সমস্যা:
আসসালামু আলাইকুম। স্যার, আমার বয়স ২১ বছর। আমি একটি সরকারি মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমি স্কুল, কলেজে মিডিয়াম ক্যাটাগরির ছাত্র ছিলাম। ২০১৪ সালে আমি এইচ এস সি পাশ করি। আমার স্বপ্ন ছিল কেমিক্যাল ইন্জিনিয়ারিং অথবা ফার্মেসিতে পড়ার। কিংবা ঢাবিতে সাইকোলজি পড়ার। কিন্তু, পরীক্ষা চলাকালে আমার ম্যাথ ফার্স্ট পেপার খুব খারাপ হয়। আমি একদম ভেংগে পড়ি। দুঃশ্চিন্তায় আমার ঘুম হত না, বুক ধড়ফড় করত, কিছু ভাল লাগত না, মনে হত আমার সব স্বপ্ন শেষ, আমি ফেল করতে যাচ্ছি। যাহোক, এরকম অবস্থায় এডমিশন প্রিপারেশন ঠিকমত নিতে পারছিলাম না। শুধু চিন্তা হত যে, আমি তো ফেল করতে যাচ্ছি। আমার দ্বারা কিছু হবে না। কিছুদিন পরে রেজাল্ট দিল এবং অপ্রত্যাশিতভাবে গোল্ডেন এ প্লাস পেলাম। ম্যাথ সেকেন্ড পেপার আর প্রাকটিকালের মার্ক দিয়ে আমার ম্যাথ বিপর্যয় কেটে যায়। কিন্ত তখন নতুন দুঃশ্চিন্তা শুরু হয়। আমার এডমিশন প্রিপারেশন খারাপ। এখন আর প্রস্তুতি নেবার সময় নেই। এই কারণে আমি হাল ছেড়ে দিই। পড়ার প্রতি ভয় ও বিরক্তি চলে আসে। প্রায়ই তখন একাএকা কান্নাকাটি করতাম। এরপর আমার টার্গেট অনুযায়ী কোথাও চান্স পেলাম না। আমি জেনারেল নলেজ এ ভাল ছিলাম। নিয়মিত পেপার এবং লিটারেচার পড়তাম। তাই, ইনজিনিয়ারিং এর প্রস্তুতি নিয়েও আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্নতত্ত্ব এবং ইতিহাসে চান্স পাই। কিন্ত আমি ভর্তি হই নি। পরবর্তীতে বেশ কিছুদিন পরে জাহাঙ্গীরনগরেই প্রাণিবিদ্যা বিভাগে ওয়েটিং থেকে ভর্তি হই। আমার মেধার জোরে না বরং আন্দাজে এমসিকিউ দাগিয়ে। কারণ আমার প্রিপারেশনই ছিল না। এরপর আমি ফার্মেসীর জন্য সেকেন্ড টাইম প্রিপারেশন নিতে থাকি। কিন্তু পরের বছর মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষা সবার আগে হয়। এবং শখের বশে আমিও পরীক্ষা দেই এবং অনেক
এমসিকিউ আন্দাজে, ইচ্ছামত দাগিয়ে দিয়ে আসি। এবং হঠাৎ করেই আমি নিচের দিকের একটি মেডিকেলে চান্স পেয়ে যাই। আমার মেডিকেল এ পড়ার কোনো ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু আব্বু আম্মুর খুশির জন্য, তাদের মুখে হাসি দেখে আমি মেডিকেল এ ভর্তি হয়ে গেলাম। এরপরই আমার জীবনমরণ সমস্যা শুরু হল। আমি কিছুতেই মেডিকেলের পড়াশোনার সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছি না। আমাদের কলেজটা নতুন হয়েছে। তাই মানসম্মত টিচার নেই। পড়া বুঝতে পারি না ঠিকমত। বন্ধুরা মিলে শেয়ার করে বুঝতে হয়। কিন্তু আমি ওদের সাথে পেরে উঠিনা। আমার মনে হয় ওরা মেডিকেলের জন্য কোচিং করেছে। এত পড়া পড়বার জন্য ওদের প্রস্তুতি আছে। ওদের স্বপ্নই এটা। আর আমার এসব কিছুই নাই। আন্দাজে এমসিকিউ দাগিয়ে কপালের জোরে চান্স পেয়েছি। আমি কেমন করে ওদের সাথে পারব? প্রচন্ড হতাশা লাগে আমার। আমার মাথায় পড়া ঢোকে না। প্রচন্ড দুঃশ্চিন্তায় ভুগতে শুরু করি। বই খাতা দেখলেই ভয় লাগে। পড়তে বসতে ইচ্ছে করে না। রাতে ঘুম হয়না। বুক ধরফর করে। গলার কাছে মনে হয় যেন কি আটকে আছে। বিশেষ করে প্রত্যেক বিকেলে খুব খারাপ লাগে। চোখ দিয়ে নীরবে পানি পড়তে থাকে। বাসায় চলে যেতে ইচ্ছে করে। বাসায় ফোনে কথা বলার সময় চোখের পানি বাধ মানে না। পড়তে ইচ্ছে করে না। যা পড়ি তা ভুলে যাই। বই নিয়ে বসে আছি, কি পড়তেছি কিছুই মনে হয়না। প্রচন্ড অমনোযোগী হয়ে গেছি। তারপর একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞের পরামর্শে আমি প্রায় দেড়মাস clofranil 25 mg খাই। রাতে একটা করে। উনি আমার ইসিজি ইকো থাইরয়েড ফাংশন সব টেস্ট করে নরমাল পেয়েছেন। এরপরও আমার অস্থিরতা কমছিল না। দিনে দিনে পড়াশোনায় অনেক গ্যাপ জমে যায়। আইটেম কার্ড এগুলো পেন্ডিং হতে থাকে। কোনো পরীক্ষায় পাস করলেই পরের পরীক্ষা নিয়ে টেনশন আরম্ভ হয়। তারপর আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট ম্যাডাম কে দেখাই। উনি আমাকে GAD এর কথা বলেন। এবং এই ওষুধ গুলি প্রেসক্রাইব করেন।
1.disopan . 5mg (0+0+.5)
2.indever 10 (1+1+1)
3.serulax 50 mg (1+0+0)
4.bicozin (1+0+1)
প্রায় বিশদিন হল আমি এ ওষুধগুলো খাচ্ছি। কিন্তু এখনও আমি পড়তে ভয় পাই। আইটেম পেন্ডিং খাচ্ছি। পরীক্ষার হলে মাথা আউলিয়ে যায়। কিছু মনে পড়ে না। অস্থির লাগে। খুব কান্না পায়। মনে কোনো জোর পাইনা। কনফিডেন্স বলতে কিছু নাই। সারাদিন শুয়ে থাকতে মন চায়। ভয় লাগে যে, ডাক্তার হয়তো হতে পারব না। সবাই ভাববে প্রশ্ন ফাস করে চান্স পেয়েছি। অথচ,আমি প্রশ্ন পাইনি। আমি বন্ধুদের সাথে মিশি, আড্ডা দেই, ফেসবুক চালাই, কিন্তু কিছুতেই পড়তে পারি না। স্যার, যদি আল্লাহর নিষেধ না থাকত, তাহলে এতদিনে আমি আত্মহত্যা করতাম। আমার সার্বিক অবস্থার উপর আপনার পরামর্শ চাই। আমি কি ভাল হতে পারব? মেডিকেল এ পড়তে পারব? ভাল হতে কতদিন লাগবে আমার? এবং দোয়া চাই যেন আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট হতে পারি।
ধন্যবাদ আপনাকে।
পরামর্শ:
তুমি যা বললে তাতে বোঝা যাচ্ছে তুমি বর্তমানে ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতা রোগে ভুগছ। এর আগে তোমার পছন্দমত বিষয়ে ভর্তি না হতে পারা এবং এই মেডিকেলে ভর্তি হওয়াটা দুটো মিলেই তোমার একটা স্ট্রেস বা মানসিক চাপ কাজ করছে। একই সাথে তুমি নতুন মানসিক চাপে পড়েছ তোমার মেডিকেল কলেজের লেখাপড়া, কলেজের পরিবেশ সব মিলিয়ে পড়াশুনার সাথে তোমার এডজাস্ট করতে কষ্ট হচ্ছে। এটা এডজাস্টমেন্ট ডিজঅর্ডারেরও কিছু কারণ। পরবর্তীতে এই এডজাস্টমেন্ট ডিজঅর্ডার থেকে অ্যাংজাইটিতে এবং বর্তমানে তুমি ডিপ্রেশনে ভুগছ।
এখন তোমার দরকার হল একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে পুরোপুরি ডিপ্রেশনের চিকিৎসা নেয়া। তুমি যে ঔষধপত্র খাচ্ছ সেটা অ্যাংজাইটি কমায় কিন্তু তোমার ডিপ্রেশনের চিকিৎসা নেয়ার প্রয়োজন আছে। সেই সাথে তোমাকে কিছু সাইকোলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট নিতে হবে যাকে আমরা বলি সাইকোথেরাপি। তুমি এই পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে পারছ না বলে হাল ছেড়ে দিয়েছ এবং ডিপ্রেশনে ভুগছ। তোমাকে স্ট্রেস মোকাবেলার কৌশল শিখতে হবে সেই সাথে তোমাকে নিয়মিত এই মেডিকেল লাইফের সাথে এনগেজ থাকতে হবে। তুমি যদি এনগেজ না থাক তাহলে ক্রমান্বয়ে আরো পিছিয়ে যাবে, এতে তোমার ডিপ্রেশন বাড়বে এবং তুমি কিছু করতে পারবে না।
এই মুহূর্তে তোমাকে মনে রাখতে হবে যে তুমি মেডিকেলে ভর্তি হয়েছ, তোমার পেছনে তাকানোর কোনো সুযোগ নেই। তাই তোমাকে এমন বন্ধুদের সাথে মিশতে হবে যারা নিয়মিত লেখাপড়া করে এবং তোমাকে লেখাপড়ায় সাহায্য করতে পারবে। তুমি যে পিছিয়ে পড়েছ সেটা কাভার করতে হবে। ফেইসবুকের পিছনে বেশি সময় ব্যয় না করে তুমি বন্ধুদের সাথে সময় ব্যয় কর এবং মিলেমিশে লেখাপড়া কর। বেশি করে মেডিকেল রিলেটেড কার্যক্রমে একটিভ হও এবং বুঝ যে আমার ভাগ্য এটার সাথে জড়িয়ে গেছে। এটা যত মেনে নিবে তত দ্রুতই তোমার সমস্যাটা দূর হওয়া সম্ভব হবে, ঔষধও কাজে দিবে। সুতরাং ঔষধ এবং সাইকোলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট দুটো মিলে আর তুমি যদি আমার পরামর্শমত পজিটিভ চিন্তা করে মেডিকেল স্টুডেন্ট হিসেবে তোমার কাজে লিপ্ত থাক তাহলে তোমার সমস্যার সমাধান হবে। ধন্যবাদ।
পরামর্শ দিচ্ছেন,
প্রফেসর ডা. এম এস আই মল্লিক
দৃষ্টি আকর্ষণ- মনেরখবর.কম এর প্রশ্ন-উত্তর বিভাগে, মানসিক স্বাস্থ্য, যৌন স্বাস্থ্য, মাদকাসক্তি সহ মন সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে আপনার কোনো জানার থাকলে বা প্রশ্ন থাকলে বা বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দরকার হলে question@www.monerkhabor.com এই ইমেলের মাধ্যমে প্রশ্ন পাঠাতে পারেন।