বাংলাদেশে পূর্ণ (১৮ বছর থেকে তদুধর্) বয়স্ক মানুষের মাঝে প্রায় ১৬.৮ শতাংশ থেকে প্রায় ১৮.৭ শতাংশ মানুষ মানসিক রোগে আক্রান্ত। শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মাঝে এই সংখ্যা ১২.৭ শতাংশ।
সহজ ভাষায় বললে, অলএভারেজ প্রতি ১০০জন মানুষের মাঝে প্রায় ১৬-১৮জন মানুষ মানসিক রোগে ভুগছে। কিন্তু সে তুলনায় মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সংখ্যা খুবই কম। দেখা গেছে দেশের প্রায় ৭হাজারের বেশি রোগীর বিপরীতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা মাত্র ১জন। এছাড়া রয়েছে ট্রিটমেন্ট গ্যাপ।
অধিকাংশ মানসিক রোগী চিকিৎসার আওতায় আসছে না নানা কারণে। প্রায় ৯২-৯৪ ভাগ রোগী চিকিৎসা সেবা নিচ্ছে না। অর্থাৎ মানসিক রোগে ভুগছে এমন রোগীদের মাত্র ৬ থেকে ৮জন চিকিৎসকের কাছে যায় চিকিৎসার জন্য। বড়ো সংখ্যাক রোগী চিকিৎসার আওতার বাইরেই থেকে যায়। ২০১৮-২০১৯ সালে পরিচালিত এক গবেষণায় এই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসে।
তবে আজ থেকে অল্প কিছুদিন আগেও এই সামান্য তথ্যটুকুও আমরা পেতাম না। সাম্প্রতিক সময়ে মানসিক রোগ নিয়ে সচেতনতা, চিকিৎসা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, গবেষণা কিছুটা এগোচ্ছে। উপরের গবেষণা তথ্য তারই একটি বড়ো উদাহরণ।
মানসিক রোগ চিকিৎসা নিয়ে কার্যক্রম কতদূর এগিয়েছে তার একটি পরিস্কার ধারণা পেতে আমরা কয়েকটি ক্ষেত্র বিশেষে নীরিক্ষণ দৃষ্টিতে দেখতে পারি। যেমন- কার্যক্রম, সেবা, নীতি নির্ধারণ ক্ষেত্র ও গবেষণা।
কার্যক্রম : মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে পরিচালিত কার্যক্রমের কতগুলো স্তর আছে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, সংস্থা ও ব্যক্তি পর্যায়ে স্তরভিত্তিক কার্যক্রম বর্তমানে জোরালোভাবে চলমান রয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্য দিবসসহ অন্যান্য দিবস যেগুলো মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত; সেই দিনগুলোতে দেশের বিভিন্ন স্থানে আলোচনা সভা, সেমিনার, প্রচারণা, র্যালিসহ সচেতনতা বৃদ্ধিমূলক অন্যান কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।
দ্বিতীয়ত, স্টিগমা বা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে মানুষের মাঝে ভুল মনোভাব দূরিকরণে প্রতিনিয়ত সাধারণ জনগণের মাঝে সঠিক তথ্য পৌঁছে দেয়ার জন্য নানানরকম লিফলেট, ফেস্টুন, সভা-সেমিনার, লেখালেখি, আত্মহত্যা প্রতিরোধমূলক ক্যাম্পেইন, শিশু ও কিশোর মনোরোগ সম্পর্কিত ক্যাম্পেইন চালু রয়েছে।
তৃতীয়ত, মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী করার লক্ষ্যে দক্ষ চিকিৎসক তৈরির জন্যে শিক্ষাকোর্স তৈরি এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এর কার্যক্রম ধীরে ধীরে চালু হয়েছে। শুধু চিকিৎসকই মানসিক স্বাস্থ্যসেবার সাথে সম্পর্কিত সকল কর্মীদের দক্ষ করার কার্যক্রমও চলমান রয়েছে। শুধুমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোই যে এই কার্যক্রমে যুক্ত তা নয়, বরং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও সমন্বয়ের মাধ্যমে অনেক লক্ষ্য বাস্তবায়নে কাজ চলছে।
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক নানান প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালু রয়েছে যা ইউনিয়ন/কমিউনিটি পর্যায় পর্যন্ত কর্মীদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করছে। মানসিক রোগগুলোর চিকিৎসার জন্য বেশ কিছু গাইডলাইন তথ্য চিকিৎসা নির্দেশিকা প্রণয়ন করা হয়েছে। যেটা বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্টসের উদ্যোগে প্রণয়ন হয়ে সারাদেশে পৌঁছে দেওয়ার কাজ চলছে।
চতুর্থত, একাডেমিক কারিকুলামে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য সংযোজন করা হয়েছে। যার ফলে সব মহলে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা জাগ্রত করা সম্ভবপর হচ্ছে। মেডিক্যাল কারিকুলামে বর্তমানে সবার জন্য মানসিক স্বাস্থ্যের বিশেষ একটা কোর্স চালু রয়েছে। ভবিষ্যত সকল ডাক্তারকে একজন সাইকিয়াট্রিস্টসের অধীনে নূন্যতম ২৫ মার্কের একটা পরীক্ষা দিয়ে এমবিবিএস পাশ করতে হবে।
সেবার ক্ষেত্র : প্রথমত, ডিজিটালাইজেশনের সুফল বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও দৃশ্যমান। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের মনোরোগ বিশেষজ্ঞগণের চিকিৎসা সেবা এখন মানুষ ঘরে বসেই পাচ্ছেন। দ্বিতীয়ত, কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ চালু হয়েছে। যার মাধ্যমে ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রাথমিক মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সে পর্যায়েই নিশ্চিত করবেন এবং প্রয়োজন অনুযায়ী রোগীকে জেলা হাসপাতাল বা অন্যান্য মানসিক রোগ চিকিৎসা সেবা কেন্দ্রে পাঠাবেন।
বিশেষত মেডিক্যাল কলেজ বা স্পেশালাইজড মানসিক হাসপাতাল, যেমন- জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট (এনআইএমএইচ), পাবনা মানসিক হাসপাতাল, বিএসএমএমইউ অন্যান্য মানসিক রোগ বিভাগ সম্পন্ন হাসপাতালে প্রেরণ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। যা পূর্ববর্তী সময়ে দূরহ ব্যপার ছিল। তৃতীয়ত, এখনো যদিও কমিউনিটি/ইউনিয়ন/উপজেলা/জেলাগুলো সরকারি পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবি নেই। পেশাজীবি নিয়োগের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
দেখা গেছে প্রায় ৬৮ শতাংশ রোগী মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন না শুধুমাত্র বিশেষজ্ঞ মনোচিকিৎসক না থাকার কারণে। এটি নিিিশ্চত হলে আমরা সমগ্র জনগোষ্ঠীকে চিতিৎসার আওতায় আনতে পারব। চিকিৎসা ব্যবস্থা ছাড়া অন্যান্য ফ্যাকাল্টি যেমন- পুলিশ, এডমিন ক্যাডারের নানান সেক্টরগুলোর সাথে কো-অপারেশনের মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা ও সেবা কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। গ্রামের বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ, যেমন- মসিজেদের ইমাম, ট্রেডিশনাল হিলার, মন্দিরের পুরোহিতসহ অন্যান্য সকল ধর্মেও বিশিষ্ট ব্যক্তিদেরকেও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি ও সেবার গুরুত্ব সাধারণ মানুষের মাঝে নিকট দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
নীতি নির্ধারণ ক্ষেত্র : মানসিক স্বাস্থ্য বা চিকৎসা সামনে এগিয়ে যাওয়ার একটি অন্যতম পদক্ষেপ হলো এ সম্পর্কিত পলিসি গ্রহণ করা। এটা যেকোনো ক্ষেত্রেই অতীব জরুরি বিষয়। এ লক্ষ্যে ২০১৮ সালে জাতীয় সংসদে ‘মানসিক স্বাস্থ্য আইন বাংলাদেশ ১৮’ পাশ হয়। ২০২২ সালে ‘ন্যাশনাল মেন্টাল হেলথ পলিসি’ গৃহীত হয়। এছাড়াও ‘ন্যাশনাল মেন্টাল হেলথ স্টাটেজি প্লান ২০২০-২০৩০’ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া গৃহীত হয়। সম্প্রতি মেন্টাল হেলথের অপারেশনাল প্লান পাশ হয়েছে, যা সমগ্র বাংলাদেশের মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে একটি বিশেষ সংযোজন।
গবেষণা ক্ষেত্র : মানসিক স্বাস্থ্য, রোগ ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রতিনিয়ত গবেষণা করা হলো অন্যতম মৌলিক কাজ। যেটা ইতোমধ্যেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিচালিত হচ্ছে। ফলে বর্তমানে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা থেকে শুরু করে সেবা, উন্নয়ন স্পষ্টত দৃশ্যমান হচ্ছে। ২০১৮-২০১৯ সালে সমগ্র বাংলাদেশব্যাপী জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট থেকে পরিচালিত গবেষণা কর্ম একটি অসাধারণ অবদান বলা চলে মানসিক স্বাস্থ্যখাতে। এছাড়াও বর্তমানে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি উভয়ক্ষেত্রে এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক নানান গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে যা মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাকে আরো সমৃদ্ধশালী করে তুলবে বলে আশা করা যায়। পরিশেষে বলা চলে, যদিও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা এখনো মানুষের দ্বোড়গোড়ায় পৌঁছানো সম্ভব হয়ে ওঠেনি নানান সীমাবদ্ধতার কারনে; তথাপিও আমার আশা করতে পারি অদূরভবিষ্যতে বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্যখাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে।
সাম্প্রতিক সময়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা, কার্যক্রম, সচেতনা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন যতদূর এগিয়েছে তাতে অতিশীঘ্রই স্বর্ণালি দিনের আগমন ঘটবে বলে আশা করা যায়।
লেখক :
ডা. ফাতেমা তুজ জোহরা জ্যোতি
এমবিবিএস, বিসিএস
রেসিডেন্ট (ফেইজ বি),
চাইল্ড এন্ড এডলুসেন্ট সাইকিয়াট্রি, বিএসএমএমইউ।
লেখকের অন্যান্য লেখা পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
/এসএস/মনেরখবর/