করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব সারা পৃথিবীকে থমকে দিয়েছে। থমকে গেছে বিশ্ব অর্থনীতি। অন্যান্য দেশের পাশাপাশি আমাদের দেশেও লকডাউন চলছে। ফলে গৃহবন্দী সকল মানুষ। সুস্থভাবে বাঁচতে লড়াই করে চলেছে বিশ্ববাসী। এমন অবস্থাকে বিবেচনা করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, এই দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, মহামারী মোকাবিলায় সকলে নিজেকে গৃহবন্দী অবস্থায় রেখেছেন ঠিকই, কিন্তু যারা নিয়মিত কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, যারা ভ্রমণপিয়াসু তাদের ক্ষেত্রে লকডাউনটা খুব কঠিন সময়। বিশেষ করে বাচ্চা এবং বয়স্ক মানুষদের ক্ষেত্রে এক জায়গায় থাকতে থাকতে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপর খারাপ প্রভাব পড়তে থাকে। নিজস্ব স্বাধীনতা, সামাজিক ক্রিয়াকলাপ, বাইরের তাজা আলো-বাতাস ইত্যাদি থেকে দূরে থাকতে থাকতে মানুষ একাকী হয়ে ওঠে। এখন প্রশ্ন কেন কীভাবে রোধ করবেন মানসিক সমস্যাগুলোকে? চলুন তবে জেনে নেওয়া যাক।
কোয়ারেন্টিন যেভাবে মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে
মহামারী চলাকালীন অনেকগুলো অনিশ্চয়তা মাথায় চলতে থাকার ফলে কিছুটা হলেও মানসিক চাপের সৃষ্টি হয়। কোয়ারেন্টিন মানসিক স্বাস্থ্যের দুটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যথা – মানসিক সুস্থতা এবং সামাজিক সুস্থতার উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। এক জায়গায় সমস্ত কিছু সীমাবদ্ধ থাকার ফলে নিজেদের মানসিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি শারীরিক স্বাস্থ্য যেমন – শারীরিক দুর্বলতা, ঘুম কমে যাওয়া, হৃদ স্বাস্থ্যের অবনতি এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।
দ্য ল্যানসেট জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, যারা কোয়ারেন্টিনে ছিলেন তারা নানাবিধ মানসিক অসুস্থতাযুক্ত লক্ষণগুলোর কথা জানিয়েছেন। যার মধ্যে হতাশা, মানসিক চাপ, অল্পতে রেগে যাওয়া, অনিদ্রা, বিরক্তিভাব, মানসিক অশান্তি, পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস সিমটম-এর কথা উল্লেখ রয়েছে।
অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০৩ সালে ঘটে যাওয়া সার্স ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে এই ধরনের মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা দেখা দেয়। প্রায় ১০ শতাংশ মানুষ ট্রমা পরবর্তী অবসাদ জনিত লক্ষণ সমূহের (Post-Traumatic stress Symptoms) শিকার হয়েছিলেন। সার্স ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব কমে যাবার পরেও প্রায় তিন বছর এই ধরনের মানসিক প্রভাবগুলি দেখা দিয়েছিল। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, যাদের সাইকোলজিক্যাল সমস্যা আগে থেকে আছে তাদের ক্ষেত্রে এই ধরনের সমস্যা বেশি দেখা যায়।
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দূর করার উপায়
- নিজেকে দিনভর সচল রাখুন।
- নেতিবাচক চিন্তা ভাবনা দূর করতে গান শুনুন, বই পড়ুন, ছবি আঁকুন, ফুলের বাগান তৈরি করুন এবং বিনোদনমূলক কিছু দেখার চেষ্টা করুন।
- প্রচুর পরিমাণে পানি পান এবং সুষম খাদ্য গ্রহণ করুন।
- বয়স্ক মানুষেরা মৃত্যু ভয়ে ভুগতে পারেন, সেক্ষেত্রে তাদের সঙ্গে সময় কাটান এবং তাদের কথা শুনুন।
- বাচ্চাদের এমনভাবে ব্যস্ত রাখুন যাতে তারা উদাস এবং একাকীত্বে না ভোগে।
- যদি আপনি উদ্বেগ অনুভব করেন তবে কয়েক মিনিটের জন্য শান্তভাবে বসে গভীর শ্বাস- প্রশ্বাস নেওয়া ও ছাড়ার অনুশীলন করুন।
- অপ্রয়োজনীয় চিন্তা থেকে নিজেকে দূরে রাখুন। মনকে শান্ত রাখতে এটি করা অত্যন্ত প্রয়োজন।
- যদি আপনি রাগ এবং বিরক্তবোধ করেন তবে পেছন থেকে সংখ্যা গোনা অর্থাৎ ১০ থেকে ১ পর্যন্ত গণনা করে মনকে শান্ত করুন।
- আপনি যদি একাকীত্বে ভোগেন তবে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটান, পাশাপাশি বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করুন।
- কারণ ছাড়া অযথা আতঙ্কিত হবেন না। ভুল বা জাল তথ্য বহন করা চাঞ্চল্যকর সংবাদ বা সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টগুলো থেকে দূরে থাকুন।
- কে অসুস্থ হলেন, কতজন অসুস্থ হলেন এবং কীভাবে হলেন সে সম্পর্কে সবসময় আলোচনা করা বন্ধ করুন।
- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া স্বাস্থ্যবিধি অনুশীলন করুন।
- তামাক, অ্যালকোহল এবং অন্যান্য ড্রাগ সেবন করা এড়িয়ে চলুন, কারণ এই সময়ে দাঁড়িয়ে এগুলো আপনার মানসিক স্বাস্থ্যকে আরও খারাপ করতে পারে।
- আপনি যদি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হন তবে আতঙ্কিত হবেন না। মনের জোর বজায় রাখুন, মনে রাখবেন এই রোগে বেশিরভাগ মানুষই সুস্থ হয়ে উঠছেন।
- সকাল এবং সন্ধ্যায় কিছু শারীরিক যোগ ব্যায়াম ও মেডিটেশন করুন।
- একা না থেকে, পরিবারের সকলের সঙ্গে সময় কাটান। দিনগুলো ভালোভাবে উপভোগ করুন।
ওপরের বর্ণিত সমস্যাগুলো যদি কোনোভাবেই দূর করতে না পারেন তবে অবিলম্বে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরামর্শ করুন।
মহামারীকে রোধ করতে হবে আমাদের সকলকে মিলেমিশে। তাই আসুন না, নিজেদের মতো করেই ভাবি। লকডাউন বা কোয়ারেন্টিনকে আপন করে নিই সকলে। ভাববো না কতদিন বাড়িতে থাকতে হবে, তবে এটা ভাববো যে মহামারী থেকে বাঁচতে বাড়িতে থেকে নিজেকে সুস্থ রাখার পাশাপাশি পরিবারকে সুস্থ রাখব। কর্মসূত্রে যে পরিবার, সন্তান, বাড়ির বয়স্ক মানুষদের সময় দেওয়া হতো না, এই সেই সুযোগ একত্রিত হয়ে সবার সঙ্গে সময় কাটানোর। এভাবেই যদি থাকতে পারেন দেখবেন মানসিক সমস্যা আপনার কাছেও ঘেঁষতে পারবে না। এই সমস্যা মোকাবিলার সর্বোত্তম উপায় হল নিজেকে বাড়ির ক্রিয়াকলাপে জড়িত রাখা, ইতিবাচক চিন্তা ভাবনা এবং সবার সঙ্গে সময় কাটানো।