কার্ল সেগান : যিনি বিশ্বাস করতেন মহাবিশ্ব একটি মমতাপূর্ণ জায়গা

0
130

ডা. ফাহিম আহসান আল রশীদ
এমবিবিএস

অনন্ত মহাশূন্যের উদ্দেশ্যে যাত্রার জন্য আজ থেকে প্রায় ৫০ বছর আগে নাসা তৈরি করল ভয়েজার। এক কেজিরও কম ওজনের এই স্পেস ক্রাফটটি তৈরিই করা হয়েছে ছুটে চলার জন্য। বিজ্ঞানীরা ভাবলেন, আমাদের সৌরজগত ও মিষ্টিওয়ে সব ছাড়িয়ে এক সময় নিশ্চয়ই অনেক আলোকবর্ষ দূরের কোনো স্থানে থাকবে ভয়েজার।

যদিও বিজ্ঞান তখন কিংবা এখনো জানে না, আমাদের সৌরজগতের বাইরে উন্নত প্রাণীর অস্তিত্ব আছে কিনা, জানা ও অজানার মাধ্যে কেমন যেন একটা ফাঁক আছে। এই ফাকটা ধরেই প্রশ্ন করে বসলেন একজন। যদি আমাদের চেয়ে কোনো উন্নত শ্রেণির প্রাণী লক্ষ কোটি আলোকবর্ষ দূরে থেকে থাকে? যদি কখনো তারা ভয়েজারের দেখা পায়? তারা কীভাবে জানবে পৃথিবী নামক একটি গ্রহ থেকে পাঠানো হয়েছে ভয়েজারকে? এই চিন্তায় দিনরাত মশগুল হয়ে পড়লেন সেই বিজ্ঞানী।

সম্ভাবনার সব দিক চিন্তা করে ভয়েজারের মধ্যে পাঠানো হলো পৃথিবীর নানান শব্দ ও ছবি। নানা ভাষায় স্বাগতমের সুর। অচেনা মানুষের ছবি। আমাদের ডিএনএ’র ম্যাপও বাদ যায়নি। সঙ্গে যোগ হলো পৃথিবীবাসী কীভাবে হাসেন তার শব্দ। এই শব্দ দিলেন স্বয়ং সেই খ্যাপাটে বিজ্ঞানীটি। সঙ্গে তিনি জুড়ে দিলেন তাঁর প্রেমে পড়া মানুষটির ব্রেইনওয়েডের রেকর্ড!

এই অদ্ভুত কাণ্ড ঘটানোর পেছনে যে মানুষটি আছেন, আজ তাঁর মনস্তত্ত্বকে নিয়ে কথা বলব। তিনি আর কেউ নন, বিখ্যাত মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সেগান।

সেগানকে বরং এভাবেও বর্ণনা করা যেতে পারে, তিনি আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় জনপ্রিয়তা অর্জন করা সেরা জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের অন্যতম একজন। জীবনকালে বলে গেছেন-“it is far better to grasp the universe as it really is than to persist in delusion, however satisfying and reassuring” আইজাক আসিমভ নাকি অসম্ভব দাম্ভিক লোক ছিলেন। কাউকেই তেমন পাত্তা দিতেন না।

উনি বলেছেন, ‘পৃথিবীতে আমার চেয়েও বুদ্ধিমান মাত্র দুজন ব্যক্তি আছেন। তার মধ্যে একজন কার্ল সেগান।’ এই কথার পেছনের রহস্য বের করতে হলে আমাদের চলে যেতে হবে সোগানের অতীতে।

নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে এক নিম্নবিত্ত ইহুদি পরিবারে জনুগ্রহণ করা সেগান ছোটোবেলার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, দর্জি পিতার কাছ থেকেই তাঁর সংখ্যাতত্ত্বের হাতছানি কিংবা আনন্দভ্রমণ। পরবর্তী জীবনে সেগান প্রায়ই তাঁর ছেলেবেলায় ভ্রমণ করা নিউইয়র্কের একটি ওয়ার্ল্ড ফেয়ারের কথা বলতেন।

সেখানে থাকা কাল্পনিক টাইম ক্যাপসুলটি তাঁর মনে স্থান করে নেয়, যাতে ভবিষ্যতের মানুষদের এসময়কার মানুষ সম্বন্ধে অবহিত করার জন্য বর্তমানের বিভিন্ন জিনিসপত্র জমিয়ে রাখা হয়েছিল। ভয়েজারে পৃথিবীর পদচিহ্ন এঁকে দিতে গিয়ে বারবার তিনি ছেলেবেলার সেই বিজ্ঞানমেলায় ফিরে গিয়েছিলেন কিনা, তা জানার কোনো উ এখন আমাদের নেই।

তবে ব্রুকলিনের পরিবেশ সেগানের মনো-দৈহিক বিকাশে ভূমিকা পালন করে, বিভিন্ন জায়গায় সেগান বর্ণনা করেছেন, বেসন হার্স্ট এলাকায় থাকার সময়ের আশেপাশে অবস্থিত তাঁর প্রিয় স্থানগুে ছিল বিভিন্ন অ্যাপার্টমেন্ট দালান, পায়রার খোপ, বাড়ির পেছনের প্রাঙ্গণ, সামনের বারান্দা, দালানগুলোর মধ্যকার খোলা জায়গা, এলম গাছ, কয়লার চুল্লির চিমনি, কারুকার্যময় কার্নিশ এবং চাইনিজ হ্যান্ডবল খেলার জন্য নির্মিত দেয়াল। এর অল্প কিছু দূরেই একটি স্থান ছিল- যাকে তিনি মঙ্গল গ্রহ মনে করতেন। সেগানকে স্কুলের গতানুগতিক পড়াশুনা আকর্ষণ করত না। তাঁর মতে, ক্লাস ছিল হুকুম তামিল করার জায়গা, প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ ছিল না।

সরাসরিই কার্লের সরল স্বীকার আমরা পাই যখন তিনি বলেন, ‘‘আমি যদি পেছনে ফিরে তাকাই তাহলে এটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, আমি আমার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস স্কুল শিক্ষকদের কাছ থেকে নয়, এমনকি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের কাছেও নয়, বরং শিখেছি আমার পিতামাতার কাছ থেকে, যাঁরা বলতে গেলে বিজ্ঞান সম্পর্কে কিছুই জানতেন না।’’

১৯৫০-এর শুরুর দিকে, সেগান যখন ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোতে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট করছিলেন, তখনই তাঁর লেখায় বোঝা যাচ্ছিল যে একদিন তিনি কেমন বিখ্যাত বিজ্ঞানী- লেখক হয়ে উঠবেন-

‘‘এক অসীম অন্ধকার ছেয়ে আছে চারিদিকে। যেদিকেই যান না কেন, বিস্তৃতি চলবে নিরন্তর। গভীরতাটা উপলব্ধি করলে তাজ্জব বনে যেতে হয়। এই অন্ধকারের কোনো মৃত্যু নেই। যেখানে আলো আছে, সেখানে সে নিশ্চিতভাবেই বিশুদ্ধ, ঝলমলে, এবং আগ্রাসী। কিন্তু আলোর উপস্থিতি তো বলতে গেলে তেমন নেই-ই। আর পাশাপাশি, অন্ধকারও যে বিন্তু, ঝলমলে, এবং আগ্রাসী। আরো জরুরি ব্যাপারটা হচ্ছে, সেই অন্ধকারে বলতে গেলে তেমন কিছুই নেই, শুধু এখানে ওখানে আলোর আশেপাশে কয়েকটা ছোটো টুকরোর মতো জিনিস ছাড়া। আর বাকি পুরো পাত্রটা, শূন্য।’’

কর্মজীবনে তাঁর অনুমানপ্রবণ সত্তাটা সহকর্মীদের বিরক্ত করতঃ যেমন- চন্দ্রপৃষ্ঠের নিচে প্রাণ থাকার সম্ভাবনার কথাটা। তিনি বেশ বেপরোয়া ছিলেন। তাঁর কথাগুলো প্রায় সময়ই পত্রিকা বা সাময়িকীতে চলে আসত। সমসাময়িক অনেকেই তাঁকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করত।

১৯৮০ সালে সেগান নিয়ে এলেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে বিশাল প্রজেক্ট । এই প্রজেক্ট তাঁকে পরিচিত করে তুলেছিল। গোটা বিশ্বের কাছে। তিনি বিজ্ঞানী থেকে বিপ্লবীতে পরিণত হয়েছিলেন এই প্রজেক্টের মাধ্যমে। আর সেই প্রজেক্টটা হচ্ছে।

বিজ্ঞানভিত্তিক বিখ্যাত টেলিভিশন সিরিজ, Cosmos: A Personal Voyage. কসমস মানে সবকিছু, তাই তের পর্বের এই সিরিজের মধ্যে তিনি দেখালেন সবকিছু-এই বিশাল অন্ধকার মহাকাশে, পৃথিবী নামে এই ছোট নীল বিন্দুটির ততধিক নগণ্য অধিবাসী হিসেবে আমাদের ব্যক্তিগত বিশ্বাস, হিংসা, দুঃখ, স্বার্থগুলো যে কত অর্থহীন, তা বারবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন কার্ল সেগান।

আবার সম্মিলিতভাবে একই উদ্দেশ্যে কাজ করে গেলে একসময় আমরা গ্যালাক্সি থেকে গ্যালারি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ব এই স্বপ্নও দেখিয়েছেন তিনি। ওয়াশিংটন পোস্টের টম শেইলস কে সেগান বলেছিলেন-‘আমি মানুষকে হতবাক করে দিতে চাই।’

ছোটোবেলা সম্পর্কে নানা সাক্ষাৎকারে কার্ল বলেছিলেন, অনেকের মতো তিনিও রাতের আকাশে বিস্ময়ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকতেন। আকাশের তারাগুলোর জন্য তাঁর এক ধরনের দুঃখবোধ হতো। জানতে চাইতেন আসলে এই আলোর উৎসগুলো কী? তখন থেকেই এর একটি সঠিক অর্থ অনুসন্ধানের জন্য তিনি ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন। জ্যোতির্বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার মূল প্রেরণা হয়ত ছিল সেই জীবন ।। Cosmos: A Personal Voyage এ উঠ এসেছিল ছোটোবেলার সেসব চিন্তার কিছু সার্থকতা। এই কসমসই সেগানকে করেছিল জনপ্রিয় বিজ্ঞানী

সে সময় আমরা যখন অর্বাচীনের মতো নিজ স্বার্থে পৃথিবী ধ্বংসে পারদর্শিতা দেখাচ্ছিলাম সেগান তখন কসমস সিরিজে গ্রিন হাউজ ইফেক্টের কথা বলে আমাদের সাবধান করার চেষ্টা করছেন, যুদ্ধের উদ্দেশ্যে পারমাণবিক বোমার ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছেন, কখনো শনির উপগ্রহ টাইটান দেখে হতাশ হচ্ছেন, আবার জুপিটারের উপগ্রহ ইউরোপার ভূ- পৃষ্ঠের বেশ কিছু অংশে পানির অস্তিত্ব আছে বলে প্রমাণ করছেন। ইউরোপা ভবিষ্যতে মানুষ বসবাসের উপযোগী হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে বলে স্বপ্ন দেখছেন। আরো বাসযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করেছেন, আবার মরিয়া হয়ে আমাদের জন্য পৃথিবীর বাইরে আরেকটা বসত খুঁজে বেড়িয়েছেন।

সেগানের কিছু মূলবিশ্বাস ছিল। তিনি মনে করতেন, মহাবিশ্বের সবকিছু নিয়মমাফিক ও যুক্তিতে বাঁধা। তিনি বিশ্বাস করতেন, মহাবিশ্ব একটা মমতাপূর্ণ জায়গা, প্রাণধারণের এমন কি বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন প্রাণীর বিকাশের উপযুক্ত জায়গা। তাঁর দৃষ্টিতে কসমস ছিল আত্মসচেতনতায় পরিপূর্ণ একটা স্থান। তিনি বিশ্বাস করতেন, আমরা একদিন মহাজগতের অন্য প্রাণীদের সঙ্গে যোগাযোগের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি-এই ব্ৰহ্মাণ্ড আমাদের ব্যাপারে পুরোপুরি উদাসীন। পৃথিবী হচ্ছে মহাবৈশ্বিক সমুদ্রতটে পড়ে থাকা একটা বালুকণা মাত্র। কিন্তু এই মামুলি পাথুরে গ্রহটাতেই আমাদেরকে তাবু খাটাতে হবে। এজন্য প্রয়োজন বিজ্ঞান আর যুক্তি, সাহসিকতা আর দূরদৃষ্টি।

ব্যক্তিগত জীবনে সেগান ছিলেন সংশয়বাদী। মৌখিক বর্ণনার প্রতি তিনি চরম আসক্ত ছিলেন। নিজের সব চিন্তা রেকর্ড করে রাখতেন তিনি। রেকর্ডারটা যেন কখনোই তাঁর ঠোঁট থেকে দূরে থাকত না। তাঁর লেখার মধ্যে যে কথোপকথনের সুরটা স্পষ্ট, এটার মূল কারণ হচ্ছে এটাই-তিনি লিখতেন না, বলতেন বেশির ভাগ সময়, আর তাঁর সেক্রেটারিরা পরে সেটা রেকর্ডার শুনে লিখে নিতেন। তিনি মারিজুয়ানা পছন্দ করতেন। মাঝে মধ্যে রেকর্ডিং আর মারিজুয়ানা একসঙ্গে চলত, এতে তিনি কাজ করার উৎসাহ পেতেন। সেখান প্রমাণ করেছেন, বিজ্ঞান শুধু ল্যাবরেটরির বন্ধ দরজার অন্যদিকে আবদ্ধ থাকার বিষয় না।

পৃথিবীর প্রতিটা মানুষের যেমন বিজ্ঞান চর্চার অধিকার আছে, তেমনই আছে বৈজ্ঞানিক গবেষণা সম্বন্ধে প্রত্যেকটা তথ্য জানার অধিকার। তাঁর সম্পর্কে যাই বলা হোক না কেন, সেটা তাঁর ব্যক্তিত্বের মাহাত্ম্যকে ফুটিয়ে তুলতে পারবে না কখনোই। জ্যোতির্বিজ্ঞানী, কসমোলজিস্ট, জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী, লেখক, বিজ্ঞান জনপ্রিয়তার সহায়ক, এবং বিজ্ঞান বিপ্লবী, ক্ষণজন্মা পুরুষ কার্ল সেগান।

সূত্র : মনের খবর জানুয়ারি ২০২১

/এসএস/মনেরখবর/

Previous articleআচরণ, ইতিবাচক আচরণ এবং ‘না’ বলতে পারার পদ্ধতি ও প্রয়োজনীয়তা
Next articleআমার স্বামী ঘুমের মধ্যে কথা বলে এবং মানুষকে গালাগালি করে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here