করোনাকালে অনাকাঙ্ক্ষিত হারে বৃদ্ধি পেয়েছে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা। আর সেই সমস্যাগুলো বিভিন্ন শারীরিক জটিলতার নেপথ্যে ভূমিকা পালন করছে। শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য এই সমস্যাগুলো সম্পর্কে অধিক মাত্রায় সচেতনতা সৃষ্টি প্রয়োজন।
মহামারীর এই দুঃসময়ে সবার মাঝেই বাসা বেঁধেছে ভয় ও হতাশা। মনস্তত্ত্ববিদদের মতে, ভয় ও হতাশা তখনই সৃষ্টি হয় যখন একজন মানুষ আশঙ্কা করে যে তার সাথে খারাপ বা নেতিবাচক কিছু ঘটতে চলেছে।
বিশ্ব ব্যাপী প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ করোনা মহামারীতে আক্রান্ত হচ্ছে এবং অসংখ্য মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। প্রতিনিয়ত মহামারীতে আক্রান্ত হওয়ার ভয় এবং নিজের সহ কাছের মানুষদের সুরক্ষা নিয়ে দুশ্চিন্তা আমাদেরকে মানসিক ভাবে ভীষণ রকম উদ্বিগ্ন করে তুলছে।
আমরা জানি না যে এই মহামারী কবে নাগাদ শেষ হবে এবং আমরা আবার আমাদের সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাবো। এমন অবস্থায় মানসিক চাপ বৃদ্ধি, ভয়, হতাশা কিংবা দুশ্চিন্তা কোনটিকেই অকারণ সৃষ্ট বলা যায় না।
তবে যেটি বর্তমানে দুশ্চিন্তার মূল কারণ হয়ে উঠেছে সেটি হল এসব মানসিক সমস্যাকে অনেকাংশেই উপেক্ষা করা হচ্ছে। আমরা করোনা থেকে মুক্ত থাকার চিন্তায় এমনভাবে ডুবে গেছি যে, এই দুশ্চিন্তা আমাদের শরীরের উপর আরো বেশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে সেটি আমরা খেয়াল করছিনা।
আর এটিই বর্তমানে আমাদের শরীর ও মন সুস্থ রাখার পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে দেখা দিয়েছে। আসুন মানসিক সমস্যা কিভাবে আমাদের মধ্যে বিভিন্ন শারীরিক জটিলতার জন্ম দেয় এবং এক্ষেত্রে আমাদের করনীয় কি সে সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি।
করোনা কালীন এই দুঃসময়ে সৃষ্ট মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলোর মধ্যে অন্যতম হল, বিষণ্ণতা, দুশ্চিন্তা, উদ্বিগ্নতা, হতাশা, একাকীত্ব, মনোবল হীনতা, ভয় ইত্যাদি। অতিমারীর এই দুঃসময়ে এই ধরণের মানসিক সমস্যাগুলোকে অস্বাভাবিক বলা যায় না। কিন্তু এই সমস্যাগুলোকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিয়ে সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকাও সম্ভব নয়।
যখন একজন মানুষ এ ধরণের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার শিকার হয়, তখন তার জীবন যাপন, আচার আচরণ, চিন্তা ভাবনাসহ সামগ্রিক জীবন ব্যাবস্থা এর দ্বারা প্রভাবিত হয়। একজন সদা হাস্যোজ্বল মানুষ হয়তো হাসতে ভুলে যেতে পারেন, আবার একজন মানসিক ভাবে দৃঢ় চেতা মানুষ মনোবল হারিয়ে হতাশায় ডুবে যেতে পারেন।
এছাড়াও অনেকের মাঝে দেখা দেয় একাকীত্ব এবং ক্ষুধা মন্দা । ফলে শরীর ভেঙে যায় এবং নানাবিধ রোগ ব্যাধিতে ব্যাক্তি আক্রান্ত হয়। অনেকের ক্ষেত্রে নিদ্রাহীনতা দেখা দিতে পারে। যা ব্যাক্তিকে আরো দুর্বল এবং জীর্ণ শীর্ণ অবস্থায় পৌঁছে দেয়।
বিভিন্ন সময়ে করা গবেষণায় দেখা গেছে, মানসিক চাপ একজন ব্যাক্তির পরিপাক ক্রিয়া, রক্ত চাপ, এমনকি রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে চরম ভাবে প্রভাবিত করে। আর এসব কিছুর অস্বাভাবিক অবস্থা বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা যেমন- মাথা ব্যাথা, বুক ধড়ফড় করা, বুকে ব্যাথা, শ্বাস প্রশ্বাসে অসুবিধা, বমি ভাব, অধিক মাত্রায় খাওয়া বা খেতে ইচ্ছা না করা, ডায়রিয়া, অতি মাত্রায় ঘাম হওয়া, মনোযোগ দিয়েও কিছু করতে না পারা, হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, সহজে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়াসহ বিবিধ জটিলতা সৃষ্টি করে।
এমন নয় যে একজন ব্যক্তির সব ধরণের সমস্যা দেখা দেবে বা সবার ক্ষেত্রে একই মাত্রার সমস্যা হবে। পরিবেশ পরিস্থিতি, শারীরিক অবস্থা এবং মানসিক জটিলতা সব কিছুর উপর ভিত্তি করে এসব সমস্যা স্বল্প মাত্রা থেকে শুরু করে অত্যন্ত জটিল আকার ধারণ করতে পারে।
করোনাকালে আমাদের সবারই একটাই প্রচেষ্টা রয়েছে, সেটি হলো সুস্থ থাকা। এই সুস্থ থাকা শুধু শারীরিক ক্ষেত্রেই নয় বরং মানসিক ভাবেও হওয়া উচিত। আমাদের মনে রাখতে হবে, মানসিক স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে কখনোই শারীরিক ভাবে সুস্থ জীবন যাপন করা যায় না।
তাই মানসিক যে কোন সমস্যাকে অবহেলা না করে সেটি নিরসনের প্রয়াস করতে হবে। প্রাত্যহিক জীবনে আমাদের মানসিক অবস্থাকে গুরুত্ব দিতে হবে। নিজের সমস্যা নিয়ে কাছের মানুষদের সাথে আলোচনা করতে হবে।
স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাস এবং শরীর চর্চার মাধ্যমে শরীর ও মনকে চাঙ্গা রাখতে হবে। আর যদি এসব প্রয়াস করার পরেও মানসিক সমস্যা থেকে পরিত্রাণ না পাওয়া যায় তাহলে বিশেষজ্ঞ বা চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
সব সময় মনে রাখতে হবে, শরীর ও মন একে অপরের থেকে পৃথক নয়। মন আক্রান্ত হলে তার প্রভাব শরীরের ওপরেও পড়বে। তাই মানসিক সমস্যাকে ছোট করে দেখার বা কম গুরুত্ব দেবার কোন সুযোগ নেই। মানসিক চাপসহ অন্যান্য সমস্যাগুলোর সঠিক সমাধান করে শারীরিক ও মানসিক ভাবে সুস্থ জীবন যাপন করতে হবে।