ডা. ওয়ালিউল হাসনাত সজিব
সহকারী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ
শহীদ এম মনসুর আলী মেডিক্যাল কলেজ, সিরাজগঞ্জ।
আমরা যারা মানসিক রোগের চিকিৎসক তাদের কাছে প্রায়শই কিছু রোগী আসে একগাদা চিকিৎসা সংক্রান্ত ফাইলপত্র নিয়ে। বহুদিনের পুরনো রোগী তারা। বহু জায়গায় চিকিৎসা করে অবশেষে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হয়েছেন রোগের কোনো উন্নতি না হওয়ায়। এসব রোগীর ফাইলপত্র ঘেঁটে দেখা যায় তাদের বেশীরভাগই শারীরিক বিভিন্ন লক্ষণ নিয়ে চিকিৎসকের কাছে ঘুরছেন। কিন্তু শারীরিক এসব লক্ষণগুলোর মূল কারণই ছিল মানসিক রোগ যা সময়মতো বুঝতে না পারার কারণেই অতশত ভোগান্তি।
আসলে আমরা বেশীরভাগ মানুষ এখনো মানসিক রোগ নিয়ে খুব বেশি সচেতন নই, তাই এই রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা নিয়ে রয়েছে নানাবিধ বিভ্রান্তি। কিছু কিছু লক্ষণ অস্বাভাবিক, তাই মনে চিন্তা আসে জিন—ভূতের আছর। আবার কিছু কিছু লক্ষণ শারীরিক অন্যান্য রোগের মতো হয়। এসব কারণে এখনো এসব রোগের চিকিৎসা চলে তাবিজ—কবজ কিংবা কবিরাজের মাধ্যমে। মনে রাখতে হবে মানসিক কিছু কিছু রোগে শারীরিক লক্ষণ অনেক বেশি আবার প্রায় মানসিক রোগের প্রভাব শারীরিকভাবেও প্রকাশ পায়।
বুকে চাপ লাগা কিংবা প্রচণ্ড বুক ধড়ফড় করা নিয়ে অনেক সময়ই রোগী হৃদরোগ চিকিৎসকের কাছে চিকিৎসা নিতে আসেন। হৃদরোগের প্রায় সব রকমের বড়ো বড়ো পরীক্ষা—নিরীক্ষা করে এমনকি এনজিওগ্রাম পর্যন্ত করেও যখন কিছু পাওয়া যায় না তখন শেষ ভরসা মানসিক রোগ চিকিৎসক। কারণ, দুশ্চিন্তার একটি রোগ ‘প্যানিক ডিজঅর্ডার’। যেখানে রোগীর লক্ষণগুলো ঠিক একইরকম। এই রোগে দেখা যায় রোগীর হটাৎ বুক ধড়ফড় করতে থাকে, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, দম বন্ধ হয়ে আসে, শরীর, হাত—পা কাঁপতে থাকে। শরীর মনে হয় অবস হয়ে আসছে, বুকে চাপ অনুভব হয়, বমি বমি লাগতে থাকে, মনে হয় সে বোধহয় জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে। লক্ষণগুলো এতটাই আতঙ্ক তৈরি করে যে, ব্যক্তি মনে করে সে বোধহয় মারা যাচ্ছে। এই লক্ষণগুলোর যখন শারীরিক কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না তখন একে বলে প্যানিক অ্যাটাক যা প্যানিক ডিজঅর্ডারে দেখা যায়। প্যানিক ডিজঅর্ডারের বেশিরভাগ লক্ষণই শারীরিক যা রোগীকে বিভ্রান্ত করতেই পারে।
মাথাব্যথা জীবনে কার হয়নি? এমন লোক হয়ত খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু মাথাব্যথার বেশিরভাগ রোগী কিন্তু চিকিৎসা নিতে শুরুতেই মানসিক চিকিৎসকের কাছে আসেন না। কারণ মাথা মানেই নিউরোলজী আর চিকিৎসক মানেই নিউরোলজিস্ট। মানসিক সমস্যায় যে মাথাব্যথা হতে পারে সেটা তারা মনেই করেন না। মনে রাখতে হবে মাথাব্যথার অনেক কারণই মানসিক; যেমন- দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপ কিংবা বিষণ্ণতায় মাথাব্যথা হতে পারে। মাথায় চাপ ধরে থাকা, মাথার জ্বালা—পোড়া, গরম অনুভূতি হওয়া এসবও মানসিক রোগের লক্ষণ হতে পারে। জেনারালাইস্ট অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার কিংবা বিষণ্ণতার অনেক রোগী অনেক সময় শুধু মাথাব্যথা নিয়েই চিকিৎসকের কাছে আসেন।
শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ব্যথা-বেদনা যা মাঝে মাঝেই শরীরের বিভিন্ন স্থানে পরিবর্তিত হয় এবং বিভিন্ন পরীক্ষা—নিরীক্ষায় ধরা পড়েনি। এই রোগটিকে আমরা বলি ‘সোমাটিক সিম্পটম ডিজঅর্ডার’ যা একটি মানসিক রোগ। যার লক্ষণগুলো বেশীরভাগই শারীরিক। এই রোগেও রোগী রোগের কারণ হিসেবে শারীরিক রোগকেই চিন্তা করেন এবং বহু চিকিৎসা করেই তবে মানসিক চিকিৎসকের নিকট আসেন। এই রোগে দেখা যায় রোগী শরীরের এক বা একাধিক স্থানে ব্যথার কথা বলেন। কিন্তু কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। কিছুদিন পর পর এমন নানাবিধ ব্যথা-বেদনা যেন শরীর জুড়েই ঘুরে বেড়াতে থাকে কিন্তু কারণ আর দেখা মেলে না। আসলে মূল সমস্যাটাই রয়ে গেছে মনে।
চাপজনিত মানসিক রোগ বা স্ট্রেস ডিজঅর্ডার, দুশ্চিন্তার যেকোনো রোগ বা অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার কিংবা বিষণ্ণতা বা ডিপ্রেসিভ ডিজঅর্ডারের প্রায় রোগী শারীরিক লক্ষণ নিয়ে আসে, যেমন, শারীরিক দুর্বলতা, মাথা ঘুরানো, মাথা-ব্যথা, শরীর হাত—পা জ্বালাপোড়া, শরীরে ব্যথা, পেটের সমস্যা, বুক ধড়ফড় করা, বুক ব্যথা, বা শ্বাসের সমস্যা নিয়েও রোগী আসতে পারে। এসব লক্ষণগুলো মানসিক কারণেও যে হতে পারে তা অনেকেই শুরুতে বিশ্বাস করতে চান না।
হিস্টিরিয়া বলে একটি শব্দ আমাদের সমাজে খুবই প্রচলিত। হিস্টিরিয়া একটি মানসিক রোগ যাকে আমরা বলি ‘কনভারশন ডিজঅর্ডার’। এই রোগের রোগী প্রায়ই হাসপাতালে ভর্তি হন হঠাৎ তৈরী হওয়া শারীরিক কিছু লক্ষণ নিয়ে। যেমন— হাঁটতে না পারা, কানে শুনতে না পাওয়া, চোখে দেখতে না পাওয়া, শরীরে অনুভূতি না পাওয়া, মাঝে মাঝেই অজ্ঞান হয়ে যাওয়া কিংবা কথা বলতে না পারা। এসব লক্ষণ দেখলে মনে হয় রোগী বোধহয় স্ট্রোক করেছে। কিন্তু সিটি স্ক্যান, এমআরআই কিংবা শারীরিক পরীক্ষা—নিরীক্ষা করেও কিছুই পাওয়া যায় না। মূলত মানসিক দ্বন্দ্ব কিংবা মানসিক চাপ থেকে এর প্রকাশ হয় যাকে আমরা বলি কনভারশন। অর্থাৎ মানসিক চাপ শারীরিক লক্ষণের মাধ্যমে কনভারশন বা পরিবর্তিত হয়েছে বলেই একে আমরা বলি কনভারশন ডিজঅর্ডার। এই রোগে আমরা মনের অনেক দ্বন্দ্ব বা চাপকে প্রকাশ করতে পারি না কিংবা নিজেই নিজের চাপকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হই, তখন এই চাপ অনেক সময় শারীরিক বিভিন্ন লক্ষণ আকারে প্রকাশ পায়। রোগীর লক্ষণ দেখে আমরা বুঝি শারীরিক রোগ, কিন্তু মূল কারণ মানসিক।
অনেক সময় দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক রোগেও মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। এসব অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় রোগীর শারীরিক রোগের চিকিৎসা চলছে ঠিকই কিন্তু উন্নতি আশানুরূপ নয়। অথবা দিনদিন চিকিৎসা যেন জটিল হচ্ছে। চিকিৎসকদের অনেকেই ভুলে যাই দীর্ঘমেয়াদী এসব রোগে মনেরও একটু যত্ন নেয়া উচিত। কারণ অনেক সময় মানসিক রোগের লক্ষণগুলো শারীরিক অন্যান্য লক্ষণগুলোর কাছে চাপা পড়ে যায় কিংবা মানসিক সমস্যার শুরুটা হয়ত শারীরিক লক্ষণ দিয়েই হয়েছিল। দার্শনিক প্লেটো তাই বলেছিলেন, আমরা চিকিৎসকরা প্রায়ই একটি ভুল করি মনকে না সারিয়ে শরীরকে সারাতে চেষ্টা করি যা আমাদের রোগের চিকিৎসাকে জটিল করে।
আমরা আসলে জানি না বা মানতে চাই না যে মনের সমস্যার জন্যও শারীরিক লক্ষণ দেখা দিতে পারে। মূলত মনের সমস্যা মানেই ব্রেইনের সমস্যা। আর ব্রেইন আমাদের শরীরকে চালনা করে, তাই বুঝতে হবে শারীরিক সমস্যা মানেই শুধু শরীর নয়, মনও এর সাথে জড়িত থাকতে পারে।