শিশুদের মানসিক সমস্যা : চিকিৎসা নেবেন কখন?

0
101
শিশুদের মানসিক সমস্যা : চিকিৎসা নেবেন কখন?

অনেকের মধ্যে একটি প্রচলিত ধারণা আছে শিশুদের মানসিক সমস্যা আবার কী? যদিও বড়োদের মতো শিশুরাও বিভিন্ন মানসিক সমস্যায় ভুগে থাকে। শারীরিক অন্যান্য সমস্যার মতো মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হলে সঠিক কাউন্সেলিং ও চিকিৎসায় পুরোপুরি আরোগ্য লাভ করা যায়। কিন্তু শারীরিক বেদনার মতো জটিলতা তৈরি না হওয়ায় অনেকেই বুঝতে পারেন না, কখন আসলে তাদের চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। মানসিক, পারিবারিক বা সামাজিক নানা ট্যাবুও এক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

শিশুদের প্রধান মানসিক সমস্যা

  • অটিজম বা ভাবের আদান-প্রদানে সমস্যা
  • অতি চঞ্চলতা ও মনোযোগহীনতা
  • তর্ক করা
  • অতিরিক্ত রাগ, জেদ, ভাঙচুর করা
  • তোতলামি ও পঠনে সমস্যা
  • লেখাপড়ায় অনীহা বা অমনোযোগিতা
  • স্কুল পালানো, স্কুলভীতি
  • লেখাপড়ায় ক্রমাবনতি
  • স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ করা
  • নিরীহ মানুষ, পশু-পাখির সঙ্গে রূঢ় আচরণ করা
  • অবাধ্য হওয়া, মিথ্যা বলা
  • ক্রমাগত হুমকি প্রদান ও ভীতি প্রদর্শন করা
  • আগুন লাগিয়ে আনন্দ করা
  • বিছানায় প্রস্রাব করা
  • আত্মঘাত বা নিজেই নিজেকে আঘাত ও কষ্ট দেওয়া।

একটু তর্ক করা, একটু দুষ্টুমি, এগুলো কিন্তু সব বাচ্চার মধ্যেই থাকবে, এর মানে এই নয়, যেকোনো বাচ্চার মধ্যে একটু চঞ্চলতা দেখলেই বলব হাইপার অ্যাকটিভ, একদিন না বলে কিছু নিয়েছে, একবার দুবার মিথ্যা বলেছে তো কন্ডাক্ট ডিজঅর্ডার। এই সমস্যাগুলোর মানেই যে তার মানসিক রোগ হবে, তা নয়। তবে এসব উপসর্গ বা লক্ষণ দেখা গেলে একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলা উচিত। তাঁরা সেটা বিশ্লেষণ করে বুঝতে পারবেন যে, এখানে আসলে কোনো ব্যবস্থা নেয়া উচিত কিনা। আমাদের সবার মধ্যে কিছু কিছু আচরণের অস্বাভাবিকতা থাকতে পারে। সেটা হলেই সবাইকে মানসিক রোগী বলা যাবে না। কিন্তু তার এই মনের অবস্থার কারণে যদি তার স্বাভাবিক বা প্রাত্যহিক কর্মকান্ড ব্যাহত হতে থাকে তখনই বুঝতে হবে যে, সে হয়ত মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। শিশুদের স্নায়ুশক্তি সুনিয়ন্ত্রিত ও সুগঠিত নয়। তারা অতি সহজেই ভয় পায়, অভিভূত হয়। মাতৃগর্ভে ভ্রুণ সৃষ্টির সময় পিতা-মাতার তৎকালে বিদ্যমান মানসিক কিছু পরিস্থিতির খানিকটা জিনগতভাবে শিশুরা অর্জন করে থাকে। শারীরিক অনেক সমস্যা সব শিশুরা প্রকাশ করতে পারে না। তাই শিশুরা অনেক ধরনের মানসিক রোগে ভুগে থাকে। ওপরে বর্ণিত সমস্যাগুলোর অধিকাংশই মানসিক ও স্নায়ুরোগ বিশেষ। কিছু কিছু অসুবিধা স্বল্পতম সময়ে উপশম হয়, কিছু আবার বেশ সময় লাগে এবং কিছু সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়। যেগুলো উপশম পেতে সময় লাগে সেগুলোর বিষয়ে অভিভাবকদের চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। তা না হলে পরবর্তী জীবনে শিশুরা দীর্ঘমেয়াদি সমস্যায় ভুগতে পারে।

কেন মানসিক সমস্যার চিকিৎসা প্রয়োজন?

মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি নিজে কষ্টে থাকার পাশাপাশি তার পরিবারও তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ও কষ্টে থাকে। রাগ, জেদ করা, তুচ্ছ ঘটনাকে জটিল করে দেখা, সন্দেহ করা ইত্যাদির কারণে প্রায়ই কাছের মানুষের সঙ্গে মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত রোগীর সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যেতে পারে। মানসিক রোগ হলে ব্যক্তির লেখাপড়া ও পেশাগত কাজ করতে অসুবিধা হয়। যার কারণে ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়। ব্যক্তি নিজেই শুধু আর্থিকভাবে দুর্দশার মধ্যে পড়ে না বরং পরিবার এমনকি দেশের জিডিপির ওপর তার একটি প্রভাব পড়ে। একজন নাগরিককে তৈরি করতে রাষ্ট্রকে অনেক অর্থ খরচ করতে হয়। সেই নাগরিকের কাছে রাষ্ট্রের প্রত্যাশাও থাকে। কিন্তু মানসিক রোগের কারণে তা না করতে পারলে কিংবা সে আত্মহত্যা করলে ব্যক্তি নিজে, তার পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই মানসিক রোগকে অবহেলা না করে, লুকিয়ে না রেখে, তথাকথিত লোকলজ্জার ভয় কাটিয়ে বৈজ্ঞানিকভাবে চিকিৎসা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

চিকিৎসা

মানসিক রোগ শারীরিক ও সামাজিক নানা কারণেই হতে পারে। এর চিকিৎসাও হতে হয় বায়ো-সাইকোসোশ্যাল মডেল অনুযায়ী। অর্থাৎ মানসিক রোগের ক্ষেত্রে ওষুধ ও সাইকোথেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা করা হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, ওষুধ ও সাইকোথেরাপির সমন্বিত চিকিৎসায় সবচেয়ে ভালো ফলাফল লাভ করা যায়। তবে কিছু রোগে ওষুধের ভূমিকা মুখ্য আবার কিছু রোগে সাইকোথেরাপি অত্যাবশ্যকীয়। তবে চিকিৎসা গ্রহণ করার জন্য সাইকিয়াট্রিস্ট বা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের প্রশিক্ষণ সম্পর্কে ভালো করে জেনে নিতে হবে। আপনার শিশুর মধ্যে যদি ওপরোক্ত লক্ষণগুলো হতে একাধিক লক্ষণ দেখতে পান তবে দেরি না করে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হোন। উপযোগী কাউন্সেলিং এবং অল্প কিছু ওষুধ আপনার শিশুকে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ থেকে উদ্ধার করতে পারে। মনোরোগ অন্য সব রোগের মতো একটি রোগ যা সময়মতো চিকিৎসা করলে সম্পূর্ণ সুস্থতা পাওয়া সম্ভব। লোকলজ্জা, ভয়, সামাজিক গোঁড়ামি বা অজ্ঞতায় থেকে নিজের সন্তানের বিপদ বৃদ্ধি করবেন না। প্রতিটি শিশুর জীবন হোক সুন্দর, নিরাপদ ও আনন্দদায়ক, এই প্রত্যাশা আপনাদের কাছে।

ডা. হোসনে আরা

সহকারী অধ্যাপক, মনোরোগ বিদ্যা বিভাগ,

আদ-দীন মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল, ঢাকা।

সূত্রঃ মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিন, ৪র্থ বর্ষ, ৫ম সংখ্যায় প্রকাশিত।   

স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে   

 

“মনের খবর” ম্যাগাজিন পেতে কল করুন ০১৮ ৬৫ ৪৬ ৬৫ ৯৪
Previous articleচট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালিত
Next articleসন্তানের যৌনস্বাস্থ্য কী করবেন মা?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here