বিশ্বের ১১ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশু-কিশোরদের ৮০ শতাংশই পর্যাপ্ত শারীরিক ব্যায়াম করে না। মেয়েদের মধ্যে ব্যায়াম করার হার ছেলেদের চেয়েও কম।
সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) একটি গবেষণার বরাতে এ তথ্য জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
১৪৬টি দেশের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে, পর্যাপ্ত শারীরিক ব্যায়াম না করার বিষয়টি ধনী-গরিব সব দেশেই বিদ্যমান। ২০০১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত কিশোর-কিশোরীদের শারীরিক ব্যায়ামের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে গবেষণাটি করা হয়েছে। এ সময়ে ছেলেদের মধ্যে শারীরিক অসক্রিয়তা ৮০ শতাংশ থেকে কমে ৭৮ শতাংশ হয়েছে। মেয়েদের ক্ষেত্রে অসক্রিয়তার পরিমাণ ৮৫ শতাংশ।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, যথেষ্ট পরিমাণে শারীরিক ব্যায়াম না করায় শিশু-কিশোরদের মস্তিষ্ক বিকশিত হচ্ছে না। সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশু-কিশোরদের সামাজিক দক্ষতা।
শারীরিক ব্যায়াম হিসেবে ধরা হয়েছে সেসব অনুশীলনের সময় হৃদস্পন্দন বাড়ে ও শ্বাস-প্রশ্বাস কঠিন হয়ে পড়ে। যেমন- দৌঁড়ানো, সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা, ফুটবল খেলা, লাফানো, দড়িলাফ, জিমন্যাস্টিকস ইত্যাদি।
পর্যাপ্ত ব্যায়াম হচ্ছে প্রতিদিন ৬০ মিনিট মাঝারি থেকে উচ্চ পর্যায়ের ব্যায়াম করা। মাঝারি পর্যায়ের ব্যায়ামের সময় কথোপকথন চালিয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু উচ্চ পর্যায়ের ব্যায়ামে শ্বাস-প্রশ্বাস কষ্টকর হয়ে পড়ায় কথা বলা সম্ভব নয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষক ডা. ফিওনা বুল বলেন, এটি প্রমাণিত যে, দৈনিক ৬০ মিনিট ব্যায়ামের অভ্যাস স্বাস্থ্য ভালো ও উন্নত করে।
সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অন্য একজন গবেষক ডা. রেজিনা গাটহোল্ড বলেন, স্বল্প মেয়াদে শারীরিক ব্যায়ামে সক্রিয় হলে হৃদপিণ্ড ও ফুসফুস সুস্থ থাকবে, হাড় ও পেশি শক্তিশালী হবে, মানসিক স্বাস্থ্য উন্নত হবে, ওজন ঠিক থাকবে। শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকলে সামাজিক দক্ষতা ও শেখার ক্ষমতাও বাড়ে।
এ ধরনের সক্রিয়তায় হৃদরোগ, স্ট্রোক থেকে শুরু করে টাইপ-২ ডায়াবেটিসসহ অনেক রোগের ঝুঁকি কমে যায়।
গবেষকরা বলেছেন, শারীরিক সক্রিয়তার সাথে মস্তিষ্ক বিকশিত হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
গবেষণায় কি এটিই প্রমাণিত হয় যে শিশুরা অলস? এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. বুল বলেন, শিশুরা অলস নয়। বিশ্বব্যাপী শারীরিক ব্যায়ামকে প্রধান্য না দেওয়ার যে প্রবণতা রয়েছে তা এই গবেষণায় ফুটে উঠেছে।
ব্যায়াম শিশু-কিশোরদের এত কম ব্যায়াম করার পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ শারীরিক সুস্থতার চেয়ে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমে বেশি গুরুত্ব দেওয়া।
গবেষণা প্রতিবেদনটির লেখক লিন রাইলি বলেন, এখনকার কিশোর-কিশোরীদের পরীক্ষায় ভালো করার জন্য খুব উৎসাহ দেওয়া হয়। দিনের বেশিরভাগ সময় তারা স্কুলে কাটায় ও বাসায় পড়াশোনা করে। শারীরিক সক্রিয়তার সুযোগ খুব কম পায় তারা।
গবেষকরা আরও বলেন, খেলাধুলা ও অবসরে ব্যায়াম করার মতো নিরাপদ ও সাশ্রয়ী স্থানের অভাব রয়েছে। সড়ক অনিরাপদ হলে সাইকেল চালিয়ে বা হেঁটে স্কুলে বা বন্ধুর বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ নেই।
তাছাড়া মোবাইল ফোন, ট্যাবলেট ও কম্পিউটারে খেলা বা বিনোদনের নানা সুযোগ থাকায় বাড়ির বাইরে খেলতে যাওয়ার প্রবণতা কমেছে।
ডা. বুলের মতে, এখন বিনোদনের অভিনব সুযোগ তৈরি হয়েছে যা আগের প্রজন্মগুলোর চেয়ে একদম আলাদা।
গবেষণা প্রতিবেদনটি বলছে, আফগানিস্তান থেকে জিম্বাবুয়ে সব দেশেই এই সমস্যা বিদ্যমান। বাংলাদেশে শারীরিক অসক্রিয়তা অন্য দেশের চেয়ে কম। তারপরও সেটি ৬৬ শতাংশ, অর্থাৎ প্রতি তিনজনে দুই জন শিশু দৈনিক এক ঘণ্টা ব্যায়াম করে না।
ছেলেরা সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ফিলিপাইন (৯৩ শতাংশ) ও দক্ষিণ কোরিয়ার (৯৭ শতাংশ)। যুক্তরাজ্যে ৭৫ শতাংশ ছেলে ও ৮৫ শতাংশ মেয়ে অসক্রিয়।
বিশ্বব্যাপী ৮৫ শতাংশ মেয়ে ও ৭৮ শতাংশ ছেলে পর্যাপ্ত শারীরিক ব্যায়াম করে না। টোঙ্গা, সামোয়া, আফগানিস্তান ও জাম্বিয়া- এ চারটি দেশে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে বেশি সক্রিয়।
রাইলি বলেন, মেয়েদের সক্রিয়তা কম হওয়ার পেছনে সাংস্কৃতিক কিছু বিষয় রয়েছে। অনেক দেশে কিশোরীদের ব্যায়ামে অনুৎসাহিত করা হয়। তাছাড়া অনেক খেলাধুলায় অংশ নিতে মেয়েরা স্বস্তিবোধ করে না। মেয়েদের জন্য আলাদা সুবিধা দিয়ে তাদের খেলতে আগ্রহী করতে হবে।
কানাডার ইস্টার্ন অন্টারিও রিসার্চ ইনস্টিটিউটের শিশু হাসপাতালের ডা. মার্ক ট্রেম্বলে বলেন, ইলেকট্রনিক বিপ্লবের কারণে মানুষের চলাফেরায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। বেশিরভাগ সময় তারা বদ্ধ ঘরে থাকছে, চেয়ারে বসে কাজ করছে। তারা কম ঘুমায়, বসে থাকে বেশি, হাঁটে কম, গাড়িতে চড়ে বেশি। এতে তাদের শারীরিক সক্রিয়তা কমে গেছে।
প্রফেসর রাসেল ভিনার বলেন, যেসব শিশু শারীরিকভাবে বেশি সক্রিয়, তাদের স্বাস্থ্য ভালো হয়, তারা স্কুলেও ভালো করে। শিশু ও তরুণদের জন্য সক্রিয় এবং সুস্থ জীবনযাপনের সুযোগ করে দেওয়া উচিত। তবে তিনি স্বীকার করেছেন, এটি বলার চেয়ে করা কঠিন।