নীতিনির্ধারকরা কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় ম্যালেরিয়ার ঔষধ ব্যাবহারে দ্বিধা-বিভক্ত হয়ে পরেছেন। আমেরিকা এবং ফ্রান্সের কর্তৃপক্ষ কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় ক্লোরোকুইন এবং হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের ব্যবহারকে স্বীকৃতি দিয়েছেন অন্যদিকে ইউরোপীয় কর্তৃপক্ষ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে তাদের এই সিদ্ধান্ত বিজ্ঞান সম্মত নয়।
পর্যাপ্ত, অনুমোদিত এবং সহজলভ্য কোন বিকল্প না থাকায়, আমেরিকার FDA, কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় ম্যালেরিয়ার ঔষধ ক্লোরকুইন এবং হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের ব্যবহারে সম্মত হয়েছে।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সুপারিশক্রমে, গত সপ্তাহে FDA-এর Emergency Use Authorisation(EUA) (বা জরুরী অবস্থায় ব্যবহারের অনুমোদন) জারি হয় যা চিকিৎসকদের এই ঔষধ ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছে, যদিও কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় ঔষধ দুটির কার্যকারীতার পরীক্ষালব্ধ জোরালো কোন প্রমান এখনও হাতে নেই। তদুপরি, ঔষধ দুটির ব্যবহারে কিছু মারাত্মক পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সিদ্ধান্তটি নেবার আগে সাধারনত ঔষধ অনুমোদনের স্বীকৃত প্রক্রিয়াগুলো (যেমন ডাবল ব্লাইন্ড, প্লাসিবো-কন্ট্রোল্ড ক্লিনিকাল ট্রায়াল) অনুসরণ করা হয় নি। তাই কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় ঔষধগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে বিশ্বব্যাপী বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।
আমেরিকা মহামারীর কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত নিউইয়র্কের কুইন্স শহরের এলমহার্স্ট হাসপাতালের বিশ্ব স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক এবং সক্রমক ব্যাধি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ জোসেফ মাসকি বলেন “আমি মনে করি, অধিকতর হতাশা থেকেই এটি অবলম্বন করা হয়ছে। এটা মহামারীর আকস্মিকতা এবং ব্যপকতার শুধুমাত্র একটা ইঙ্গিতমাত্র।“
মার্কিন স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মার্চের শুরুর দিকে কোভিড আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১০০ জন, আর এ রোগে মৃতের সংখ্যা ছিল মাত্র ১০ জন। কিন্তু প্রায় এক মাস পর, কোভিড ট্র্যাকিং প্রকল্পের আওতায় স্টেট এবং ফেডারেল সরকারের ৭ এপ্রিলের তথ্যমতে, মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৩৬৩,০০০ এর বেশি এবং ১০, ৮৪৭ জন মারা গেছে।
এলমহার্স্ট হসাপাতলটি (৫৪৫ শয্যার) হচ্ছে “Health and Hospital Corporation” নামক সরকারী হাসপাতেলের নেটওয়ার্কের আওতাধীন ১১ টি হাসপাতেলের মধ্যে অন্যতম। মাসকি বলেন, এলমহার্স্টে চিকিৎসাধীন প্রায় শতাধিক কোভিড-১৯ রোগীর ব্যবস্থাপনায় অন্যান্য চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার সাথে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন প্রয়োগ করা হয়েছিল। উল্লেখ্য, হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ক্লোরোকুইনের চেয়ে তুলনামুলকভাবে কম।“ তিনি আরো বলেন যে চিকিৎসার কোর্সটি ৫ দিন যাবত চলে এবং এখন পর্যন্ত এই চিকিৎসায় প্রাপ্ত ফলাফল মিশ্র।
EUA অনুযায়ী, হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন এবং ক্লোরোকুইন শুধুমাত্র হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কোভিড-১৯ এর রোগীর চিকিৎসায় ব্যবহার করা যাবে। আরোও উল্লেখ্য যে, কিশোর এবং প্রাপ্ত বয়স্ক রোগীর উপর এই ঔষধগুলো প্রয়োগ করা যাবে। একইসাথে এদের ওজন অবশ্যই ৫০ কেজির উপরে হতে হবে, যারা কোনরকম ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে অংশ নিতে সক্ষম এবং যাদের সম্মতি আছে।
বহুবছর যাবত অটো-ইমিউন রোগ যেমন লুপাস, রিউম্যাটয়েড আরথ্রাইটিস এ আক্রান্ত রোগীরা এই ঔষধগুলোর উপর নির্ভরশীল। এদের চিকিৎসায় যেন কোণ ব্যাঘাত না ঘটে, তাই, EUA মতে, এসব ঔষধ অবশ্যই রাষ্ট্রীয় ঔষধাগার থেকে সংগ্রহ করতে হবে যাতে ঔষধগুলোর যথাযথ সরবরাহ নিশ্চিত হয়। EUA জারির তিন দিন পরই, সংস্থাটি উভয় ঔষধেরই সংগ্রহ ও সরবরাহ সংকটের সম্মুখীন হয়।
এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকটি দেশের মধ্যে ফ্রান্স অন্যতম একটি দেশ যা কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে ঔষধ দুটির ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। ইইউ এর ফার্মাসিউটিক্যাল রেগুলেটরি সন্থা ইউরোপিয়ান মেডিসিন এজেন্সী কোভিড-১৯ চিকিৎসায় এই ঔষধের প্রয়োগের বিরোধিতা করেছিল। এর অন্যতম প্রধান কারন হিসেবে তারা বলেছিল, ঔষধদুটি কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় কার্যকর এ সংক্রান্ত কোন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ তাদের হাতে এখনও নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) মনে করে, কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা করার ক্ষেত্রে বা করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে বাঁচাতে এই ঔষধগুলির যেকোনোটির কার্যকারিতা মূল্যায়নের জন্য যে তথ্য প্রমাণ রয়েছে তা অপর্যাপ্ত।
তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, এফডিএর প্রধান বিজ্ঞানী এবং EUA প্রনেতা ডেনিস হিন্টন এ জাতীয় উদ্বেগের নিয়ে অতটা চিন্তা করেননি। কোন সমর্থনযোগ্য রেফারেন্স বা তথ্য উপস্থাপন ছাড়াই তিনি লিখেছেন, “এফডিএ এর কাছে থাকা সামগ্রিক তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে এটা বলাই যায় যে ক্লোরোকুইন এবং হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন সালফেট কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় কার্যকরী হতে পারে। যদিও কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় এসব ঔষধের কার্যকারিতা নিশ্চিত নয় তবে এদের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া বিষয়টি নিশ্চিত।
উইন্ডল্যান্ড স্মিথ রাইস জেনেটিক হার্ট রিদম ক্লিনিকের মায়ো ক্লিনিক বিভাগের পরিচালক এবং জেনেটিক কার্ডিওলজিস্ট, মাইকেল একেরম্যান বলেন, একজন কার্ডিওলজিস্ট হিসাবে আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি এসব উচ্চ মাত্রার ঔষধের বেশ গুরুতর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া রয়েছে যেমন অস্বাভাবিক হৃদরোগ জনিত মৃত্যু। তিনি আরোও বলেন, অন্তত ১% রোগী হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন বা ক্লোরোকুইন QT reaction জনিত অতিরিক্ত ঝুঁকিতে থাকবে এবং এদের মধ্যে ঔষধ দ্বারা প্রভাবিত (drug-induced) আকস্মিক হৃদরোগ জনিত মৃত্যু দেখা দিতে পারে (বিশেষ করে যদি এজিথ্রোমাইসিন এর সাথে ব্যবহার করা হয়)।
অবশ্য তিনি আরোও যোগ করেন, যদিও এই ধরণের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সচরাচর দেখা যায় না। যদি লক্ষাধিক রোগীর উপর এই ঔষধ প্রয়োগ করা হয়, তবে সহস্রাধিক রোগী এ জাতীয় ঝুঁকিতে থাকবে যেটা একেবারে কম না হয়তোবা কোনভাবে কাম্যও নয়। একেরম্যান বিশ্বাস করেন এই ধরণের মারাত্মক পরিস্থিতি প্রতিরোধ করতে চিকিৎসার সাথে সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের অবশ্যই ঝুঁকিপূর্ণ রোগীদের সতর্কতার সাথে মূল্যায়ণ করতে হবে।
মাসকি বলেন নিউ ইয়র্ক শহরের এলমহার্স্ট হাসপাতালে কোভিড-১৯ রোগীরা হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের পার্শপ্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হয়নি। হাসপাতালটি অনেক নতুন রোগীর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং পার্কিং এলাকায় তাঁবু টানিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের কোভিড-১৯ এ আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এটি এমন একটি অবস্থা যা আগে কখনো ছিল না এবং চিকিৎসা, প্রতিরোধ এবং সংক্রমণের দিক থেকে এর একটি নিজস্ব ব্যতিক্রমী ধরন রয়েছে। এটি খুবই চ্যালেঞ্জিং একটি সমস্যা এবং আমরা মনে করিনা যে এটি এখনো এর সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, সামনে এখনও অনেক অজানা বন্ধুর পথ।
সূত্র: ডা. শামীম রিজওয়ান এর ফেসবুক পোস্ট থেকে সংগৃহীত
মূলঃ সুস্যান জ্যাফফে, দ্যা ল্যানসেট
অনুবাদঃ ডা. মোঃ রিজওয়ানুল করিম
আবু আহাম্মদ আবদুল্লাহ
মূল লিংক:https://www.thelancet.com/journals/lancet/article/PIIS0140-6736(20)30817-5/fulltext