ডা. সিফাত ই সাইদ
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ
দুজন মায়ের কথোপকথন :
-ভাবী আমার ছেলেকে নিয়ে তো মহা টেনশনে পড়লাম, ও তো ভীষণ চঞ্চল, এক সেকেন্ডও স্থির থাকে না -বাচ্চারা তো একট চঞ্চল হয়ই ভাবী টেনশন করবেন না
-না ভাবী, ডাক্তার দেখিয়েছি, বলেছে ওর এডিএইচডি আছে, মানে হল অতি চঞ্চল অমনোযোগী শিশু, বলেছে চিকিৎসা শুরু করতে। ঔষধ, সাইকোথেরাপি দেওয়াই লাগবে।
-আপনার কি মাথা খারাপ ভাবী? এই ৮ বছরের বাচ্চাকে মানসিক রোগের চিকিৎসা করাবেন? এরকম চঞ্চল তো আমার বাচ্চাও ছিল, চিন্তা করবেন না- বয়স বাড়লে এমনি ঠিক হয়ে যাবে।
-কিন্তু ডাক্তার বললেন যে চিকিৎসা না করলে পরে নানারকম অসবিধা হবে।
-আরে ডাক্তাররা এরকম বলেই, আপনি বাদ দেন তো। আপনাকে এক হুজুরের কাছে নিয়ে যাব, উনার পানি পড়া খেলেই দেখবেন কমে গেছে।
ওপরোক্ত কথোপকথনটি একটি বাস্তব চিত্র। বাবা-মায়েরা প্রায়ই মনে করেন যে শিশুর অতি চঞ্চলতা বয়সের সাথে সাথে কমে যাবে, চিকিৎসা করানোর দরকার নেই। সমাজেও প্রচলিত ধারণা আছে যে মানসিক রোগের ঔষধ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এবং শিশুদের জন্য ক্ষতিকর তাই অনেক বাবা-মায়েরাই শিশুর অতি চঞ্চলতা রোগ এমনিতেই সেরে যাবে এই আশায় থাকেন।
- আসলেই কি এডিএইচডি এমনিতেই ভালো হয়ে যায়? চিকিৎসা না হলে অতি চঞ্চল অমনোযোগী শিশুর ভবিষ্যত কী? আসুন জেনে নেই বয়সভেদে অতি চঞ্চল অমনোযোগী শিশুর পরিণাম কী হতে পারে :
শৈশবকালে অতি চঞ্চল অমনোযোগী শিশু ক্লাসে/লেখাপড়ায় যথেষ্ট মনোযোগ দিতে পারে না তাই যথেষ্ট মেধা থাকলেও সে ফলাফল ভালো করতে পারে না। সে নিজের আবেগ ও আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না বিধায় ঝোঁকের মাথায় খেলার সাথীদের আঘাত করে ফেলে, খেলার সময় নিজের পালা আসার জন্য অপেক্ষা করতে পারে না, নিজের খেলনা কারো সাথে শেয়ার করতে চায় না, এসব কারণে বন্ধুত্ব তৈরি করা এবং বন্ধুত্ব ধরে রাখা তার জন্য কঠিন হয়ে যায়।
- এই ধরনের শিশুরা ফলাফল এর চিন্তা না করে ঝোঁকের মাথায় হঠাৎ কিছু করে বসে, তাই প্রায়ই ব্যথা/আঘাত পায়, স্কুলে প্রায়ই শাস্তি পায়, বাড়িতেও সারাক্ষণ বকা-ঝকা শোনে। সবকিছ মিলিয়ে সে একাকী হয়ে পড়ে, হীনম্মন্যতায় ভোগে এবং তার বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।
কৈশোরে ৬০-৭০% শিশুর চঞ্চলতা কৈশোরকালেও থেকে যায়। লেখাপড়ায় খারাপ ফলাফল অব্যাহত থাকে, সামাজিক দক্ষতা আরো কমে যায়, অস্থিরতার কারণে বন্ধুত্ব বা ভালোবাসার সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে পারে না। এজন্য প্রায়ই বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়।
কিশোর বয়সেও যাদের অতি চঞ্চলতা থেকে যায়, তাদের কন্ডাক্ট ডিজঅর্ডার নামক আচরণগত সমস্যা দেখা দিতে পারে, সে কারণে সে মিথ্যা বলা, চুরি করা, মারামারি করা এবং বিভিন্ন নিয়ম-বহির্ভূত কাজ করতে থাকে।
অতি ‚ চঞ্চল অমনোযোগী কিশোর/কিশোরীর ঝুঁকি নেবার প্রবণতা অত্যন্ত বেশি থাকে, সেই কারণে তাদের মাদকাসক্ত হয়ে যাবার সম্ভাবনা অন্যদের চেয়ে বেশি। এছাড়াও এক্সিডেন্ট বা অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ে নিজের এবং পরিবারের জন্য বিপদ ডেকে আনে।
- পূর্ণবয়স্কদের ক্ষেত্রে শৈশবে এবং কৈশোরে যাদের এডিএইচডি থাকে তাদের ৪০- ৫০% এর এই সমস্যা ১৮ বছরের পরেও অব্যাহত থাকে। চঞ্চলতা কিছুটা কমে গেলেও মনোযোগের অভাব, ধৈর্যের অভাব এবং ঝোঁকের মাথায় কাজ করার প্রবণতা থেকে যায়।
লেখাপড়া এবং চাকরির ক্ষেত্রে তার প্রাপ্য সাফল্য অর্জন করতে পারে না বলে প্রায়ই বিষণ্ণতায় ভোগে। চাকরির ক্ষেত্রে গুছিয়ে কাজ করা, সময়মতো পৌঁছাতে পারা, ডেডলাইনে কাজ শেষ করা সম্ভব হয় না। এই কাজগুলো করতে পারে না বলে প্রায়ই চাকরি হারায় এবং বেকারত্বের সমস্যায় ভোগে।
সম্পর্কের ক্ষেত্রে অতি আবেগী হবার কারণে নানারকম সমস্যা এমনকি বিবাহ-বিচ্ছেদের ঘটনাও ঘটে থাকে। মাদকাসক্ত হবার সম্ভাবনা আরো বৃদ্ধি পায় এবং কৈশোরে যাদের কনডাক্ট ডিজঅর্ডার ছিল তাদের সমাজবিরোধী ব্যক্তিত্ব তৈরি হতে পারে এবং নানাবিধ অপরাধমলক কর্মকাণ্ড জড়িয়ে পড়তে পারে।
পরিশেষে একথা বলা যায় যে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে ২০-৩০% শিশুর চঞ্চলতা কমে যাবার সম্ভাবনা থাকলেও, চিকিৎসা না করানোর পরিণতি অনেক বেশি ক্ষতিকর এবং দীর্ঘমেয়াদী। তাই সময়ক্ষেপন না করে সময়মতো এই রোগের চিকিৎসা করা অত্যন্ত জরুরি।
লেখক : ডা. সিফাত ই সাইদ
এমবিবিএস, এফসিপিএস (সাইকিয়াট্রি), সহকারী অধ্যাপক, মনোরোগবিদ্যা বিভাগ
বঙ্গবন্ধ শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
ট্রেজারার, বাংলাদেশ এসোসিয়েশন ফর চাইল্ড এন্ড এডোলেসেন্ট মেন্টাল হেলথ (ব্যাকাম)।
- শিশুদের রোগ অতি চঞ্চলতা, কখন রোগ? কী করে বুঝবেন? চিকিৎসা কেমন? শিক্ষক ও পরিবারের ভূমিকা কী? এরকম বহু প্রশ্নের উত্তর জানতে এ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে সাজানো মাসিক মনের খবর জানুয়ারি ২০২২ সংখ্যাটি সংগ্রহ করুন। প্রয়োজনে কল করুন : 01797296216 এই নাম্বারে।
/এসএস/মনেরখবর/