মানসিক রোগ : বার্ধক্যে যারা থাকেন তাদের প্রতি পরিবারের দায়িত্ব

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ

বার্ধক্য একটি স্বাভাবিক জৈবিক ঘটনা। যার ফলে বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে কর্মক্ষমতা এবং প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়। সাধারণভাবে বার্ধক্য দ্বারা প্রায়ই বয়োবৃদ্ধির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়। কত বয়স অতিক্রান্ত হলে একজন মানুষকে বৃদ্ধ বলে বিবেচনা করা হবে, তার কোনো বাঁধাধরা নিয়ম নেই। উন্নত বিশ্বে বার্ধক্য বিবেচনার ক্ষেত্রে আনুক্রমিক বয়স বড় ভূমিকা পালন করে।

কারও বয়স কর্ম থেকে অবসর গ্রহণের বয়সে পৌঁছালে অর্থাৎ ৬৫ বছর হলে তার বার্ধক্য শুরু হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু উন্নয়নশীল বিশ্বে যখন কারও পক্ষে কর্মক্ষেত্রে আর কোনো সক্রিয় অবদান রাখা সম্ভব হয় না; তখনই এর সূচনা বলে ধরে নেওয়া হয়।

  • তবুও এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অবসর গ্রহণের গড় বয়স, বিদ্যমান আইন, স্বাস্থ্যগত অবস্থা ইত্যাদি বিবেচনায় রেখে ৬০ বছর বয়সকে বার্ধক্যের পরিসংখ্যানসম্মত বাস্তব সীমা বলে মনে করা যায়।

পিতা-মাতা তাদের জীবনের সবকিছু দিয়ে আমাদের বড়ো করেন। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো, এই স্বর্গতুল্য পিতা-মাতা বার্ধক্যে উপনীত হলে অনেকের কাছে বোঝা মনে হয়। অনেক পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে জীবন কাটাতে হয়। সন্তানেরা নতুন সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অনেকেই অতি–আধুনিকতাকে লালন করতে গিয়ে শহুরে জীবন বেছে নেন। কেউ কেউ আবার একক বা ক্ষুদ্র পরিবার গড়তে পিতা-মাতাকে দূরে ঠেলে দেন। পিতা-মাতার খোঁজ নেওয়ার ফুরসতটুকু কারো কারো হয় না।

  • অনেক কারণেই বয়স্কদের বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে :
    ১. উন্নত কর্মসংস্থানের সুযোগের সন্ধানে গ্রামীণ এলাকা থেকে শহরে তরুণ দম্পতিদের স্থানান্তর।
    ২. বৃদ্ধ ব্যক্তিরা যারা দীর্ঘদিন ধরে পরিবারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন তারা তাদের সন্তানদের দায়িত্ব হস্তান্তর করতে চান না।
    ৩. অল্পবয়সীরা; তাদের পক্ষ থেকে কখনো কখনো তাদের পিতামাতার প্রতি ভালভাবে ব্যবহার করা হয় না।
    ৪. তরুণরা তাদের আদি বাড়ি থেকে অনেক দূরে এবং সাম্প্রতিক অতীতে ভিন্ন দেশে চলে যায়। তাই তারা চাইলেও বাবা-মায়ের সাথে নিজেদের ঘরে থাকতে পারছে না।
    ৫. বয়স্ক ব্যক্তিরা কিছু ক্ষেত্রে খুব দুর্বল বা অসুস্থ হয়ে পড়েন নিজেদের দেখাশোনা করতে বা চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে, বিশেষ করে জরুরি পরিস্থিতিতে। প্রকৃতপক্ষে, উন্নয়নশীল দেশের অনেক মানুষ ৬০ বছর বয়সের আগেই বৃদ্ধ হয়ে যায়।

দারিদ্র্যপীড়িত দেশে বয়স্কদের স্বাস্থ্য ও শারীরিক অবস্থা কখনই ভালো থাকে না। সুস্বাস্থ্য নির্ভর করে ভালো ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার, পর্যাপ্ত চিকিৎসা ও রোগে আক্রান্ত হলে নিরাময়, স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে জ্ঞান, ভালো স্যানিটেশন, শারীরিক ব্যায়াম, বিনোদন, মানসিক শান্তি, স্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং একটি সুখী ঘরের ওপর। এই দেশগুলির বর্তমান আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে, এই স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত প্রয়োজনীয়তাগুলি বেশিরভাগ বয়স্ক মানুষের জন্য ঘাটতি দেখা যায়।

সবচেয়ে সাধারণ রোগের মধ্যে রয়েছে হাঁপানি, ডায়াবেটিস, ডায়রিয়া, পেপটিক আলসার, রক্তচাপ, হৃদরোগ, বাত, পক্ষাঘাত, দাঁত ও চোখের সমস্যা। তারা স্মৃতিভ্রংশ, অনিদ্রা, প্রস্রাবের জটিলতায়ও ভোগেন; সাইকোসোমাটিক রোগ ইত্যাদি।

বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন অনিবার্য চিকিৎসা জটিলতা ছাড়াও এর সাথে সম্পর্কিত মানসিক-সামাজিক সমস্যাও রয়েছে। শারীরিক দুর্বলতা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, শিশুদের কাছ থেকে যত্নের অভাব এবং ভাড়া করা পারিবারিক সাহায্যের উপর নির্ভরতা। তাদের বস্তুগত সম্পত্তির কারণে সহিংস অপরাধের জন্য আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। তারা পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রে অবাঞ্ছিত বোধ করে।

  • প্রত্যেক সন্তানের উচিত মাতা-পিতার প্রতি তাদের যে কর্তব্য তা সঠিকভাবে পালন করা এবং সব সময় তাদের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখা। পৃথিবীর সকল ধর্মেই পিতা-মাতাকে সম্মানের সর্বোচ্চ জায়গায় আসীন করা হয়েছে। আমাদের সকলকেই মনে রাখতে হবে অকালমৃত্যু না হলে একদিন আমরাও বার্ধক্যে উপনীত হব।

পিতা-মাতার সঙ্গে যে রূপ আচরণ করবো; বার্ধক্যের সময় আমাদের সন্তানরাও সেইরূপ আচরণ আমাদের সঙ্গে করতে পারে। প্রয়োজনে আইন করতে হবে কোনো সন্তান যেন পিতা-মাতাকে অবজ্ঞা করতে না পারে এবং বৃদ্ধ বা অসহায় পিতা-মাতাকে বাধ্যতামূলক ভরণপোষণের ব্যবস্থা করে।

আপনি যদি আপনার পিতা মাতার খেয়াল না রাখেন তবে আপনিও আপনার সন্তানের থেকে যত্ন পাবেন না; যখন আপনার প্রয়োজন পড়বে। তাই পিতা মাতার বার্ধক্যের সময়ে তাদের যত্ন নিন। তাদের ভালো লাগা, না লাগার ওপর গুরুত্ব দিন। তাদের সমস্যাগুলো শুনুন। তাদের কি কি জিনিসের প্রয়োজন টা জেনে নিয়ে সেসব এনে দিন।

  • আপনি প্রায়ই আপনার বাবা-মায়ের কাছে যান। যদি আপনার পিতা মাতার বার্ধক্য এমন পর্যায়ে যে তারা সব কাজ নিজে করতে পারেন না, তাহলে কিন্তু তাদের একা থাকতে দেবেন না।

আবার যদি আপনার পিতা বা মাতার যে কোন একজন আছেন, সে কাজ করতে পারেন সেক্ষেত্রেও তাকে একা রাখবেন না। বার্ধক্য শরীরের চেয়ে বেশী মনকে গ্রাস করে নেয়। তাই একা থাকা কিছুতেই যাবে না। যদি আপনার পিতা বা মাতা একলা বাড়ীতে থাকেন, তাহলে আপনি তাকে আপনার কাছে নিয়ে যান। উনাদের শরীরের দিকে খেয়াল রাখুন। মাঝে মাঝেই উনাদের আপনার বাড়ীতে নিয়ে এসে রাখুন। ভালো ভালো খাবার বানিয়ে উনাদের খাওয়ান।

আপনি যদি অতি সচেতন হোন। আপনার সন্তানদের পড়াশোনার ব্যাপারে আর তাই আপনি তাদের কে আপনার পিতা-মাতার সাথে যদি সময় কাটাতে না দেন, তাহলে এমনটা করা ভুল হবে। আপনার সন্তানদের উনাদের সাথে মিশতে দিন। দাদা–নাতির সম্পর্কে চিড় ধরাবেন না। দাদা-নাতির সম্পর্ক দৃঢ় হলে সন্তানের মানসিক বিকাশ ঘটে। হুট করে কোন বড় সিদ্ধান্ত নেবেন না।

দেশের নাগরিক হয়ে দেশের মধ্যেই চাকরি করার চেষ্টা করুন। নিজের পিতা-মাতা কে বার্ধক্যের সময়ে একলা করে দেবেন না কিংবা বৃদ্ধাশ্রমের কথা ভুল করেও ভাববেন না। এমনটা করলে–আপনার প্রতিও কেউ কোনরকম দায়িত্ব নেবে না। তাই কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে বারবার ঠাণ্ডা মাথায় ভাবুন। বন্ধনগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য একসাথে একটি ভ্রমণে যাওয়া একটি ভাল উপায়। এটি মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্যও ভাল।

সোশ্যাল মিডিয়া এবং ইমেল ব্যবহার করুন। সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য, এটি অন্যদের সাথে সংযোগ করার এবং বিশ্বকে দেখার একটি দুর্দান্ত উপায় হতে পারে৷ এটি প্রিয়জনের সাথে যোগাযোগে থাকার, তাদের দুঃসাহসিক কাজগুলি দেখতে এবং তাদের বেড়ে উঠতে দেখার একটি ভাল উপায়। আপনি বন্ধুদের সাথেও বিশেষ সময়গুলি ভাগ করতে পারেন, যা সুখী স্মৃতিকে আহ্বান করে।

এমনকি সিনিয়রদের জন্য বিশেষভাবে সামাজিক নেটওয়ার্ক রয়েছে যা বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রাখা সহজ করে তোলে, আপনি যেখানেই থাকুন না কেন। মানুষ কয়েক মিনিটের মধ্যে বিনা খরচে বিশ্বজুড়ে তথ্য এবং ছবি শেয়ার করতে সক্ষম হয়।

একটি পারিবারিক অনুষ্ঠান আয়োজন করুন যাতে সামাজিক সমাবেশগুলি লোকেদের একত্রিত হতে এবং ভালো খাবার, গেমস এবং আরও অনেক কিছুর উপর বন্ধনের জায়গা দেয়। গেট-টুগেদারগুলি পরিবারের সদস্যদের দেখতে দেয় যা তারা কিছুক্ষণ আগে দেখেনি, পুরানো সম্পর্কগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করে।

একই সময়ে, হাসি এবং পারিবারিক বন্ধন একটি চাপমুক্ত এবং আরামদায়ক পরিবেশ তৈরি করতে পারে। এটি উত্তেজনা উপশম করার একটি দুর্দান্ত উপায়। একসাথে রুটি ভাঙ্গা বিশ্বাসের মাত্রা বাড়াতেও সাহায্য করে।
যে কোনো বয়সের লোকেদের জন্য বাইরে থাকা অত্যাবশ্যক। প্রকৃতিতে কাটানো সময় মানসিক স্বাস্থ্যকে বাড়িয়ে তোলে, যা মেজাজ এবং আত্মসম্মান উভয়ের উন্নতির দিকে পরিচালিত করে।

ঘনিষ্ঠ পারিবারিক সংযোগ সিনিয়রদের পরিপূর্ণ, সান্ত্বনা এবং ভালবাসা অনুভব করতে সাহায্য করে। এই সব মানসিক স্বাস্থ্যের একটি বড় উন্নতি হতে পারে। প্রবীণ ব্যক্তি যারা পরিবার এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রাখেন, তাদের ডিমেনশিয়া হওয়ার ঝুঁকি কম থাকে।

যারা ভালো পারিবারিক সংযোগ রয়েছে তাদের সামগ্রিক জীবনধারা পছন্দ করার প্রবণতা থাকে। এটি আংশিকভাবে, তাদের জীবন প্রসারিত করতে এবং প্রিয়জনের সাথে আরও বেশি সময় কাটাতে চাওয়ার কারণে হতে পারে। পরিবার চিকিৎসা প্রদানকারীদের কাছ থেকে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন সম্পর্কে বার্তাগুলিকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করতে পারে, সিনিয়রদের আরও সহায়তা দেয়।

যদি কারও মন খারাপ, বিষন্নতা, রাগ, অতিরিক্ত আবেগ, ঘুম কম, মেজাজ খিটখিটে, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, নিজেকে আঘাত করার প্রবনতা, ভুলে যাওয়া, কাছের মানুষকে চিনতে না পারার সমস্যা দেখা দেয়। তবে দেরি না করে দ্রুত তাকে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের নিকট দেখিয়ে পরামর্শ ও চিকিৎসা নিবেন। কারণ বেশিরভাগ মানুষ শারীরিক রোগের মত মানসিক রোগ নিয়ে এত সচেতন নয়। সুস্থ থাকতে হলে মানসিক স্বাস্থ্য ভাল রাখতে হবে।

লেখক : ডা. ফাতেমা জোহরা
সহকারী অধ্যাপক, মানসিক রোগ বিভাগ
ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল

সূত্র : মাসিক মনের খবর মার্চ ২২’ সংখ্যা। 

  • মাসিক মনের খবর প্রিন্ট ম্যাগাজিন সংগ্রহ করতে চাইলে কল করুন : 01797296216 এই নাম্বারে। অথবা মেসেজ করুন পেজের ইনবক্সে। মনের খবর অনলাইনে লেখা পাঠাতে পারেন monerkhaboronline@gmail.com এই ঠিকানায় অথবা হোয়াটসঅ্যাপ  01844618497 নাম্বারে।

/এসএস

Previous articleমৃগীরোগের সাথে মানসিক রোগের সম্পর্ক
Next articleঅদ্ভুত কিছু চিন্তা-ভাবনা বারবার মনের মধ্যে ঘুরপাক খায়
সহকারী সার্জন, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন কভিড ১৯ ডেডিকেটেড হাসপাতাল। রেসিডেন্ট, ফেইজ বি, চাইল্ড এন্ড এডলুসেন্ট সাইকিয়াট্রি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here