বিস্ময়কর হলেও সত্য জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো খুব সহজেই আমাদের দৃষ্টির অগোচরে থেকে যায়। ব্যস্ত সময়, দিনের কাজ, সপ্তাহের রুটিন মস্তিষ্ককে সদা ব্যস্ত রাখে।জীবনের কিছু প্রয়োজনীয় সত্য বারবারই ধরা দেয়। আর সে কারণে এ লেখাটি বুকমার্কে রাখুন আর সুযোগ পেলেই একবার খুলে পড়ে নিন- যে দশটি ধ্রুব সত্য আমরা সহজেই ভুলে যাই
এক. ব্যস্ততা মানেই উৎপাদনশীলতা নয়। আপনার চারিদিকে সবার দিকে তাকান। দেখবেন সবাই ব্যস্ত। মিটিংয়ের পর মিটিং করছে… ছুটছে… ই-মেইল পড়ছে… উত্তর দিচ্ছে। তাদের কতজনই আসলে কিছু উৎপাদন করছে? কতজনই যেতে পারছে সাফল্যের উচ্চ পর্যায়ে?
সাফল্য বস্তুত আপনার নড়াচড়া আর কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আসে না। সাফল্য আসে আপনি কতটা সুনির্দিস্টভাবে কাজটি করতে পারছেন তার ভিত্তিতে। আপনি সময়টিকে কতটা কার্যকর আর উৎপাদনশীলতায় ব্যবহার করতে পেরেছেন তার নীরিখে। অন্য কেউ ঠিক যতটা সময় পান, আপনার সময়ও ঠিত ততটুকুই। আপনাকে আপনার সময়টুকু বুদ্ধিমত্তার সাথে ব্যবহার করতে হবে। মোটের ওপর, আপনি কিন্তু আপনারই আউটপুটের ফল, প্রচেষ্টার ফসল নন। এটা নিশ্চিত করুন, আপনার প্রচেষ্টা সেই কাজেই ন্যস্ত যা আপনার জন্য ফল বয়ে আনবে।
দুই. ব্যর্থতার পরেই আসে বড় কোনও সাফল্য। আপনি কখনোই সত্যিকারের সাফল্যের মুখ দেখবেন না যতক্ষণ না ব্যর্থতার স্বাদ গ্রহণ করবেন। আপনার ভুলগুলোই আপনাকে সাফল্যের পথ দেখাবে। ভুল পথ থেকে আপনি সঠিক পথের দিকে অগ্রসর হতে পারবেন।
বড় সাফল্যগুলো সাধারণত তখনই আসে ঠিক যখন আপনি থাকেন সবচেয়ে বেশি হতাশ ও সবচেয়ে নিমজ্জিত। এই হতাশাই আপনাকে ভিন্নভাবে ভাবতে শেখায়, বক্সের বাইরে তাকান আর সমাধানটি খুঁজে বের করুন, যা এতদিন আপনি খুঁজে পাননি এখন পেয়ে যাবেন।
সাফল্যের জন্য চাই ধৈর্য্য। সঙ্গে সদাচারটি ধরে রাখার শক্তিও থাকতে হবে। এমনকি যখন আপনি সঙ্কটে পতিত তখনও এই দুটি শক্তিই আপনাকে সেখান থেকে বের করে আনবে। কারণ আপনি ধৈর্য্য ধারণ ও সদাচারেই বিশ্বাসী।
তিন. ভয় দুঃখ ডেকে আনবেই। সব কিছু যখন বলা ও করা হয়ে যাবে, আপনার মনে হবে সবপথেই চেষ্টা করে দেখলেন, আর কোনও পথ বাকি নেই তখনও ভীত হয়ে পড়বেন না। এমন পরিস্থিতিতে ঝুঁকি নিতে ভয় পাবেন না। তাতে মৃত্যু আসারও সম্ভাবনা যদি থাকে। আসলে মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ কিছু রয়েছে। সুতরাং মৃত্যুই শেষ নয়। আপনি না মরে গিয়ে বেঁচে থেকেও ভেতরে ভেতরে মরতে থাকবেন, সে মৃত্যুই সবচেয়ে ভয়াবহ।
চার. আপনার নিজের যোগ্যতাটিই সবচেয়ে বড় কথা। যখন আপনি আপনার সুখ আর আনন্দ নির্ণয়ে অন্যের সুখ ও আনন্দের সঙ্গে তুলনা করবেন, তখনই ভুলটি হয়ে যাবে। আপনি আর নিজের মতো করে এগুতে পারবেন না। কিন্তু নিজে যা কিছু করেছেন বা করতে পারছেন তাতে যদি আপনি তুষ্ট থাকেন, তাহলে আর কারো কথায় কান দেবেন না। আর অন্যের কথায় প্রভাবিত হয়ে নিজেকে ছোট করে দেখবেন না।
অন্যরা আপনাকে নিয়ে কি ভাবছে সে নিয়ে চিন্তিত হওয়ার প্রয়োজন নেই, অন্যের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করারও প্রয়োজন নেই। মানুষের মতামত অবশ্যই নিতে পারেন, কিন্তু একটি জিনিষ অবশ্যই মনে রাখবেন, তারা আপনার সম্পর্কে যতটা ভালো কিংবা মন্দ বলে তার কোনওটাই আপনি নন।
পাঁচ. আপনি কতটা ভালো তা আপনার সঙ্গরাই বলে দেবে। আপনি ঠিক ততটাই ভালো হবেন যতটা আপনার সঙ্গিরা। ফলে তাদেরই আশেপাশে থাকুন, কিংবা তাদেরই আশেপাশে রাখুন যারা আপনার জন্য ভালো কেউ হবেন। আপনি হয়তো সেটাই করেন। কিন্তু কিছু লোকতো থাকেই যারা আপনাকে টেনে নামাতে চায়। তাদের ব্যাপারে একটাই কথা-কেনই আপনি তাদের আপনার জীবনের অংশ হওয়ার সুযোগ দিচ্ছেন? যে আপনাকে নিজেকে অকর্মন্য বলে ভাবতে ভূমিকা রাখে, আপনাকে উদ্বিগ্ন করে তোলে, আপনার সময় নষ্ট করে, আর চেষ্টা করে আপনিও যেনো তাদের মতোই হন, এমন লোকদের সঙ্গ দেওয়ার সময় আপনার নেই। আপনার জীবন এত বড়ও নয় যে তাদের জন্য কিছুটা সময় বরাদ্দ করবেন। সুতরাং এদের থেকে দূরেই থাকুন।
ছয়. আরেকটি ধ্রুব সত্য কথা এই যে জীবনটা খুব ছোট। কারো যখন অপ্রত্যাশিত মৃত্যু হয়, তখনই আমরা আমাদের নিজেদের জীবন নিয়ে ভাবতে বসি। আমাদের মনে হয়, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো কি, কীভাবেই আমরা আমাদের জীবনটাকে অতিবাহিত করি, সময়টিকে ব্যয় করি, আর কিভাবেই আমরা অন্যের সঙ্গে ব্যবহার করি। কাউকে হারানো মানেই হচ্ছে আপনাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া, যা হচ্ছে তা ঠিক হচ্ছে না।
তাহলে সেই অপেক্ষা না করে প্রতিদিন সকালে নিজেকেই নিজে স্মরণ করিয়ে দিন যে আজকের এই দিনটিই আপনার কাছে একটা উপহার স্বরূপ এসেছে। আর এই আশীর্বাদ হিসেবে আসা সময়টিকে আপনি সর্বোচ্চ কার্যকারিতায় ব্যবহার করবেন। জীবনকে আপনি যখনই আশীর্বাদ হিসেবে নিয়ে কাজ করতে থাকবেন, তখনই আপনার সত্যিকারের কাজটি শুরু হবে। আসলে একটি সুন্দর দিন একটি সুন্দর মন ও চিন্তা দিয়েই শুরু হয়।
সাত. কাউকে ক্ষমা করে দিতে ক্ষমা প্রার্থনার অপেক্ষা করবেন না। জীবনটা অনেক ভালো চলবে যখন অন্যকে খুব দ্রুত ক্ষমা করে দিতে পারবেন। এমনকি কেউ যদি কথনো তার কৃতকর্মের জন্য দুঃখ প্রকাশটিও না করে তাও। এসবের জন্য আপনি আপনার আজকের আনন্দটি মাটি করতে পারেন না। ঘৃণা ও ক্রোধ এমন দুই অনুভূতি যা আপনার আনন্দপূর্ণ জীবনের ক্ষতি ডেকে আনে। নেতিবাচক আবেগ আপনার শরীরের ওপর প্রভাব ফেলে, এক ধরনের চাপ তৈরি করে যা থেকে ভয়াবহ রোগও হয়ে বসতে পারে। আর যদি আপনি কাউকে দ্রুতই ক্ষমা করে দেন, তাতে হয়তো তাদের কাজের নিন্দা জানানোটা হবে না, কিন্তু আপনি নিজে খুব দ্রুতই এর বাইরে বের হয়ে যেতে পারবেন। তাতে আপনারই সুরক্ষা।
আট. আপনার সৃষ্ট জীবনটাই আপনি যাপন করছেন। আপনি কখনো পরিস্থিতির শিকার হবেন না। কেউ আপনাকে জবরদস্তি করে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করাতে পারবে না। কিংবা আপনাকে দিয়ে এমন কিছু করিয়ে নিতে পারবে না যা আপনি মূল্যবোধ ও চেতনা দিয়েই এড়িয়ে চলেন। আজ আপনি যেভাবে বেঁচে আছেন তা আপনার নিজেরই তৈরি- আপনিই তার স্রষ্টা। ঠিক একইভাবে আপনার ভবিষ্যতের স্রষ্টাও আপনি। আপনি যদি পতিত বোধ করেন তা সম্ভবত এই কারণে যে, আপনি ভয় পাচ্ছেন। আপনাকে আসলে জীবনের কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে ঝুকি নিতে হবে। স্বপ্ন পূরণে এর আর কোনওই বিকল্প নেই।
কাজটি যখন করার সময়, মনে রাখবেন, করে ফেলতে হবে। সবসময় এটাই ভাবা উত্তম যে, যেই সিঁড়িটি আপনি বেয়ে উঠতে চান আপনি তার গোড়ায় অবস্থান করছেন। নিজেকে কখনোই সিঁড়ির উপরে ভাববেন না।
নয়. এখনের জন্য বাঁচুন। আপনি যদি বর্তমান সময়টিতে কিভাবে বাঁচতে হবে তা না জানেন তাহলে কখনোই আপনার পূর্ণ সম্ভাবনা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারবেন না। কোনও অপরাধ বোধ দিয়েই অতীতকে মুছে দেওয়া যাবে না। আর উদ্বিগ্ন হয়ে ভবিষ্যতকে বদলাতে পারবেন না। আপনি যদি সারাক্ষণই অন্য কোথাও থাকেন, হয় অতীতে নয়তো ভবিষ্যতে, আপনি কখনোই সুখী হতে পারবেন না। এই মূহূর্তে আপনার সামনে যা রয়েছে তাকে আলিঙ্গন করুন, হোক তা ভালো কিংবা মন্দ, তাতেই আনন্দ। এজন্য অতীতকে গ্রহণ করে নিন আর ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তাকেই গুরুত্ব দিন। উদ্বেগ আসলে আপনাকে সেই ঋণের পরিশোধে বাধ্য করবে যে ঋণ আপনি কখনো করেনই নি।
দশ. পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী… একে আলিঙ্গন করুন। আপনার মনটা উদার হতে হবে। আপনার দুবাহু বাড়িয়ে রাখতে হবে যাতে পরিবর্তনকে সহজেই গ্রহণ করতে পারেন। পরিবর্তনকে উপেক্ষা করে গেলে আপনার ব্যর্থতা অনিবার্য।
জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না। যখন সব কিছু ভালোয় ভালোয় চলে, সেগুলোকে প্রশংসা করুন, উপভোগ করুন, কারণ ওগুলোই আপনাকে পাল্টে দেবে। আপনি যদি সারাক্ষণই অন্য কিছুর খোঁজে থাকেন, আরও ভালো কিছু পেতে চান, আর ভাবেন তাতেই আপনার সুখ আসবে, তাহলে বর্তমানকে নিয়ে খুশি থাকার জন্য আপনার উপস্থিতিটাই থাকবে না। সুন্দর সময়টি চলে যাওয়ার আগেই তা উপভোগ করে নিন।