দাম্পত্য সম্পর্ক ঠিক না থাকলে জীবনে চরম মূল্য দিতে হয়

0
162
দাম্পত্য সম্পর্ক ঠিক না থাকলে জীবনে চরম মূল্য দিতে হয়

সৃজনী আহমেদ
সহকারী অধ্যাপক, মানসিক রোগ বিভাগ
ঢাকা কমিউনিটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, মগবাজার, ঢাকা।

দৃশ্যপট ১: ভদ্রলোক দীর্ঘক্ষণ চেম্বারে বসে আছেন একটা কাঁচুমাচু ভংগীতে। অভয় দিতে উনি প্রশ্নটা করলেন যে, উনার মেয়েটাকে বিয়ে দিলে সেরে যাওয়ার সম্ভাবনা কেমন। উনার কন্যাটির বয়স ১৬—১৭র দিকে। হিস্টিরিয়া নামক রোগটিতে আক্রান্ত কন্যাটির জন্য আত্মীয়স্বজনের আন্তরিক শুভাকাংক্ষা মিশ্রিত উপদেশ “বিয়া দাও, মাইয়া ভালা হইবো”— উনি আর অগ্রাহ্য করতে পারছেন না। তার ওপর ইদানিংকালে পরদেশে ‘ভালো চাকরী’ওয়ালা পাত্রের সন্ধান আসাতে ‘কন্যার বাপের সবুর’ আর থাকার উপায় নাই। এমন ক্ষেত্রে বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে এই রোগের বিয়ে পরবর্তি ফলাফল বুঝিয়ে বললাম। যদিও এই সাক্ষাতের এক মাসের মধ্যে বিয়ের দাওয়াতটিও চলে আসলো।

Magazine site ads

দৃশ্যপট ২: সন্তান জন্মদানের সময় প্রচন্ডরকম উগ্র মেজাজ, অনেক কথা বলা, মারামারি, প্রচুর খরচ করা, একেবারেই না ঘুমানো; এরকম লক্ষণ নিয়ে মানসিক বিভাগে ভর্তি হয় লতিফা (ছদ্মনাম)। ইতিহাস নিয়ে জানতে পারলাম বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডারে ভুগছেন তিনি। বিয়ের পর থেকেই ওষুধগুলো বন্ধ ছিলো, গর্ভাবস্থায় এই রোগটির তীব্রতা চরম আকার ধারণ করেছে। অথচ মা এবং একবোন বার বার চিকিৎসককে অনুরোধ করতে ব্যস্ত যে, স্বামী যেন রোগের বিষয়ে জানতে না পারেন। উপরের চিত্রদুইটি মানসিক রোগের ক্ষেত্রে দাম্পত্য সম্পর্কের ভূমিকার সাধারণ ধারণার দুইটি খন্ডচিত্র। দুই ক্ষেত্রেই রোগ সম্পর্কে জানাবোঝা, পারিবারিক সহযোগীতার চেয়ে ‘বিয়ে হওয়া’ এবং যেভাবেই হোক বিয়ে ‘টিঁকিয়ে রাখা’কে গুরুত্ব দেয়াটা লক্ষণীয়। কিন্তু বাস্তবে আসলে কীরকম হয় দাম্পত্য সম্পর্ক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের মিথস্ক্রিয়া।
দাম্পত্য জীবন যখন পারস্পরিক সহযোগীতা, শ্রদ্ধা, সহমর্মিতা, ভালোবাসা এরকম উপাদানে ভরপুর থাকে, নিজেদের মধ্যে বাধাহীন এবং শংকাবিহীনভাবে আদান—প্রদানের সুযোগ থাকে, তখন দম্পতির উভয়েরই মানসিক স্বাস্থ্য অনেক ইতিবাচক থাকে। এই অবস্থায় তারা হাসিখুশি থাকেন, চাপ মোকাবিলা করতে পারেন সহজে বা ইতিবাচকভাবে। অনেক সহমর্মী থাকেন, একাকীত্বে ভুগেন না, মানসিক এবং সামাজিকভাবে অনেক বেশি সক্রিয় এবং সংঘবদ্ধ অনুভব করেন। বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে যে, এইরকম ইতিবাচকতাপূর্ণ দাম্পত্য সম্পর্কে থাকা দম্পতি একলা থাকা নারী—পুরুষ, বিচ্ছিন্ন থাকা দম্পতি, বিবাহবিচ্ছেদে থাকা দম্পতিদের তুলনায় শারীরিক,মানসিক, এবং আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে অনেকটাই ইতিবাচক এবং শক্তিশালী অবস্থানে থাকেন।

কিন্তু মুদ্রার উল্টোপিঠটাও লক্ষণীয়। বিবাহিত জীবনে দীর্ঘমেয়াদী জটিলতা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। ২০১৪ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যারা অন্যান্য যেকোনো সামাজিক সম্পর্কের (বন্ধুত্ব, সহকর্মী) তুলনায় দাম্পত্য সম্পর্কের প্রভাব মনোজগতে ব্যাপক এবং গভীর। যারা অসুখী দাম্পত্যজীবনে থাকেন তাদের মধ্যে বিপরীত চিত্র পাওয়া যায়। দাম্পত্য সম্পর্কে দীর্ঘমেয়াদী বোঝাপড়ার অভাব থাকলে, একে অপরের প্রতি সন্তুষ্টি, সহমর্মীতা, সহযোগিতা না থাকলে, শারীরিক—মানসিক নির্যাতন থাকলে সেটা বিভিন্ন মানসিক সমস্যা তৈরীর একটা কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে বিষণ্ণতা রোগ তৈরীর ক্ষেত্রে দাম্পত্য জীবনের নেতিবাচক মন্তব্য, শারীরিক—মানসিক নির্যাতন— এগুলো একটা বড়ো রকমের প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যাদের দাম্পত্য সম্পর্কে সমস্যা বিদ্যমান, তাদের জীবনে কোনো ইতিবাচক ঘটনা/ সুন্দর ছবি/ সুন্দর দৃশ্যর প্রতি মনোভাব খুব ক্ষনস্থায়ী, অর্থাৎ সুখানুভূতি তাদের বেশিক্ষন স্থায়ী হয় না এবং এই বিষয়টি তাদেরকে বিষণ্ণতার দিকে ঠেলে দেয়।

মনের খবর ম্যগাজিনে

একদম মানসিকভাবে সুস্থ ব্যক্তিও যেমন দাম্পত্য জীবনের নেতিবাচক প্রভাবের ফলে মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারেন, সেরকম পূর্বেই মানসিক সমস্যা রয়েছে এরকম ব্যক্তির ক্ষেত্রেও বাড়তি সমস্যা দেখা দিতে পারে। স্বামী—স্ত্রীর কেউ যদি অপরজনের মানসিক রোগের বিষয়ে অসহযোগীতাপূর্ণ মনোভাব রাখেন এবং আচরণের ক্ষেত্রে সহমর্মীতা না থাকে তাহলে মানসিক রোগের চিকিৎসা গ্রহণ ব্যহত হয়, সঙ্গীর মানসিক রোগের তীব্রতা বেড়ে যায় এবং আরো বেশি দাম্পত্য সম্পর্ক ব্যহত হতে থাকে।
দাম্পত্য সম্পর্কের সাথে মানসিক স্বাস্থ্যের সম্পর্কের আরেকটি দিক হচ্ছে, মানসিক স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে দাম্পত্য জীবনে সন্তুষ্টি এবং পারস্পরিক বোঝাপড়া ব্যহত হয়। তাই দম্পতির উভয় সদস্যের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকাটাও গুরুত্বপূর্ণ।

আবার দাম্পত্য সম্পর্ক শুরুর বয়সটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। কৈশোরকালীন বিয়েতে পারস্পরিক বোঝাপড়া থাকে শূন্যের কোঠায়। অপরিণত বয়সে বিয়ে নারীদের ক্ষেত্রে বিষণ্ণতা, মানসিক চাপজনিত রোগের ক্ষেত্র তৈরী করে। পুরুষদের মধ্যেও মানসিক চাপজনিত রোগ দেখা যায়।
পাঠক হয়তো এতক্ষনে ভাবছেন, এইসবতো জানা কথা। এই কথাগুলো কেন চর্বিত চর্বন করছি। কারণ হচ্ছে, আমাদের দেশে বিয়েটাকে মানসিক রোগের চিকিৎসা হিসেবে দেখা হয়। মানসিক রোগাক্রান্তকে দ্রুত বিয়ে দেয়ার মাধ্যমে একরকমের নির্ভরতার স্থান তৈরি করতে চান অভিভাবকগণ। এর ফলাফল অনেকাংশেই হয় মারাত্মক। দেখা যায়, মানসিক রোগাক্রান্ত মানুষটি নারী—পুরুষ নির্বিশেষে এই দোষের ভাগীদার হন— “পরিবার মাথা খারাপের কথা গোপন করে বিয়ে করাইছে”। চিকিৎসা মারাত্মকভাবে ব্যহত হয়। অনেক ক্ষেত্রে খুব খারাপভাবে বিবাহবিচ্ছেদ হয়। এর ভেতরে যদি আরেক ধাপ এগিয়ে সন্তানধারণও হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে সন্তানদের জীবনেও নেমে আসে দুর্দশা। পুরুষের ক্ষেত্রে তবু সামাজিক অবস্থান কিছুটা তাদের পক্ষে গেলেও নারীদের অবস্থা হয় শোচণীয়। তারা চাকরীবিহীন, পৈত্রিক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত অবস্থায় দিনাতিপাত করতে বাধ্য হন।

আবার বিবাহিত জীবনে সঙ্গীর মানসিক রোগকে চিহ্নিত করা এবং চিকিৎসার চেষ্টা করাকে দোষণীয় কাজ হিসেবে দেখা হয়, অথবা এটাকে সঙ্গীর দোষ হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই মানসিক রোগের চিকিৎসা বরং সফল দাম্পত্য জীবনের জন্যই প্রয়োজন। যেমন— ডিল্যুশনাল জেলাসি বা ওথেলো সিন্ড্রোম একটি রোগ আছে। এই রোগে সঙ্গীর প্রতি অযাচিত সন্দেহ থাকে। এই রোগাক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা না করানো হলে দাম্পত্য জীবনে চরম অশান্তি বিরাজ করে। সন্তান থাকলে তাদের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাই অভিযুক্ত সঙ্গীর নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টায় সময় না পার করে বরঞ্চ আক্রান্তের চিকিৎসা জরুরী।
এছাড়াও সমাজে প্রচলিত আছে বুদ্ধি প্রতিবন্ধীতা, সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত নারী—পুরুষের বিয়ে দিয়ে রোগ সারানোর চেষ্টা, মাদকাসক্তির ক্ষেত্রে বিয়েটাকে চিকিৎসা হিসেবে দেখা এবং স্বামীর মাদকাসক্তি না ‘ঠিক করতে’ পারার দায়ে স্ত্রীকে রীতিমতো দোষারোপ করা। অথচ দম্পতির একজনের মানসিক রোগের জন্য অপরজন বিয়ের পরপরই কিন্তু অগ্রসর হতে পারেন না। কারণ এই রোগগুলো পারস্পরিক বোঝাপড়া তৈরী হওয়ার ক্ষেত্রই নষ্ট করে। তাই মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য সঙ্গী কীভাবে এগিয়ে যাবেন সেটাই ঠিক করে উঠতে পারেন না। তখন সংসার জীবনে নানা অশান্তি চলতে থাকে এবং সঙ্গীও ক্রমান্বয়ে বিষণ্ণতা, উদ্বিগ্নতায় ভুগতে থাকেন। যেমন— বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডারে ম্যানিক অবস্থায় অস্বাভাবিক যৌন চাহিদা থাকে। এই অবস্থায় ‘বিয়ে করার’ একটা ঝেঁাক রোগীর মধ্যে দেখা যায়। এই অবস্থায় রোগীকে বিয়ে দেয়ার পর একসময় যখন ম্যানিক অবস্থা কেটে যায় তখন দাম্পত্য সম্পর্ক নিয়ে আর আগ্রহ থাকে না বা সেটাকে বোঝা মনে হয়। এদিকে সঙ্গী পড়ে যায় বিপদে। আবার অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের সমাজে কিশোরীদের বিয়ে দেয়ার একটা প্রবণতা আছে। এই বাল্য বিবাহ এবং তার পরবর্তি অপরিণত অবস্থায় সন্তানধারণ শারীরিক— মানসিকভাবে রীতিমত ভঙ্গুর করে দেয় সেই মাকে। এই মায়েরা সন্তান লালন—পালনের ক্ষেত্রেও অনেক প্রতিকূলতার শিকার হন, এবং সন্তানদের মধ্যেও মানসিক সমস্যা দেখা যায়।
আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় দম্পতির একে অপরের সহযোগীতায় মানসিক রোগের চিকিৎসায় অনেক ভালো ফলাফল আসে।

কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য, প্রাধান্য দেবার এখনই সময়দাম্পত্য সম্পর্ক অত্যন্ত মূল্যবান সম্পর্ক। এই সম্পর্ক অনেকটা চারাগাছের মতো, যেটাকে রোদ—পানি—সার দিয়ে যত্ন করা প্রয়োজন হয়। ে¯্রফ জৈবিক চাহিদা মেটানো বা সামাজিকভাবে একটা সাইনবোর্ড হিসেবে থাকা দাম্পত্য সম্পর্কের নেতিবাচক প্রভাব অনেক গভীর। শুধু ব্যক্তি না, এর প্রভাব পড়ে সমাজেও। অসুখী দাম্পত্য জীবন যখন খিটখিটে মেজাজ, বিষণ্ণতা এনে দেয়; তখন কর্মস্থলে কর্মক্ষমতা ব্যহত হয়, সন্তান লালনপালনে সমস্যা দেখা দেয়, দম্পতির শারীরিক এবং মানসিক চিকিৎসার জন্য সময়, শ্রম এবং অর্থনৈতিক চাপ দেখা দেয়।

তাই সুস্থ মনে, দায়িত্বশীল অবস্থায় দাম্পত্য জীবন শুরুর সিদ্ধান্ত গ্রহণের সচেতনতা তৈরি হওয়ার সামাজিক সচেতনতা গড়ে উঠুক এই আশাবাদ রইলো।

আরও দেখুন- 

Previous articleসিজোফ্রেনিয়াতে যৌন সমস্যার আধুনিক চিকিৎসা
Next articleবয়ঃসন্ধিকালে ইতিবাচক পারিবারিক সম্পর্ক ডিপ্রেশনের ঝুঁকি কমায়

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here