‘নিরাপদ খেলার স্থান চাই’, শহরে ও গ্রামে সবখানে

আমার বাসা মগবাজার। গলির নাম ভদ্রগলি। গলিটি শুধু ভদ্রই না। আরো একটি বৈশিষ্ট আছে এই গলির, গলিটি অন্ধ! আমার বাসাটাই এই গলির শেষ মাথার, শেষ বাসা। গলিটি একেবারে ছোটও না। কয়েকটা বাঁকের কারণে এটাকে আরো বেশি বড় ও বিচ্ছিন্ন মনে হয়। রিক্সা-টিক্সা খবু বেশি আসে না। গলির মানুষও এই রাস্তাটাকে হাঁটার জন্য যথেষ্ট উপযুক্ত মনে করেন। সন্ধ্যার পর দুপাশের বাসার মায়েরা-মেয়েরা বেশ আরাম করেই হাঁটেন। গলির দুইদিকে বাসাও খুব বেশি না। পেছনের দিকে আট-দশটা, সামনের দিকে আরো কয়েকটা বাসা। ছোটছোট ছেলে-মেয়েরা নিশ্চিন্তে এই গলিতে খেলাধুলা করে।
আমার দুই ছেলে, তিন ভাগনে ও ওদের বন্ধু-বান্ধব সহ প্রায় আট-নয় জনের একটা দল। ওরা যখন তখন গলিতে নেমে যায়- বল খেলে, ক্রিকেট খেলে, সাইকেল চালায়। একজন নিচে নেমে অন্যদের ডাক দেয়, অন্যরা চলে আসে। পাশের বাসার দারোয়ান ছেলেটাও সবাইকে দেখে রাখে, খেয়াল রাখে। সুযোগ পেলে নিজেও ওদের সঙ্গে একটু আধটু খেলে। আশেপাশের বাসার সবাই বিষয়টি খেয়াল করে। আমরাও বিষয়টিকে এনজয় করি। সব মিলিয়ে, খারাপ না।
গলির মুখের দিকে, ছেলে-মেয়েদের আরও একটা দল আছে। ওরাও খেলে, সাইকেল চালায়। ঢাকা শহরের খেলাধুলা বা খেলার জায়গা ও নিরাপত্তা, এ সবকিছু বিবেচনায় বিষয়টা বেশ। আরো একটি মজার বিষয় হলো, কোনো কোনো সময় রাতেও ওরা খেলে। খেলতে খেলতে রাত নয়টা দশটাও বাজায়। বিকেলে অফিস থেকে ফেরার সময় আমিও ওদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে যাই, দেখি, একটু আধটু খেলিও। ওরা রাস্তায় না থাকলে মাঝেমাঝে আমি নিজেও ওদেরকে ডেকে নিয়ে আসি।

গতকাল অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে প্রায় সাড়ে-চারটার বেশি বেজেছে। আমার সঙ্গে আরো দুজন ছিলো, তাই এদিক সেদিক খেয়াল না করেই বাসায় ঢুকে যাই। খেতে বসি। তিন তলার বাসার দরজা খুলে তখনই আমাদের কাজের মানুষটি ঘরে ঢুকে। ‘বাস্তব’ আর ‘যোগ্য’, আমার দুই ছেলে। ওরা দুজন বাসায় আছে কিনা জানতে চায়। কাজের মানুষ মামুনের মা’কে আমরাও খালা ডাকি, বাচ্চারাও খালা ডাকে। এই খালার সঙ্গে ওদের বেশ মিল। মামুনের মা ওদেরকে বলে, ‘তোমরা আজকে খেলতে যাও নাই’? বাস্তব জানায়, একটু পর যাবে। মামুনের মাকে একটু চিন্তিতই মনে হলো আজ। এমনিতে এই মহিলা বাচ্চাদেরকে বেশ আদর করে। বাচ্চারাও তার কাছে থাকতে নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ অনুভব করে। কিন্তু মামুনের মা এরপর যা শোনায়, তা শোনে আমিও খানিকটা ‘থ’ মেরে যাই। মুখে কিছু বলিনি। চুপচাপ শুনি। কাহিনী শোনে আমার স্ত্রী, বাস্তবে’র মা বেশ ভয় পেয়েছে বলেই মনে হলো। সে বারবার শোনতে চায় কখন, কিভাবে, কে ছিলো? আর মামুনের মা জবাব দিতে থাকে।
আমি খাওয়া শেষ করে বারান্দায় যাই। বারান্দা থেকে গলির অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায়। কাউকেই বা কিছুই দেখতে পেলাম না। পাশের দারোয়ান ছেলেটাকে ডাকলাম। সে কিছু বলতে পারছেনা। আমি ফিরে এসে মামুনের মাকে জিজ্ঞেস করলাম। রাস্তায় তো কেউ নেই। মামুনের মা বললো, ‘না মামা। কাহিনী গলির মাতায়। আওনের সুম আমি নিজে দেইখা আইছি’। এই মামুনের মাকে নিশ্চিন্তে বিশ্বাস করা যায়। বিশ্বাস করিও। যদি সত্যিই এই ঘটনা হয়ে থাকে, তবে বিষয়টি দুশ্চিন্তার, সন্দেহ নেই।
আমি এ বিষয়ে একটুও চিন্তিত না, এমন একটি ভাব নিয়ে বাসায় আসা দু’জনের সঙ্গে কাজে বসে যাই। কিন্তু তখনো ভেতরে চলছে চিন্তা, প্রশ্ন! ছেলেরা কি রাস্তায় খেলবে না, সাইকেল চালাবে না? স্বস্থি পাচ্ছি না। মামুনের মাকে আবার ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, বলতো কি হয়েছে?
মামুনের মা আবার বলতে শুরু করলো, যা ছিলো এমন, ‘আমি আসার একটু আগের ঘটনা। একটি ছেলে গলিতে একাই সাইকেল চালাচ্ছিলো। ঐ সময় একটি অপরিচিত লোক এসে ছেলেটিকে বলে তোমার অন্যসব বন্ধুরা কোথায়? তখন ছেলেটি বলে- ওরা বাসায়। তারপর ঐ ছেলেটির একটি বন্ধুর নাম ধরে লোকটি বলে, ও তোমাকে ডাকছে সামনে। আমাকে সাইকেল চালিয়ে তোমাকে নিয়ে যেতে বলেছে। এ কথায় ছেলেটি রাজি হয় না। কিন্তু লোকটি আবার সাইকেল চায়। তখন ছেলেটি সাইকেল চালিয়ে বাসায় চলে আসার চেষ্টা করে। তখনই লোকটি ছেলেটির কাছ থেকে জোর করে সাইকেলটি কেঁড়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। বিষয়টি বুঝতে পেরে ছেলেটি কান্না শুরু করে। কিন্তু ততক্ষণে লোকটি লাপাত্তা।
ঘটনা শুনে আমার অনেক কিছু মনে হতে থাকে। এমন ভাবে তো আরো অনেক কিছু নিয়ে যেতে পারে। তাহলে কি আমাদের ছেলেরা খেলবে না (ফুটবল, ক্রিকেট), সাইকেল চালাবে না? আমি গতকালই বাস্তবকে একটা নতুন বল কিনে দিয়েছি। আগের বলটি লিক হয়ে যাওয়ায় বন্ধুরা ওর বল দিয়ে খেলছিল না। তাতে ওর রাগ ও প্রেস্টিজ। ‘আমি প্রতিদিন অন্যদের বল দিয়ে খেলি। আমার বল দিয়ে কেউ খেলে না। তুমি আমাকে বল কিনে দাওনা কেন’? গতকালই কিনেছি, লাল আর কমলা রঙে মিশানো একটা বল। ও নিজে পছন্দ করে কিনেছে। ছোট ছেলের, মানে যোগ্যর রিক্সা মার্কা সাইকেলের পিছনের একটা অংশ খুলে গেছে। সেটাও ঠিক করার কথা। নিউমার্কেট নিয়ে যাওয়ার কথা। তাহলে কি এসবের প্রয়োজন নেই? ঘরের ভিতর খেলবে? আর মোবাইল নিয়ে সারাদিন….।
রাতে বাসায় ফেরার সময় ওরা সজাগ থাকলে ওদের সঙ্গে আমি খেলি বন্দুক, বল, গাড়ি এসব নিয়ে। তাহলে কি তারা সারাদিন এসব নিয়েই খেলবে? গতরাতে বাসায় ফিরে দেখি, বাস্তব ঘুম। যোগ্যর সঙ্গে খেলতে খেলতে ঠিক করলাম। না, ভয় পাবোনা। ওরা খেলবে, ওরা নিচেই খেলবে। রাস্তায়, গলিতে খেলবে। বাসায় বসে সারাদিন মোবাইল আর টিভি…, না এটা ঠিক হবে না। সামান্য এই গলির খেলাটুকুও বন্ধ করা উচিত হবে না। কি কি ভাবে সেটা চালিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় সেটা দেখতে হবে। অনেক চিন্তা আসলো মনে। আজ বাসায় যাওয়ার সময় সম্পূর্ণ ঘটনাটা আবার শুনার চেষ্টা করবো। আসলে কি ঘটেছে? কি কি করলে ছেলেরা দিন-রাত যখন-তখন ক্রিকেট ফুটবল খেলতে পারবে। সাইকেল চালাতে পারবে। নিশ্চিন্তে হাঁটতে পারবে।
অনেক কিছুর ভিতর একটা কথাই মনে আসলো, ফেসবুকে ছোট্ট করে একটা স্ট্যাটাস দেই। ‘নিরাপদ খেলার স্থান চাই’, শহরে ও গ্রামে সবখানে। কেউ যদি একটি স্টিকার বানিয়ে দেয়, তবে সেটা প্রোফাইলে কয়েকদিন রাখা যাবে। আমাদের ছেলে মেয়েরা নিরাপদে খেলবে, সাইকেল চালাবে, আমিও ওদের সঙ্গে সময় কাটাবো। না, কিছুতেই এই অন্ধ ও ভদ্র গলির খেলা বন্ধ করা যাবেনা।

Previous articleআমার স্বামী মানসিক রোগী, ঘুমের মধ্যে কান্নাকাটি করে
Next articleধর্মপালনকারী কিশোররা প্রাপ্তবয়সে বেশি সুখী হয়
অধ্যাপক ডা. সালাহ্উদ্দিন কাউসার বিপ্লব
চেয়ারম্যান, মনোরোগবিদ্যাি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here