সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে মানুষ মাত্রই বাচনিক এবং অবাচনিক যোগাযোগের মাধ্যমে একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে চলেছে। এই অনিবার্য সামাজিক মিথস্ক্রিয়া করতে গিয়ে একজন মানুষের মনের কি খবর হয় তা কি আমরা সব সময় বুঝতে পারি? একজন মানুষ যখন নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতার উপর আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে তখন তার মধ্যে তৈরী হয় উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। তার মনের মধ্যে অন্তর্নিহিত ভয়, লজ্জা, সংকোচবোধ মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে সক্রিয় হয়ে উঠে। যার ফলে সে সামাজিক পরিস্থিতিতে ভীত হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে তার মধ্যে তৈরী হয় সোশ্যাল অ্যাংজাইটি ডিসঅর্ডার। আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন প্রকাশিত ডায়াগনস্টিক এন্ড স্ট্যাটিস্টিক্যাল ম্যানুয়েল ফর মেন্টার ডিজঅর্ডার (ডিএসএম-৫) সোশ্যাল অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডার বা সোশ্যাল ফোবিয়া নির্ণয়ের জন্য কিছু লক্ষণের কথা বলা হয়েছে-
♦ এক বা একাধিক সামাজিক পরিস্থিতিতে ব্যক্তির মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে বা চোখে পড়ার মত ভয় বা উদ্বেগ তৈরী হয় যে অন্যরা তাকে সুস্থভাবে খেয়াল করছে বা মূল্যায়ন/পরীক্ষা করছে। উদাহরণ স্বরূপ- সামাজিক পারষ্পরিক যোগাযোগ (যেমন: কথোপকথন, অপরিচিত মানুষের সাথে আলোচনায়) পর্যবেক্ষণে থাকা (খাদ্য এবং পানীয় পানের সময়) অন্যের সম্মুখে কার্য সম্পাদনের সময় (বক্তব্য দেয়ার সময়)।
নোট: শিশুদের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি অবশ্যই তাদের সহপাঠীদের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রেও হতে হবে এবং শুধু বড়দের ক্ষেত্রে হয় এমনটি নয়।
♦ সে ভয় পায় যে, সে যেভাবে কাজটি করবে অথবা তার উদ্বেগের লক্ষণগুলো প্রকাশ পেয়ে গেলে তাকে নেতিবাচক ভাবে মূল্যায়িত করা হবে (যেমন- অন্যের চেয়ে ভালো করেনি এমন ভাবে তুলনা করা হবে অথবা লজ্জা দেয়া হবে; যার ফলে সে অন্যের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হবে এবং শ্রদ্ধা হারাবে)
♦ সামাজিক পরিস্থিতিতে প্রায় সব সময় ভয় এবং উদ্বেগের মধ্যে থাকে।
নোট: শিশুরা এই ভয় এবং উদ্বেগ কান্না, হঠাৎ করে অল্প সময়ের জন্য রেগে যাওয়া, শরীর তীব্র ভাবে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া, ভীত হয়ে যাওয়া, সংকুচিত/সংকোচবোধ অথবা সামাজিক পরিস্থিতিতে কথা বলতে না পারা।
♦ যে সমস্ত পরিস্থিতিতে তীব্র ভয় এবং উদ্বেগের অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতা হয় তা সে এড়িয়ে চলে। এই ভয় এবং উদ্বেগ সত্যিকার সামাজিক পরিস্থিতি এবং সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে যে ভীতিকর আবেগ তৈরী হয় তার চেয়ে বেশি হয়ে থাকে।
♦ এই ভয়, উদ্বেগ এবং এড়িয়ে চলা দীর্ঘস্থায়ী রূপ নেয়, সাধারণত ৬ মাস বা তার বেশি সময় স্থায়ী হয়।
♦ এই ভয়, উদ্বেগ এবং এড়িয়ে চলার কারণে ক্লিনিক্যালি তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে তার সামাজিক, পেশাগত এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারিক কাজ-কর্মের ক্ষেত্রে বিঘ্ন বা সমস্যা সৃষ্টি করে।
♦ এই ভয়, উদ্বেগ এবং এড়িয়ে চলার প্রবণতা সাবস্টেন্স (মাদকের অপব্যবহার, ঔষধ) ব্যবহারের ফলে কোন শারীরিক প্রতিক্রিয়া নয় বা অন্য কোনো শারীরিক অসুস্থতা জনিত কারণে হয়নি।
♦ এই ভয়, উদ্বেগ এবং এড়িয়ে চলাকে অন্য কোন মানসিক ডিজঅর্ডার দ্বারা ব্যাক্ষা না করাই ভালো। যেমন- প্যানিক ডিজঅর্ডার, বর্ডি ডিসমোরফিক ডিজঅর্ডার অথবা অটিজম স্পেকটড়াম ডিজঅর্ডার।
♦ যদি অন্য কোন শারীরিক কারণে হয় (যেমন- পারকিনসন্স ডিজিজ, অবেসিটি, আগুনে পুড়ে অথবা দূর্ঘটনার কারণে চেহারা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া) এসব ক্ষেত্রে যে অতিরিক্ত ভয় এবং উদ্বেগ তৈরী হয় তা সোশ্যাল অ্যাংজাইটি ডিজঅর্ডারের সাথে সম্পর্কিত নয়।
বিশেষায়িত কারণ
এই ভয় বা উদ্বেগ জনসন্মুখে বক্তব্য বা কার্য সম্পাদনের ক্ষেত্রে হয় কিনা তা নির্দিষ্ট করা। সোশ্যাল অ্যাংজাইটিতে আক্রান্তরা যথেষ্ট পরিমাণে অ্যাসারটিভ নয়। এরা অতিরিক্ত পরিমানে অন্যের আনুগত্য স্বীকার করে নেয় বা অন্যের মতামতকে অনিচ্ছাকৃত ভাবে মেনে নেয় সমস্যাকে এড়িয়ে চলার জন্য। কথোপকথনের সময় অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করে। একই ধরনের দেহভঙ্গি, ভালোভাবে চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে না এবং খুবই নরম কন্ঠে কথা বলে। এক্ষেত্রে তারা লজ্জা পায়, পরিবেশ থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়, তারা উন্মুক্ত আলোচনা করে না। তারা দীর্ঘ সময় বাসায় কাটায়। ছেলেরা দেরীতে বিয়ে করতে পারে এবং পরিবারের সাথেই সময় কাটায়। অন্যদিকে মেয়েরা যে কিনা ঘরের বাইরে কাজ করতে চেয়েছিলো সেও এই সমস্যার কারণে গৃহ পরিচালনা এবং মায়ের ভূমিকায় জীবন কাটিয়ে দেয়।
আমেরিকাতে গড়ে ১৩ বৎসর বয়সে এই ডিজঅর্ডার শুরু হয় এবং ৭৫% এর ক্ষেত্রে এটা শুরু হয় ৮ থেকে ১৪ বৎসরের মধ্যে। আমেরিকান ও ইউরোপিয়ান গবেষনায় দেখা যায় যে, শৈশবকালে সামাজিক পরিবেশে এদের মধ্যে লজ্জাবোধ কাজ করতো। তথাপি নিশ্চিতভাবে বলা যায় না যে শৈশবকালীন নেতিবাচক অভিজ্ঞতাই এই রোগের কারণ কিন্তু এগুলো ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে। এই ডিজঅর্ডার শৈশবকালে শুরু হতে পারে। প্রথম শুরুটা পূর্ণ বয়সে খুব কমই হতে দেখা যায়, তবে নতুন সামাজিক ভূমিকা পালন করতে গিয়ে এটা হতে পারে (যেমন- ভিন্ন সামাজিক শ্রেণির কাউকে বিয়ে করা, চাকুরীতে পদোন্নতি)। বংশগত প্রভাব এবং বংশগতি ও পরিবেশের পারষ্পরিক ক্রিয়াও এক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করতে পারে; যেমন- যে সমস্ত পিতা-মাতা সামাজিক ভাবে উদ্বিগ্ন থাকে সন্তানরা তাদেরকে অনুকরণ করতে পারে।
পরিশিষ্ট
সামাজিক যোগাযোগের জন্য প্রয়োজন হয় সামাজিক দক্ষতা ও যোগ্যতা। বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে মানুষ তা অর্জন করে। ভয়ে উদ্বেগে সংকুচিত এই মানুষগুলোর আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে ঔষধবিদ্যা ও মনোবিজ্ঞানের যথাযথ চিকিৎসা পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। পিতা-মাতা, অভিভাবক, শিক্ষক সহ সকল স্তরের মানুষের সচেতনতা, সাহায্য, সহানুভূতি, সহযোগীতাই পারে তাদেরকে সুন্দর এই পৃথিবীর সাথে স্বাভাবিক অভিযোজনে সহায়তা করতে।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।