বলের কিক দিতে চোখ আর পায়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা, গতি, অন্য খেলোয়াড়ের সঙ্গে সমন্বয় করে কীভাবে খেলবে তা শিখে যায়।

স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি যথাযথ বিনোদনের ব্যবস্থা থাকলে ঝুঁকিপূর্ণ বাচ্চাদের স্কুল পালানোর প্রবণতা কমে আসে। এছাড়াও যাদের বাবা-মায়েদের আর্থিক অবস্থা দুর্বল, সিঙ্গেল প্যারেন্ট, অতি ব্যস্ত বাবা-মা অথবা পরিবারে সদস্যদের নিজেদের মধ্যে অশান্তি বিরাজমান বিনোদন তাদের কিছুটা স্থিতিশীল করে স্কুলে মনোযোগী করতে পারে।

বাইরে যাওয়ার সুযোগ না থাকলে বাসায় বসে পাজল মিল করা, শব্দ মেলানোর খেলা, ছবি আঁকা, নাচ-গানের চর্চা করা যেতে পারে। তবে দীর্ঘ সময় টিভি দেখা থেকে শুরু করে যেকোনো গেজেট ব্যবহার ক্ষতিকর। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ঘরের ভেতর বসে থেকে এসব বিনোদন যত বেশি হবে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর তার খারাপ প্রভাব তত বেশি হবে।

তাই আসুন শিশুর শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক সুস্থতার জন্য যতটুকু সম্ভব সুস্থ বিনোদন নিশ্চিত করি, সুন্দর আগামী প্রজন্ম গড়ি।

সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।

করোনায় স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

 

Previous articleরহস্যময় মানসিক রোগ বাইপোলার হাইপোম্যানিক
Next articleনিয়ম ভাঙলেও মস্তিষ্ক ভাল থাকে: গবেষণা
ডা. শাহানা পারভীন
সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here