‘ধর্ষণের ভিডিও ভাইরালের হুমকি, ভিকটিমের আত্মহত্যা’। এই ধরণের শিরোনাম এখন গন্যমাধ্যমের নিয়মিত রুটিন হয়ে গেছে। শিশু, বৃদ্ধা, শিক্ষার্থী, গার্মেন্টস কর্মী, পরিবহন যাত্রী তরুণী কেউই রেহাই পাচ্ছে না। ধর্ষকদের লোলুপ দৃষ্টি থেকে।
এসব কাণ্ড ঘটাতে বখাটেরা আশ্রয় নেয় প্রভাব, শক্তি, বিয়ের প্রলোভনের ধোঁকা কিংবা চাকরীর প্রলোভন। কিছু ক্ষেত্রে প্রেমের সম্পর্কে পারস্পরিক সম্মতিতেও হয় অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক যা অবলম্বন করে পরবর্তীতে ভুক্তভোগী তরুণী বা নারীকে ধর্ষিতা হতে বাধ্য করে বখাটেরা।
সম্মতিতে হোক আর অসম্মতিতে হোক অসত উদ্দেশ্যে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের পর সেটার ভিডিও ধারণ করে ব্লাকমেইলিং করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। প্রেমিক-প্রেমিকা যুগলের কিংবা বিবাহ বা কোনো কিছুর প্রলোভনে যৌনতার ভিডিও ধারণ করে সেটার অপব্যাবহার কিংবা প্রতারণা করলেও আইনে রয়েছে কঠিন শাস্তির বিধান।
কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব ঘটনার ফলাফল দাঁড়ায় ভুক্তভোগীর আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে। সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে এক নারী বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের অভিযোগ এনে থানায় মামলা দায়েরের পর অশালীন ভিডিও ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি পেয়ে আত্মহত্যা করেন। অনেকাংশে ভুক্তভোগী আইনের আশ্রয়ও নেন না। অপরাধীকে শাস্তির মুখোমুখি না করে ভিকটিম নারীরা কেন আত্মহত্যা পথ বেছ নেন?
এ বিষয়ে আমরা কথা বলি সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ এর মনোরোগবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ডা. সুস্মিতা রায়ের সঙ্গে। তিনি আমাদেরকে জানান, মূলত মানসিক বিপর্যয়ের কারণেই ভিকটিম আত্মহত্যা করে।
তিনি বলেন, ‘‘বিচারহীনতা বা সামাজিক লোকলজ্জা ও নিরাপত্তা এক একটা কারণ হতে পারে কিন্তু মূল কারণ নয়। একজন নারী যখন ধর্ষণের শিকার হন দেখা যায় শুরুতেই তিনি আত্মহত্যা করেন না। কেননা প্রত্যেকের বাঁচতে ইচ্ছে করে। সহজেই কেউ মরতে চান না।
কিন্তু ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর যখন দেখে সমাজ তাকে ভিন্ন চোখে দেখছে, আইনের আশ্রয় নিতে গেলে সেখানেও বাধা-বিপত্তি এবং বিচার পাওয়ার ক্ষীণ আশা, সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়।
- এসব দেখে ভিকটিম মানসিকভাবে হতাশ হয়ে পড়ে এবং ডিপ্রেশনে চলে যায় বা বিষণ্নতায় ভোগে। যেটা অধিকাংশ ক্ষেত্রে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে ঘটে যায়। ফলে ওই হতাশা ও ডিপ্রেশন থেকে বাঁচতে ভুক্তভোগী আত্মহত্যার কঠিন মতো সিদ্ধান্ত নেয়।
এজন্য ধর্ষণের শিকার নারীরর আত্মহত্যা প্রবনতা রোধে সব থেকে বেশি প্রয়োজন মানসিক সাপোর্ট। এসময় পরিবার ও স্বজনদের পাশে থাকা ভুক্তভোগীর জন্য খুবই জরুরী। যাতে হতাশা তাকে কোনোভাবেই গ্রাস করতে না পারে। এরপর আসে সামাজিক নিরাপত্তা ও বিচারের নিশ্চয়তা’’ বলছিলেন ডা. সুুস্মিতা।
ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নের এসব ঘটনায় দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী নারীরা ফাঁদে পড়ে ব্লাকমেইলিংয়েরও শিকার হন। সামাজিক বাস্তবতায় লজ্জায় অপমানে অনেক ভুক্তভোগী নিজের জীবন বলি দিয়ে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করে। অন্যদিকে মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়ায় প্রকৃত অপরাধীরা।
কিন্তু বাংলাদেশে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন’ দমন আইনে বলা আছে, যদি প্রতারণামূলকভাবে সম্মতি আদায় করে যৌন সম্পর্ক করা হয়, তাহলে সেটা ধর্ষণ হিসেবে দেখা হবে। পারস্পপরিক সম্মতি হওয়া যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রেও প্রতারণা করলে আইনের আশ্রয় নেয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ভুক্তভোগী নারীরা কেন আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যা প্রবনতার আসল কারণ কী? এটা কি শুধুই আইনের প্রতি অনাস্থা বা সামাজিক নিরাপত্তা নাকি মানসিক হতাশাও এর একটি কারণ?
ডা. সুস্মিতা রায় বলেন, ‘‘মানসিক হতাশা একটি কারণ নয় বরং এটিই মূল কারণ। যেকোনো অপরাধ সংঘটিত হলে বিচারের জন্য একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে যেতে হয়। অল্প কয়েকদিনে বিচার সম্পন্ন করা সম্ভব হয় না। সেজন্য অপরাধীর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করতে হয় এবং বিচারে জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এই সময়টাতে যেন ভুক্তভোগী নারী বিষণ্নতায় চলে না যায় সেজন্য মানসিক সাপোর্ট সব থেকে বেশি জরুরী এবং এর পাশাপাশি ভিকটিমদের নিয়মিত মানসিক অবস্থা পরীক্ষা করানোর প্রয়োজন আছে।
‘‘হ্যাঁ, এটা ঠিক যে আমাদের দেশের সামাজিক বাস্তবতায় বিচারের দীর্ঘসূত্রতা কিংবা বিচারহীনতায় অনাস্থার কারণে ভিকটিম হতাশায় ভোগে। এছাড়াও রয়েছে সামাজিক নিরাপত্তার ভয়। এগুলো প্রত্যেকটা মূল কারণ না হলেও সরাসরি দায়ী। কেননা এসব কারণেই মূলত ভিকটিমের মানসিক অবস্থা দিন দিন খারাপ হয়ে যায়। এসব ক্ষেত্রে বিচার নিশ্চিতের চেষ্টার পাশাপাশি ভিকটিমের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে সাহস যোগানো পরিবার, স্বজন ও সমাজের দায়িত্ব। এজন্য সামাজিক সচেতনতা জরুরী।’’
তিনি বলেন, ‘‘সামাজিক সচেতনতা তৈরী হলে ভুক্তভোগীর জন্য পরিবেশ উন্মুক্ত হবে। ভুক্তভোগীর প্রতি নাক ছিটকানোর পরিবর্তে অপরাধের প্রতি ঘৃণা তৈরী হবে এবং সেই সাথে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিতে সবাই সহযোগীতা করলে সেটাই একজন ধর্ষিতা নারীর জন্য সহায়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরী করবে। আর সামাজিক নিরাপত্তা তৈরী হলে ভিকটিমের মানসিক শক্তি বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি পরিবার ও স্বজনদের সাপোর্ট থাকলে মানসিকভাবে স্ট্রং হয়ে অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিতে ভিকটিম আশ্বস্ত হবে। তখন আর হতাশা তাকে গ্রাস করতে পারবে না। তখন সে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে। আত্মহত্যা প্রবনতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে। এর জন্য নিয়মিতভাবে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে ভিকটিমের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। ’’
একটা দূর্ঘটনা ঘটে গেছে, যার ভিডিও বা সংবাদ লোকসমাজে ছড়িয়ে গেছে যার ভয়ে লজ্জা এবং সামাজিক হেনস্তার ভয়ে ভুক্তভোগী নারীরাই মুখ লুকিয়ে থাকবে আর অপরাধী বুক ফুলিয়ে চলবে কিংবা পালিয়ে বেড়াবে। অন্য কোথাও গিয়ে নিজের অপরাধ ও পরিচয় গোপন করে ঠিকই সে বেঁচে থাকে। তাহলে একজন নারী কেন আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটাবে। নিজের জীবন দিয়ে কোনো নারী কি তার পরিবার ও স্বজনদেরকে তথাকথিত সামাজিক লজ্জা থেকে বাঁচাতে পারে? অবশ্যই পারে না। যদি নাই পারে তবে কেন নিজের জীবন বির্সজন দিয়ে অপরাধীকে আরো বেশি নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগকে সহজ করে দেয়।
ধর্ষণের শিকার হয়ে ভুক্তভোগী আত্মহত্যা করলে তার পরিবার ভেঙে পড়ে। আইন ও বিচারে আস্থাহীনতায় পিছিয়ে পড়ে তারা। ফলে অপরাধী ঘুরে বেড়ায় মুক্ত বাতাসে। ক্ষমতার ছত্রছায়ায় পুনরায় জড়িয়ে পড়ে একই অপরাধে এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এজন্য মূলত আইনের শাসন ও ভিকটিমের পারিবারিক ও সামাজিকভাবে মানসিক সাপোর্টের প্রয়োজন। পরিবার ও স্বজনদের মানসিক সাপোর্ট ভিকটিমকে যে কোনো ধরণের দূর্ঘটনা থেকে রক্ষা করতে পারে বলে মনে করেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা।
উল্লেখ্য, সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জে বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণ ও অশালীন ভিডিও ভাইরালের পর আত্মহত্যা করেছে। গত ২ জুন ওই নারী বন্দর থানার আব্দুল মোমেন নামের একজনের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেন।
স্থানীয় সাংবাদিক, গণমাধ্য ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, অভিযুক্তের সাথে ওই নারীর দুই বছরের প্রেমের সম্পর্ক ছিলো। অশালীন ভিডিওগুলো ওই নারী বিভিন্ন সময় নিজের প্রেমিককে পাঠিয়েছিলেন। বিভিন্ন সময় শারীরিক সম্পর্ক সত্ত্বেও বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানানোয় গত বৃহস্পতিবার বিয়ের প্রলোভনে ধর্ষণের অভিযোগ এনে মামলা করেন।
এরপর ওই নারী ও তার মাকে ডেকে স্থানীয় এক ইউপি সদস্যের উপস্থিতিতে অশালীন ভিডিও দেখিয়ে সেগুলো ভাইরাল করে দেয়ার হুমকি দিয়ে আব্দুল মোমেন ও তার পরিবার ভুক্তভোগীকে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য চাপ দেয় এবং এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বলে। এই ঘটনার পর গত সোমবার ভুক্তভোগী ওই নারী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে।
আরো পড়ুন…
ওসিডি হলে করণীয় কী? : (চতুর্থ ও শেষ পর্ব)
মানসিক স্বাস্থ্য স্বীকৃতি ও সেবা প্রসারে ডব্লিউএইচও’র ভূমিকা
স্বজনহারাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য পেতে দেখুন: কথা বলো কথা বলি
করোনা বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য ও নির্দেশনা পেতে দেখুন: করোনা ইনফো
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক মনের খবর এর ভিডিও দেখুন: সুস্থ থাকুন মনে প্রাণে
/এসএস