অবরুদ্ধ জীবনে বেড়েছে মানসিক রোগের প্রকোপ

অবরুদ্ধ জীবনে বেড়েছে মানসিক রোগের প্রকোপ

১. হাসান সাহেব ‍খুব অসহায়ভাবে টেবিলের নিচের ভাঙা কাচের টুকরাগুলোর দিকে তাকিয়ে আছেন। মাত্র কিছুদিন হলো পরিবারটিতে একটা শান্তির আবহাওয়া এসেছিল। উনার ২৮ বছর বয়সের ছেলে সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত, চিকিৎসায় অনেকটা ভালো হয়ে এসেছিল। রোগের তীব্রতায় প্রায়ই অহেতুক সন্দেহ, ভাঙচুর, প্রচন্ড রাগারাগি করত, সেগুলো ঔষধ খেয়ে বেশ কমে এসেছিল। নিয়মিত মনোরোগবিদের কাছে ফলোআপ চলছিল। ঔষধে ভালো হওয়ার পর ব্যায়াম করছিল নিজে থেকেই। চাকরি করে একটা বেসরকারি সংস্থায়। প্রতিদিন বাসার কাছেই একটা মাঠে হেঁটে আসত। এর মধ্যে বাংলাদেশেও করোনা মহামারি চলে এলো। রোগটির সংক্রমণ কমাতে লকডাউন শুরু হলো। হাসান সাহেব বেশ বিপদে পড়ে গেলেন। তার বাসস্থানের এলাকায় বেশ কড়াকড়ি, স্রেফ প্রয়োজনীয় বাজার ছাড়া বাসার বাইরে বের হতে দিচ্ছে না কাউকে। অফিস যেতে আসতে একটা রেজিস্টারে নাম তুলতে হয়, অনুমতির কার্ড থাকতে হয়। ছেলেটার হাঁটা, ডাক্তারের ফলোআপ বন্ধ হয়ে গেল। উপরন্তু জানতে পারলেন যে ডাক্তার নিজেও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং হাসপাতালে ভর্তি, তাই ফোনে যোগাযোগ সম্ভব হচ্ছে না। ছেলেটার চাকরির কোম্পানিটি বন্ধ হয়ে আছে। এখন আবার ছেলের তীব্র লক্ষণ দেখা দিচ্ছে। সারাদিন বাসায় থেকে কেউই আর মেজাজ ধরে রাখতে পারেন না। হাসান সাহেব খেয়াল করলেন স্ত্রীও বেশ খিটখিটে হয়ে গেছেন, ঘরের সব কাজ করতে হয় এখন তাকে, কারণ আগে যে ‍গৃহকর্মী ছিল তার আসা বন্ধ হয়ে গেছে। সবার এরকম অবস্থায় ছেলের ভাঙচুর, অস্থিরতা আবার চলছে।

২. চার সদস্যের পরিবারে সবাই মিলেমিশে বেশ ভালোই ছিল মুনিয়াদের। মুনিয়া, তার স্বামী, ছয় আর চার বছরের ‍দুই বাচ্চা। স্বামী-স্ত্রী দুইজনই চাকরি করছিলেন, ‍মুনিয়া একটা স্কুলের শিক্ষক। করোনা মহামারি বাংলাদেশে আসার পর তার স্কুল বন্ধ হয়ে গেল। বাচ্চারা একজন প্লে গ্রুপে আর আরেকজন ক্লাস ওয়ানে পড়ছিল, সেই স্কুল বন্ধ হওয়ার পর তাদের রুটিন এলোমেলো হয়ে গেছে। ‍মুনিয়া খেয়াল করলেন এখন তার অল্পতেই খুব ভয় ভয় লাগে, রাতে দুঃস্বপ্ন দেখেন শুধু, ঢাকার বাইরে থাকা বয়স্ক বাবা-মাকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় কোনো কাজে মন দিতে পারেন না। আগে ছুটির দিন বাচ্চাদের নিয়ে বেড়াতে বের হতে পারতেন, ওরাও ছুটোছটি করত, সেগুলো বন্ধ হয়ে খুব বিপদে পড়েছেন। বাচ্চা দুইজনের মেজাজও খিটখিটে হয়ে গেছে।

৩. ঢাকার একটি সরকারি কলোনিতে আটটা বাসার ‍গৃহকর্মীর কাজ হারিয়ে অসহায় অবস্থায় সালমা। ভ্যানচালক স্বামীও আছে বিপদে, বের হলে কবে কখন ‍পুলিশ ঝামেলা করে সেটা আন্দাজ করার উপায় নাই। কিছুদিন আগে সবজি নিয়ে বের হওয়ার পর মাস্ক না থাকায় পুলিশ ধরে সব সবজি নিয়ে যায়। তিন বাচ্চাসহ না খেতে পেয়ে সবাই অস্থির হয়ে আছে।

২০১৯ এর ডিসেম্বরে চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া সার্স কভ ২ ভাইরাস থেকে হওয়া কোভিড ১৯ মার্চ মাসে মহামারি ঘোষণা হওয়ার পর বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়। ভাইরাসটির ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে একটা কার্যকর পদ্ধতি হচ্ছে লকডাউন। বিভিন্ন দেশে এটা বিভিন্নভাবে বাস্তবায়ন করা হলেও মল উদ্দেশ্য হচ্ছে জনসাধারণ যেন জমায়েত বা ভিড় না করতে পারে, প্রয়োজন ছাড়া যেন ঘরের বাইরে মানুষ না যেতে পারে সেটা নিশ্চিত করা। ফলে জরুরি সেবা ছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত, বাজার, মার্কেট বন্ধ রাখতে হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্থানে স্থানে লকডাউন দেয়া হয়। এই বিধিনিষেধের মানসিক প্রভাব অনেক।

ওপরের তিনটি দৃশ্যপট আসলে খুব অল্পই তুলে ধরে আসলে কতটা প্রভাব মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর পড়েছে এই লকডাউনের। প্রভাবগুলো আসতে পারে দুই রকমভাবে-

  • যারা আগে মানসিকভাবে সুস্থ ছিলেন তাদের নতুন করে মানসিক সমস্যা।
  • যারা আগে থেকেই মানসিক রোগে আক্রান্ত তাদের সমস্যা বেড়ে যাওয়া।

প্রভাবগুলো প্রাপ্তবয়স্ক, বয়স্ক এবং শিশু-কিশোরদের ওপর আলাদারকমভাবে দেখা যায়। গবেষণায় দেখা গেছে যারা আগে থেকে মানসিকভাবে সুস্থ ছিলেন তাদের মধ্যে নতুন করে উদ্বিগ্নতা, বিষণ্ণতা, চাপজনিত মানসিক রোগ, ঘুমের সমস্যা, আসক্তি (যেমন মোবাইল আসক্তি, মাদকাসক্তি, অতিরিক্ত কেনাকাটা) এগুলো দেখা যাচ্ছে।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে নারীর প্রতি সহিংস আচরণ বেড়ে গেছে লকডাউন পরবর্তী জীবনে। যাদের আগে থেকে কোনো মানসিক রোগ আছে তাদের রোগের তীব্রতা বেড়ে যাচ্ছে। শিশু-কিশোরদের মধ্যে আচরণগত সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এছাড়াও প্রাপ্তবয়স্ক এবং শিশু-কিশোরদের মধ্যে ইন্টারনেট আসক্তি, মোবাইল আসক্তি নতুন করে দেখা যাওয়া, বেড়ে যাওয়া এরকম হচ্ছে।

বয়স্কদের মনের মধ্যেও লকডাউনের প্রভাব গভীর। একা জীবনে আরো একা হয়ে গেছেন অনেকে, কারণ আত্মীয়-স্বজনরা চলাচল করতে পারছেন না। উপরন্তু নিজেদের স্বাস্থ্যগত বিষয় নিয়ে তাদের চিন্তা থাকছে বেশি। দীর্ঘদিন লকডাউনে থাকার কারণে নিজস্ব রুটিন ওলটপালট হচ্ছে, এতে তাদের মনের ওপর চাপ পড়ছে বেশি।

লকডাউনে এরকম ব্যক্তিগত প্রভাব ছাড়াও সামাজিক একটি বড়ো প্রভাব আছে সেটা হচ্ছে আর্থিক টানাপোড়েন। এটার কারণে অনেকেই অসহায় অবস্থায় পড়ে বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হচ্ছেন সহজে।

এরকম সংকটের কারণ হিসেবে দেখা যায় হঠাৎ জীবনযাত্রার এই বদলের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোয় ব্যর্থতা, সামাজিকতার স্বাভাবিক রূপ পালটে যাওয়া, অনিশ্চয়তা (এখনো কেউ জানে না যে কবে এই ভাইরাসের কার্যকরী ভ্যাক্সিন বের হবে, লকডাউন ছাড়াও প্রতিরোধ সম্ভব হবে), আক্রান্ত হওয়ার পর একা সব কিছু সামলে নেওয়ার ভয়। আরেকটি বিষয় আমাদের সমাজে লক্ষণীয়ভাবে দেখা গেছে সেটা হচ্ছে কোভিড আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতি ভয় এবং নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। দেখা গেল একটি এলাকায় বাকি স্বাভাবিকভাবে চলছে কিন্তু কোনো বাড়ির এক বা একাধিক সদস্যের কোভিড আক্রান্তের খবর জানাজানি হলে সেই বাসাটির সদস্যদের ‘লকডাউন’ নামে আসলে একঘরে করে দেয়া হচ্ছে। এইরকম অবৈজ্ঞানিক এবং নেতিবাচক কাজও ‘লকডাউন’ নিয়ে ভীতি তৈরি করছে।

লকডাউনের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাবকে উপেক্ষা করার উপায় নেই। আর এই নেতিবাচক প্রভাব কাটাতে যে-কাজগুলো করা প্রয়োজন-

  • বাসায় থাকার সময়েও আগের ব্যস্ত জীবনের মতো রুটিন চালিয়ে যাওয়া। আগে ঘুম থেকে ওঠার সময় সকাল সাতটা হলে এখনো সেটাই রাখা।
  • পরিবারের সকলের মধ্যে সুন্দর বন্ধন বজায় রাখা। ঘরের বিভিন্ন কাজ সবাই মিলে করা, নিজেদের মধ্যে বসে একটা আড্ডা দেয়া, একজন আরেকজনের ‍সুখ-দুঃখের বিষয়গুলো আদান-প্রদান করা, সৃষ্টিশীল কাজের চর্চা করা এসবের মাধ্যমে উদ্বিগ্নতা, অনিশ্চয়তাবোধকে অনেকটাই দূর করা যায়।
  • পরিবারে শিশু-কিশোরদের সময় দেয়া। এতে প্রাপ্তবয়স্করা এবং শিশু-কিশোররা উভয়েই উপকৃত হবে।
  • শারীরিক ব্যায়াম করা। বয়সভেদে প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা ব্যায়াম করা।
  • মোবাইল, ল্যাপটপ, ট্যাব এইসব ডিভাইসের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার করা।

ভাইরাসটির বিরুদ্ধে যুদ্ধের এখনো পর্যন্ত মোক্ষম অস্ত্র হচ্ছে লকডাউন। যদিও অস্ত্রটি নিজেও মানবজাতিকে আর্থিক, সামাজিক, মানসিক দিক দিয়ে বিপর্যস্ত করছে। তারপরও নিজের এবং অন্যদের ‍সুস্থতার জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্রটিকে সঠিকভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে আমরা যেন এই আকস্মিক যুদ্ধে জয়ী যদ্ধে জয়ী হতে পারি এই কামনা রইল।

সূত্র: লেখাটি মনের খবর মাসিক ম্যাগাজিনে প্রকাশিত।

করোনায় স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে

Previous articleসম্মানসূচক ফেলোশিপ পেলেন অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল
Next articleমহামারীতে শিশুদের সাথে কঠোর ব্যবহার হতে পারে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক
ডা. সৃজনী আহমেদ
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, সহকারী অধ্যাপক, ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতাল, মগবাজার

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here