অপরাধী মানসিক রোগী হলে চিকিৎসকের ভূমিকা

0
53

ডা. অভ্র দাশ ভৌমিক
মানোরোগ বিশেষজ্ঞ

১৮৪৩ সালের জুন মাসের ২০ তারিখ। সকাল থেকেই লন্ডনের ডাউনিং স্ট্রিটে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের আশেপাশ উদ্ভ্রান্তের মতো ছোটাছুটি করছেন ড্যানিয়েল ম্যাকনটন নামে ৩০ বছর বয়সী এক যুবক। তার উদ্দেশ্য বৃটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী স্যার রবার্ট পিলকে হত্যা করা। যুবকটির ধারণা উরী পার্টির তৎকালীন নেতা রোবট পিল তার পার্টি সদস্যদেরকে দিয়ে ম্যাকনটনকে সার্বক্ষণিক অনুসরণ করা এবং হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন। তো কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন লোককে দেখা গেল হন্তদন্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন থেকে বের হয়ে আসছেন। তাকে প্রধানমন্ত্রী ভেবে ম্যাকনটন সরাসরি গুলি করে বসেন এবং এতে লোকটি নিহত হয়। আসলে তিনি ছিলেন রবার্ট পিলের ব্যক্তিগত সহকারি এডওয়ার্ড ডমন্ড। ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ ম্যাকনটনকে গ্রেফতার করে।

এবার চলে আসি ২০২২ সালের অক্টোবর মাসের কোনো এক সকালের ঘটনায় নরসিংদীর ঘোড়াশালে গৃহবধূ সাবিনা (ছদ্মনাম) তার গর্ভাবস্থার শেষ মাস অতিক্রম করছেন। সারাক্ষণ কেমন যেন ভয়ে কুকড়ে থাকেন। কারো সঙ্গে কথা বলেন না, খাবার খেতে চান না। মাঝে মাঝে একা একা বিড়বিড় করে কী সব যেন বলেন।

  • তার বিশ্বাস তার পেটের ভেতরে সাপ রয়েছে এবং তিনি সেই সাপ প্রসব করবেন। তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে আল্ট্রাসনোগ্রাম করবার জন্য। কিন্তু তিনি ক্রমাগত চিৎকার করছেন এবং আল্ট্র্রাসনোগ্রাম করতে বাধা দিচ্ছেন; কারণ তার ধারণা আল্ট্র্রাসনোগ্রাম করলে সবাই সেই সাপ দেখতে পাবে।

তার তীব্র উত্তেজনার জন্য স্বাভাবিক প্রসব সম্ভব না হওয়ায় তার সিজারিয়ান সেকশন অপারেশন করা হয় এবং পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। তাতেও তার অবিশ্বাস দূর হয় না। ছেলেটিকে টিপে টিপে দেখেন, হাতে নিয়ে ঝাঁকান। কারণ তার বিশ্বাস এটা মানুষের সন্তান নয়; এটি সাপ।

বাচ্চাটির যেদিন বিশ দিন বয়স সেদিন সাবিনা বাচ্চাটিকে পাশের ডোবায় ফেলে দিয়ে আসে এবং এসে বলে যে- সে সাপের বাচ্চাটিকে ফেলে দিয়ে এসেছে। এমনকি তার মা যখন বাচ্চাটিকে উদ্ধার করতে ডোবায় নামে তখনও সে তার মাকে ক্রমাগত বাধা দেয় কারণ তার ধারণা ডোবায় নামলে সাপ তাকে কামড় দিবে। সেদিন বিকেলেই স্বামীর করা মামলায় সাবিনা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়।

প্রায় দুই শতাব্দী ব্যবধানে দুটি ঘটনা ঘটলেও ঘটনা দুটির মধ্যে দারুন মিল রয়েছে। প্রথম ঘটনাটি ফরেনসিক সাইকিয়াট্রির ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ড্যানিয়েল ম্যাকনটন আগে থেকেই সিজোফ্রেনিয়া নামক গুরুতর মানসিক রোগে আক্রান্ত ছিলেন এবং চিকিৎসাধীন ছিলেন। মামলাটি যখন কোর্টের বিচারাধীন তখন লন্ডনের অনেক প্রখ্যাত সাইকিয়ট্রিস্ট এই মামলায় বিশেষজ্ঞ মতামত দেন। পরিপ্রেক্ষিতে ম্যাকনটনকে সাজা দেওয়ার পরিবর্তে খালাস দিয়ে হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। এই মামলার রায় এবং পরবর্তী ব্যাখ্যা সমূহ M’Naghten rule (pronounced, and sometimes spelled, McNaughton) নামে পরিচিত যা বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় গুরুতর মানসিক রোগীদের রক্ষাকবচ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

সাবিনার ক্ষেত্রেও আদালত তাকে মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য মানসিক হাসপাতালে প্রেরণ করেন। বর্তমানে তিনি জামিনে রয়েছেন।

আসলে মানসিক রোগ এবং অপরাধ প্রবণতার মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক বিদ্যমান। নরহত্যা, অগ্নি সংযোগ, সম্পত্তি বিনষ্টকরণ, নির্যাতন এমনকি ধর্ষণের মতো ভয়াবহ অপরাধের পেছনে অনেক সময় মানসিক রোগের প্রভাব লক্ষ করা যায়। গুরুতরও কিছু মানসিক রোগ যেমন সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার ডিজঅর্ডার, তীব্র বিষণœতা, বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তিত্বের সমস্যা (বিশেষত Antisocial personality disorder), মাদকাসক্তি, শিশু-কিশোরদের বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা ও আচরণগত সমস্যা ইত্যাদি রোগে আক্রান্তদের মধ্যে অপরাধ সংগঠনের হার সাধারণ মানুষের চাইতে বেশি থাকে।

দীর্ঘমেয়াদি ও গুরুতর মানসিক রোগের ক্ষেত্রে তাদের দ্বারা সংঘটিত কোনো ঘটনার স্বাভাবিক বিচার-বিশ্লেষণ ও পরিণতি সম্পর্কে বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ বাধাগ্রস্ত হয়। ফলশ্রুতিতে সহজেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে যেতে পারে। অপরাধ সংঘটনের পর থেকে সাজা হওয়া এমনকি সাজা কার্যকর করা পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে একজন মানসিক রোগ চিকিৎসকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

মাননীয় আদালতের নির্দেশে ফৌজদারী বিচার কার্যক্রমে সাধারণত চারটি ক্ষেত্রে মানসিক রোগের চিকিৎসকের ভূমিকা রয়েছে। যেমন-১) অভিযুক্ত ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্যের মূল্যায়ন। ২) মানসিক রোগে আক্রান্ত হলে তার চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা। ৩) বিভিন্ন প্রতিবেদন দাখিল করা। যেমন, অভিযুক্ত ব্যক্তির বিচার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সক্ষমতা (Fitness to plead) প্রতিবেদন, অপরাধ সংগঠনের পেছনে মানসিক রোগের সম্ভাব্য প্রভাবজনিত (Insanity defence) প্রতিবেদন, এমনকি সাজাপ্রাপ্ত হলে সাজা ভোগ করবার সক্ষমতাজনিত (Fitness to be executed) প্রতিবেদন। ৪) মামলার বিভিন্ন পর্যায়ে স্বশরীরে আদালতে উপস্থিত থেকে সাক্ষ্য প্রদান।

প্রতিটি পর্যায়ে একজন মনোচিকিৎসকের খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং সংবেদনশীল ভূমিকা পালন করতে হয়। যথেষ্ট পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করা গেলে একদিকে যেমন গুরুতর মানসিক রোগে আক্রান্তদের যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব তেমনি আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করে সার্বজনীন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করাও সহজতর হয়।

সূত্র : ডিসেম্বর ২০২২ সংখ্যা। 

লেখক :
সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।

  • আপনার কপি সংগ্রহের জন্য কল করুন : 01797296216, নিয়মিত পেতে গ্রাহক হতে চাইলে কল করুন : 01865466594 এই নাম্বারে।

/এসএস/মনেরখর/

Previous articleমানসিক চাপে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছি না
Next articleবিএসএমএমইউ সাইকিয়াট্রি : মার্চের বৈকালিক আউটডোর সূচি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here