আজ বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। বাক্যটি দেখা মাত্র মাথার মধ্যে কয়েকটি কথা আর প্রশ্নের বিদ্যুৎ খেলে গেল। কারো শরীর খারাপ, এ কথা শুনলে ডাক্তার- বৈদ্য, ওষুধ -পথ্য, সেবা কত কিছু শুরু হয়ে যায়। কিন্তু যদি বলি আমার মন খারাপ। এটা কি কোনো গুরুত্ব পায় পরিবারে, বন্ধু মহলে বা কর্মস্থলে কোথাও? উল্টো হাসির খোড়াক হব আমি। অথবা করুণার। অথচ দিনের পর দিন এই মন খারাপের পাহাড় জমে তৈরি হয় মানসিক সমস্যা। যা শারীরিক সমস্যার মতো কোনো ওষুধে নিরাময় প্রায় সম্ভব নয় বললেই চলে।
আমাদের শিশুরা আজ নানা বাস্তবতায় গৃহবন্দী প্রায়। হাতে হাতে নানা ডিভাইস চোখ সারাক্ষণ সেই পর্দার দিকে। নেই কোনো সংযোগ প্রকৃতি বা সবুজের সাথে। বাড়িতে ভাইবোনের অভাবে প্রাপ্ত বয়স্ক সাহায্যকারীর সাথে সারাদিন কাটিয়ে হারিয়ে যায় শৈশব। বাবা মায়ের সঙ্গ না পাওয়ায় দূরত্ব বাড়ে। নানা নানি, দাদা দাদীর আদর প্রশ্রয় না পেয়ে, রূপকথার গল্প না শুনে কোমল বৃত্তি গুলো জাগছে না। তৈরি হচ্ছে না কল্পনার জগৎ। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাওয়ায় সহমর্মিতা, ভাগাভাগি করে জীবন যাপনের ভাবনাটাই হারিয়ে যাচ্ছে। ফলে চোখে মোটা কাঁচের চশমার পাশাপাশি মনের ওপরেও জমছে উত্তর না পাওয়া প্রশ্নের আস্তরণ।
কিছুদিন ধরে আমরা দেখতে পাচ্ছি মায়ের হাতে সন্তান খুনের ঘটনা। যদিও আমি কখনোই বিশ্বাস করি না একজন সুস্থ মা কখনো নিজের সন্তানকে খুন করতে পারেন। তারপরও যদি তদন্তে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মেনেও নেই, তবুও কি শিশু মনের সুস্থ বিকাশের দিকে লক্ষ্য রেখে গণমাধ্যমের এ কথা ব্যাপক প্রচার করা উচিত? এ বছর প্রথম যে দুই সন্তান মায়ের হাতে বলি হযেছে বলে কথিত। সেই মেয়েটি আমার বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রি। একটি পরীক্ষার হলে মেয়েটির রোল নম্বর ডাকতে কেউ সাড়া দেয় না। কয়েকবার ডাকার পরে যখন জানতে চাই, মেয়েটি অনুপস্থিত কেন? স্তব্ধতা ভেঙে একজন দাঁড়িযে চোয়াল শক্ত করে উত্তর দেয়,’ ওকে তো ওর মা মেরে ফেলেছে।’ আমি সজোড়ে এক ধাক্কা খাই। প্রথমত ভুলে যাবার জন্য। দ্বিতীয়ত শিশুর মনে মায়ের প্রতি ভিত্তি ও বিদ্বেষ জন্মাতে দেখে। মা শিশুর প্রথম আশ্রয়, নির্ভরতার স্থান, বন্ধুত্বের হাত, প্রথম শিক্ষক সব কিছুই মা। আমরা বড়রা কত অবিবেচকের মতো সেই আশ্রয়টা ছিনিয়ে নিচ্ছি এই শিশুদের কাছ থেকে। একটু সতর্কতা পারতো শাশ্বত মাতৃস্থানটি বহাল রাখতে।
এক সময় বড়রা কথা বলার সময় ছোটদের সরিয়ে দেয়া হতো। এতে অহেতুক কৌতুহল তৈরি হতো এ কথা ঠিক। কিন্তু সব কথা শিশুর জানা উচিতও নয়, অথবা তাকে জানিয়ে তার মনের বোঝা অহেতুক বাড়ানোও বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এ যুগে আমরা ততটা খেয়াল না করে বিপদ ডেকে আনছি।
শিশুর মনের ভার টেলিভিশনে সিনেমায় কিংবা বাড়িতে অসংলগ্ন আচরণের স্পর্শে আসার কারণে বেড়ে যায়। কিন্তু এপ্রশ্ন নিয়ে আমার আপনার কাছে গেলে আমরা বিরক্ত হই, এচড়েপাকা বলে ধমকে সরিয়ে দেই। তাতে মনের ভার আরো অবহ হয়ে ওঠে শিশুর কাছে। ক্রমে সে বিষণ্ন হতে থাকে। স্কুলে যেতে চায় না। কারো সাথে মেশে না। একাকীত্বের ঘেরা টোপে নিজেকে বন্দী করে ফেলে। শুরুতেই যদি আমরা এ অবস্থা বুঝতে পারি তাহলে তৎক্ষনাৎ মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া উচিত। কাউন্সিলরের কাছেও যাওয়া যেতে পারে। যিনি পদ্ধতিগত ভাবে কথা বলে মনের কথাগুলো জানতে পারবেন। তার মতো করে বুঝিয়ে বলতে পারবেন।
আমাদের অনেকের ধারণা, মনোচিকিৎসক মানেই পাগলের চিকিৎসক। তার কাছে গেলে সবাই পাগল বলবে। এ ভ্রান্ত ধারণা আমাদের মন ও সমাজ থেকে দূর করতে হবে। আমার আপনার প্রত্যেকেরই মানসিক সুস্থতার জন্য চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত যেকোনো প্রয়োজনের শুরুতেই। শারীরিক সমস্যায় যেমন চিকিৎসকের কাছে যাই মনের বা মানসিক যে কোনো সমস্যায় মনোচিকিৎসকের কাছে যেতে হবে নিশ্চয়ই।
প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। মনের খবরের সম্পাদকীয় নীতি বা মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই মনের খবরে প্রকাশিত কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় নেবে না কর্তৃপক্ষ।