মাদকাসক্তি থেকে আত্মহত্যা

মাদকাসক্তি থেকে আত্মহত্যা

আত্মহত্যা হচ্ছে নিজেকে নিজে হত্যা করা; মানসিক রোগ বা অন্য কোনো কারণে নিজের জীবনকে শেষ করে দেয়া। আত্মহত্যা সাধারণত দুই ধরনের-নির্ধারিত বা পরিকল্পিত, যা সাধারণত বিষণ্ণতা ও অন্যান্য মানসিক রোগের কারণে হয়ে থাকে। আত্মহত্যার আরেকটি ধরন হচ্ছে ইমপালসিভ বা হঠকারী আত্মহত্যা। এটা সাধারণত আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কের টানাপড়েন ও মাদকাসক্তি থেকে হয়ে থাকে।

বাংলাদেশ সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চের ২০১৩ সালের জরিপ অনুযায়ী, পৃথিবীতে প্রতিবছর প্রায় আট লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে এবং ১৫-২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে মৃত্যুর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারণ আত্মহত্যা। বিভিন্ন গবেষকের প্রাপ্ত উপাত্ত মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যার শিকার। সে হিসাবে-প্রতিদিন প্রায় ২৮ জন। কিন্তু কেন তারা আত্মহত্যার মতো পথ বেছে নেন? আত্মহত্যা প্রতিরোধে আমাদের করণীয়ই বা কী? আত্মহত্যা প্রতিরোধে ও সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ১০ সেপ্টেম্বর পালিত হয়েছে বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস। এ বছর দিবসটির মূল প্রতিপাদ্য হছিল- ‘আত্মহত্যা প্রতিরোধে একযোগে কাজ।’

যেকোনো জিনিস প্রতিরোধ করতে গেলে তার কারণ জানা জরুরি। কেন মানুষ আত্মহত্যা করে? এসব মানুষের কাছে যাপিত জীবনটি কেন বোঝা হয়ে দাঁড়ায়-এ প্রশ্ন নিয়ে সমাজবিজ্ঞানী আর মনোচিকিৎসকদের গবেষণার শেষ নেই। মনঃসমীক্ষণের জনক সিগমুন্ড ফ্রয়েড এর মতে, যখন ভালোবাসার মানুষের প্রতি সৃষ্ট তীব্র রাগ ও আক্রমণাত্মক মনোভাব নিজের দিকে ধাবিত হয়, তখন মানুষ আত্মহত্যা করে। অন্যকে হত্যা করার সুপ্ত কামনা যখন অবদমিত হয়, তখন সেটা আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হয়। মানুষের মধ্যে একটি শক্তি তাকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়, আরেকটি তাকে ধ্বংস করে ফেলতে চায়। এই ধ্বংসের শক্তির জন্যই মানুষ আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যাকারীর মধ্যে হত্যার কামনা, নিহত হওয়ার কামনা ও মৃত্যুর কামনা লক্ষ করা যায়।

এ তো গেল মনোবিজ্ঞানীদের তত্ত্বের কথা। কিন্তু বিজ্ঞানের বাস্তবতায় বর্তমান পরিস্থিতি কী- যারা বিভিন্ন মানসিক রোগে আক্রান্ত তাদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি থাকে, যেমন-বিষণ্ণতা, বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া, পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার, মাদকাসক্তি, উদ্বেগে আক্রান্ত ইত্যাদি রোগীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার উচ্চ।

গবেষণায় দেখা গেছে, পরিপূর্ণ আত্মহত্যার ৩৬-৯০% এর ক্ষেত্রে বিষণ্ণতা, ৪৩-৫৪% এর ক্ষেত্রে মাদকে আসক্তি বা অপব্যবহার এবং ৪-৪৫% এর ক্ষেত্রে অন্যান্য মাদকাসক্তি দায়ী। আত্মহত্যা, মাদকাসক্ত ও বিষণ্ণতা সঙ্গে খুবই গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। যারা আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হয় তাদের ৯০ ভাগ হয় বিষণ্ণতা, না হয় মাদকাসক্ত অথবা উভয়েই আক্রান্ত থাকে। বিষণ্ণতা ও মাদকাসক্ত মিলে একটা দ্বিপার্শ্বিক দুষ্টচক্র তৈরি করে ব্যক্তিকে আত্মহত্যার দিকে নিয়ে যায়।

মাদকের অপব্যবহারে আমাদের মস্তিষ্কের রাসায়নিক গঠনের পরিবর্তন হয়। এটা মস্তিষ্কের আনন্দ আর প্রতিদান বা পুরস্কার পাওয়ার ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে ফেলে, ফলে মস্তিষ্ক স্বাভাবিক যে-সকল কারণে আনন্দিত ও পুলকিত হওয়ার কথা তার থেকে মাদক গ্রহণে বেশি আনন্দিত ও পুলকিত হয়ে থাকে। ধীরে ধীরে মাদকাসক্ত ব্যক্তি অন্যান্য স্বাভাবিক আনন্দদায়ক কাজকর্ম থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকে এবং মাদক নেয়া রোগীর জন্য বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ায়। ক্রমাগত মস্তিষ্ক নিজেই মাদকের প্রতি তীব্র আসক্তি অনুভব করে। এতে সামাজিকভাবে সে একা হয়ে পড়ে এবং বিষণ্ণতা ও আত্মহত্যার ঝুঁকি বেড়ে যায়। ফলে, যারা মাদক গ্রহণ করে তারা অন্যান্য সুস্থ মানুষের থেকে ছয় গুণ বেশি আত্মহত্যার চেষ্টা করে থাকে এবং তিন গুণ বেশি পরিপূর্ণ আত্মহত্যা করে থাকে।

মহিলাদের মাধ্যে যারা মাদকাসক্ত তাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা স্বাভাবিকের থেকে কমপক্ষে ৬.৫ গুণ বেশি। মাদকাসক্তদের মধ্যে যারা বয়স্ক, তরুণ মাদকাসক্তদের থেকে তাদের আত্মহত্যার চেষ্টা ও আত্মহত্যার ঝুঁকি দুটোই বেশি থাকে। সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মন বিষণ্ণতায় আক্রান্ত থাকলেও আত্মহত্যার ঝুঁকি বেড়ে যায়, এর সঙ্গে যদি মাদক অপব্যবহার করে তাহলে সেই ঝুঁকি কয়েকগুণ বেড়ে যায়।

মাদকাসক্তের খুব সাধারণ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হচ্ছে বিষণ্ণতা ও অন্যান্য আবেগের সমস্যা এবং মাদক প্রত্যাহারের সময় এ ধরনের সমস্যা আরো বেড়ে যায়। মাদকের ব্যবহার বিষণ্ণতার মাত্রা ও স্থিতিকাল বাড়িয়ে দেয় যা তার আত্মহত্যার ঝুঁকিও বাড়ায়। আবার মাদকাসক্তি থেকে আরোগ্য লাভের প্রথম দিকেও আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়, বিশেষত যখন কোনো মানসিক চাপ বা আঘাতজনিত ঘটনা ঘটে যেমন-মাদকাসক্তি বা সড়ক দুর্ঘটনার জন্য গ্রেফতার হওয়া, কোনো সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া ইত্যাদি।

এ ধরনের ঘটনার ফলে মাদকাসক্ত ব্যক্তির মনে চরম অপরাধবোধ কাজ করে যা তাকে প্রায়ই আত্মহত্যার দিকে ধাবিত করে। এই বিষয়ে ইনিভার্সিটি অব মিশিগান অ্যাডিকশন ট্রিটমেন্ট সার্ভিসেরর পরিচালক ও সাকিয়াট্রির অধ্যাপক মার্ক ইলগেন বলেন, ‘বেশিরভাগ মাদকাসক্ত ব্যক্তির ক্ষেত্রে আত্মঘাতী সংকট হঠাৎ করেই আসে।’ অর্থাৎ হঠাৎ করেই তার নিজেকে আর বাঁচিয়ে রাখতে ইচ্ছে হয় না বা বাঁচিয়ে রাখার কোনো অবলম্বন খুঁজে পান না এবং তখনি তিনি আত্মহত্যার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। তিনি আরো বলেন, ‘হঠকারী আত্মহত্যা সাধারণত ইচ্ছা পোষন করার ১৫ মিনিটের মধ্যে হয়ে থাকে।’

আবার যারা মারাত্মক বিষণ্ণতায় ভোগেন তারা প্রায়ই তাদের বিষণ্ণতা কাটানোর জন্য মাদক গ্রহণ, জুয়া খেলা ও অন্যান্য বিপজ্জনক কাজে নিমজ্জিত হন। এভাবেই কখনো হতাশার কারণে আত্মহত্যা, অথবা মাদকের কারণে হতাশা, তারপর আত্মহত্যা আবার কখনো হতাশার কারণে মাদক গ্রহণ, তারপর ইমপালসিভ বা হঠকারী আত্মহত্যা ঘটে থাকে।

মাদকাসক্তি ও আত্মহত্যার কিছু একইরকম ঝুঁকির কারণ বিদ্যমান, যেমন-বংশগত, পারিবারিক ইতিহাস, মানসিক চাপ, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন, বেকারত্ব, দারিদ্র্য, একাকিত্ব, প্রিয়জনকে হারানো ইত্যাদি। শুধুমাত্র একটি ঝুঁকির কারণে সাধারণত কেউ আত্মহত্যা করে না। যখন একাধিক ঝুঁকির কারণ একইসঙ্গে ঘটে তখন সেটা তাকে বিষণ্ণতার দিকে ঠেলে দেয়, তাকে আরো বেশি মাদক গ্রহণে উৎসাহিত করে এবং শেষ পরিণতি হিসেবে সে আত্মহত্যার দিকে নিজেকে ধাবিত করে।

গবেষণায় পাওয়া যায় যে, কিছু কিছু মাদক ব্যক্তির আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যারা মেথামফেটামিন, কোকেইন ও ঘুমের বড়ি খেয়ে নেশা করেন তাদের অন্য মাদকাসক্তের থেকে আত্মহত্যার ঝুঁকি বেশি থাকে। আবার যারা মদে আসক্ত ও সাম্প্রতিক সময়ে ব্যবহার বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছেন তাদের আত্মহত্যার ঝুঁকি বেশি। ধূমপান আত্মহত্যার ঝুঁকির সাথে সম্পর্কিত। তবে গাঁজা ব্যবহারকে স্বতন্ত্রভাবে ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে দেখা যায় না। তবে, যে যত বেশি মাদকে আসক্ত হবে, আত্মহত্যার ঝুঁকি তার তত বেড়ে যাবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পৃথিবীতে প্রায় ৫০ কোটি মাদকাসক্ত ব্যক্তি রয়েছে। আইসিডিডিআরবির ‘জার্নাল অব হেলথ পপুলেশন অ্যান্ড নিউট্রিশন (জেএইচপিএন)’ এর তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় ৫০ লাখ। তবে অনেকের দাবি, এটি ৭০ লাখ। আবার অনেকের মতে, দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা কোটির কোঠা ছাড়িয়ে গেছে। আশার কথা হচ্ছে, বিষণ্ণতা, আত্মহত্যার তাড়না বা ইচ্ছা ও মাদকাসক্তি সবই চিকিৎসায় ভালো হয়। চিকিৎসার বাইরে থাকলে এ ধরনের রোগী বহুলাংশে খারাপ হয়ে যায়। এদের বহুমুখী, সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা দিতে হবে। ঔষধ খাওয়ানোর পাশাপাশি মনস্তাত্তি¡ক চিকিৎসায় এরা দ্রুত সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে।

সূত্র: মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ২য় বর্ষ, ৯ম সংখ্যায় প্রকাশিত।

Previous articleঅনলাইনে শপিং এর অতিমাত্রাকে মানসিক রোগ বলছে গবেষণা
Next articleশিশু-কিশোরদের ৮০ শতাংশ পর্যাপ্ত ব্যায়াম করে না
সহকারি অধ্যাপক, মনোরোগ বিভাগ, ফরিদপুর মেডিক্যাল কলেজ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here